পার্বত্য চুক্তির সেই প্রতিশ্রুতি আর কবে পূরণ হবে

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশনের দাবিতে গণ মানববন্ধন। রাঙামাটি সদরের বড়াদম এলাকা।ফাইল ছবি

একসময় কোনো একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত যুদ্ধের কারণে। সে যুদ্ধটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কাছে কখনো কাঙ্ক্ষিত ছিল না।

দুই ভাই বেড়ে উঠেছিলেন একই পরিবারে। তাঁরা যুদ্ধের ময়দানে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু দুই ভাই যোগ দিয়েছিলেন দুই বিপরীত শিবিরে। বড় ভাই যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। ছোট ভাই শান্তিবাহিনীতে।

শান্তিবাহিনী তখন লড়ছিল পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অধিকারের জন্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম কেঁপে উঠছিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আর বাতাসে ভাসছিল বারুদের গন্ধ। একদিন একটি টহল দল দুর্গম পাহাড়ের পথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় গেরিলারা অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। আক্রমণকারীদের মধ্যে ছিলেন ছোট ভাইও। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরই বড় ভাই। নিজের সহযোদ্ধাদের রক্ষা করতে তিনি ছিলেন অবিচল। গড়ে তুলেছিলেন তীব্র প্রতিরোধ।

আরও পড়ুন

কাঁপা কাঁপা হাতে ছোট ভাই ট্রিগার টানেন। বড় ভাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁর রক্ত শুষে নেয় পাহাড়ের মাটি। রক্তপিপাসু সেই মাটি তাঁদের দুজনের কাছেই ছিল মাতৃভূমি। ছোট ভাই হয়ে পড়েছিলেন নীরব-নিস্তব্ধ। বাঁধা পড়েছিলেন এক সীমাহীন অপরাধবোধ, গ্লানি ও শোকের শৃঙ্খলে।

যুদ্ধ চলতে থাকে। পাহাড় সাক্ষী হয়ে রইল এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের। বান্দরবানের কোনো এক স্থানে আজ সেই দুই ভাই বিশ্রামরত। একজন মাটির গর্ভে, অন্যজন এক দুঃসহ স্মৃতির কারাগারে।

রাষ্ট্রকে যদি একটি পরিবার হিসেবে দেখা হয়, তাহলে পার্বত্য চুক্তির পূর্ববর্তী সশস্ত্র সংঘাতের কারণে বাংলাদেশকে দেখা যেতে পারে অন্তঃস্থল থেকে ভেঙে পড়া একটি পরিবারের রূপক হিসেবে। এটি ছিল যেন বাংলাদেশ নামক একটি বৈষম্যমূলক পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তৈরি হওয়া এক গভীর বিভাজন ও সংঘাত।

চুক্তি থেকে বিচ্যুতি

এটি কোনো সাধারণ সংঘাত ছিল না। এটি কেবল ভূমি বা জাতিগত কারণে ছিল না। মূলত এটি ছিল একটি রাজনৈতিক সংকট। দশকের পর দশক ধরে বিদ্যমান অবহেলা, বৈষম্য ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। পাহাড়ের বুকে যেন নেমে এসেছিল এক অদ্ভুত আঁধার। তবু সবচেয়ে অন্ধকার সময়েও সংলাপের দ্বার কখনো বন্ধ হয়নি।

এরশাদ সরকারের সঙ্গে ৬ বার, খালেদা জিয়ার সরকারের সঙ্গে ১৩ বার এবং শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ৭ বার—মোট ২৬ বার আলোচনার পর অবশেষে অস্ত্রের ঝনঝনানি থেমে যায়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি।

এটি শুধু একটি চুক্তি ছিল না, ছিল এক রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। এই চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পাহাড়–অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়। এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ ও সার্বিক উন্নয়ন সাধনে একটি বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়, যেখানে পাহাড়ি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং আদি ও স্থায়ীভাবে বসবাসরত বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

১৯৯৭ সালের পর বিভিন্ন সরকার এসেছে এবং গেছে, কিন্তু কোনো সরকারই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করেনি। যে দল এটি স্বাক্ষর করেছিল, সেই আওয়ামী লীগ প্রায় দেড় দশক ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তারা এর মূলধারাগুলোকে অবহেলায় ফেলে রেখেছিল। ভূমি বিরোধ এখনো অমীমাংসিত, ভূমি কমিশন কার্যত কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। জমি ফেরত পাওয়ার জন্য পাহাড়ি পরিবারগুলোর দাখিল করা ২৬ হাজার মামলার একটিও নিষ্পত্তি হয়নি।

অন্য অনেক বিষয়ের মধ্যে চুক্তিটি একটি ভূমি কমিশন গঠনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বেদখল হওয়া ভূমি পুনরুদ্ধার, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হিসেবে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোয় ভিন্ন ভিন্ন ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তর, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প ও সেনাশাসন প্রত্যাহার, অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু ও ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের পুনর্বাসন, শুধু স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সেই তালিকার মাধ্যমে জেলা পরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা—ইত্যাদির অঙ্গীকার বহন করেছিল।

কিন্তু প্রায় ২৮ বছর পর সেই প্রতিশ্রুতি আজ অবহেলিত আর উপেক্ষিত।

১৯৯৭ সালের পর বিভিন্ন সরকার এসেছে এবং গেছে, কিন্তু কোনো সরকারই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করেনি। যে দল এটি স্বাক্ষর করেছিল, সেই আওয়ামী লীগ প্রায় দেড় দশক ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তারা এর মূলধারাগুলোকে অবহেলায় ফেলে রেখেছিল। ভূমি বিরোধ এখনো অমীমাংসিত, ভূমি কমিশন কার্যত কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ।

আরও পড়ুন

জমি ফেরত পাওয়ার জন্য পাহাড়ি পরিবারগুলোর দাখিল করা ২৬ হাজার মামলার একটিও নিষ্পত্তি হয়নি। যে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা ছিল, সেগুলো এখনো বিদ্যমান। বহিরাগত লোকজন এখনো বিভিন্নভাবে পাহাড়িদের জায়গাজমি দখল করছে। ভারত থেকে ফেরত আসা শরণার্থী ও সংঘাতকালে অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হওয়া পাহাড়ি মানুষ এখনো যথাযথ পুনর্বাসন পায়নি।

এদিকে পাহাড়ে চলছে নির্বিচার গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা, ভূমি দখল, জোরপূর্বক উচ্ছেদ, সাম্প্রদায়িক হামলা ও নারীর প্রতি সহিংসতা ইত্যাদি। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার দাবি করেছিল, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অবশিষ্ট ৭টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত বা বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন করা হয়েছে, ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং বাকি ২৯টি ধারা বাস্তবায়নের বাইরে রেখে দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু এসব ধারা নিয়মিত লঙ্ঘন করা হয়েছে। পাহাড়ে সংঘাতের মূল কারণগুলো এখনো দূর করা হয়নি।

একটি অনবদ্য ভ্রাতৃত্বের উপাখ্যান

একটি প্রাচীন গল্প আছে সৌভ্রাতৃত্ব নিয়ে—যেখানে ভালোবাসা ও উদারতা ছিল ভ্রাতৃত্বের ভিত্তি। এক কৃষক দম্পতির দুই পুত্র ছিল। তারা সুখে-সমৃদ্ধিতে বাস করত। মৃত্যুর আগে পিতা সন্তানদের তাঁদের খাদ্যশস্য সমানভাবে ভাগ করে নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে যান। পিতার মৃত্যুর পর ভাইয়েরা পিতার সেই ইচ্ছা রক্ষা করে। এক ভাই বিয়ে করে পাঁচ সন্তানের পিতা হয়, আরেকজন অবিবাহিতই থেকে যায়। ন্যায্যতা যাতে নিশ্চিত হয়, তার জন্য অবিবাহিত ভাইটি গোপনে রাতের বেলা অতিরিক্ত কিছু শস্য তার বিবাহিত ভাইয়ের ভান্ডারে রেখে আসত। অন্যদিকে তার অজান্তে বিবাহিত ভাইটিও একই ধরনের কাজ করে গেছে। তাদের খাদ্যশস্য আর সৌভ্রাতৃত্বের এই নীরব বিনিময় চলতে থাকে দীর্ঘদিন ধরে। এক রাতে তারা শস্যের বিনিময় করতে গিয়ে অজান্তে একে ওপরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। একে ওপরের প্রতি ভালোবাসার স্বরূপ বুঝতে পেরে তারা লজ্জায় দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় আর নীরবে ফিরে যায় যার যার গৃহে।

যখন তারা মারা যায়, গ্রামবাসী ঠিক সেই স্থানে একটি মন্দির নির্মাণ করে, যেখানে দুই ভাই একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিল। তাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, ভ্রাতৃপ্রেম ও উদারতার স্মারক হিসেবে।

পার্বত্য চুক্তি হওয়া উচিত ছিল এমনই একটি মন্দিরের রূপক, পরিবারসুলভ একটি রাষ্ট্রের সদস্যদের মধ্যে করা এক পবিত্র অঙ্গীকার। এটি হতে পারত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের শান্তি ও সংহতি গড়ে তোলার শক্ত ভিত্তি।

প্রত্যাশার পুনর্জাগরণ

এখন বাংলাদেশ আবার এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। নতুন সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি পুনর্গঠন করেছে, যেখানে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন আহ্বায়ক, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা ও শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান সুদত্ত চাকমা সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।

সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কমিটি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পরিবীক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের পাশাপাশি চুক্তি বাস্তবায়নসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে এবং প্রয়োজনে সরকারের কাছে সুপারিশ করবে।

আবারও আশার প্রদীপ জ্বলছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নেতারা ও নাগরিক সমাজ চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার শুধু কথায় নয়, সুস্পষ্ট সময়সীমাসহ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসুক। (প্রথম আলো, ২০ জুন ২০২৫)

এটা বেশ আশাজাগানিয়া যে দেশের মূলধারার অধিকারকর্মীরা ও নাগরিক সমাজও এখন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্নভাবে জোরালো আওয়াজ তুলছেন। ৯ আগস্ট ২০২৫ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে জাতীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত আলোচনা সভায় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জোরালো দাবি উঠেছে।

রাঙামাটিতে নবগঠিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির প্রথম বৈঠকের পর তৌহিদ হোসেন এটিকে ‘ফলপ্রসূ’ বলে উল্লেখ করেন এবং ধারাবাহিক সংলাপের প্রতিশ্রুতি দেন। কমিটি চুক্তির মূল ধারাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের অঙ্গীকার করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করেছে যে তারা চুক্তিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এটি পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বলা যেতে পারে।

উত্তরণের উপায়

পার্বত্য চুক্তির আগে রাষ্ট্রীয় বাহিনী আর গেরিলা যোদ্ধাদের মধ্যে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ নামক একটি পরিবার যেন অন্তঃস্থল থেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। পাহাড়ি জনগণকে ভোগ করতে হয়েছে অপরিসীম নির্যাতন ও নিপীড়ন। ১৯৯৭ সালের চুক্তি ছিল সেই ক্ষত সারানোর এবং আস্থা ফিরিয়ে আনার এক প্রচেষ্টা। কিন্তু প্রায় ২৮ বছরের অবহেলা ও প্রবঞ্চনার পর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পাহাড়ি সমাজে আজ গভীর সংশয় ও বিশ্বাস ভঙ্গের অনুভূতি শিকড় গেড়ে বসেছে।

আমরা ভ্রাতৃত্বের দুটি মডেল দেখেছি। আমাদের এখন ঠিক করতে হবে কোন মডেলটি আমরা বেছে নেব? এই নতুন সরকার কি অবশেষে ১৯৯৭ সালের প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে? নাকি পাহাড় থেকে যাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এক নিস্তব্ধ শ্মশানরূপে?

  • মিলিন্দ মারমা লেখক ও অধিকারকর্মী

ই–মেইল: [email protected]