মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চা কেউ করছে না, রাজনীতিই হচ্ছে

আফসান চৌধুরী। চার দশকের বেশি সময় ধরে ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন। হাসান হাফিজুর রহমানের অধীনে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র’ প্রকল্পের অন্যতম গবেষক ছিলেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লেখক-গবেষক প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ, এর ইতিহাসচর্চা ও রাজনীতি নিয়ে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও রাফসান গালিব

আফসান চৌধুরী

প্রশ্ন :

রাজনীতিকেরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়িয়েছেন। গবেষণাকাজেও তরুণদের সম্পৃক্ত করেছেন। এই তরুণেরা একাত্তরকে কীভাবে দেখছেন?

আফসান চৌধুরী: আমাদের ইতিহাসচর্চাটা অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে। ফলে এই ইতিহাসচর্চায় সাধারণ মানুষ কিংবা তরুণদের আগ্রহ কম। আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলতে এখন কে কবে ঘোষণা দিয়েছেন, কোন নেতা কোন তারিখে কী বলেছেন, এটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। এই ইতিহাসে তো সাধারণ মানুষ নেই। দ্বিতীয়ত, ইতিহাস নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যে ঝগড়া কিংবা বামপন্থীদের মধ্যে যে ঝগড়া, সে সম্পর্কেও তরুণদের আগ্রহ নেই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাত্তর নিয়ে পড়াতাম। এক দলের এক রকম বয়ানে শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্তিতে পড়ল। আমি বললাম, কোনো দলের কথা শোনার প্রয়োজন নেই। তোমরা বাড়িতে গিয়ে দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, একাত্তরে কী হয়েছিল। তাঁরা যা বলবেন, সেটিই প্রকৃত ইতিহাস। একজন এসে বলল, তার দাদা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। একজন বলল, তার নানা পালিয়ে বেড়িয়েছেন পুরোটা সময়। এভাবে তরুণদের সঙ্গে একাত্তরের সংযোগ ঘটে গেল। একটি মেয়ে এসে বলল, একাত্তরে তার মা তাকে কোলে করে সীমান্ত পার হয়েছেন। বলতে বলতে সে ক্লাসের মধ্যেই কেঁদে ফেলল। এরপর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলো। অন্যদিকে রাজনীতিকদের মুক্তিযুদ্ধচর্চা হলো তালিকায় নাম ওঠানো, সুযোগ-সুবিধা নেওয়া। আসল ইতিহাসচর্চাটা তাঁরা করছেন না।

প্রশ্ন :

আপনি ইতিহাসচর্চার দুর্বলতার কথা বলছেন। এর জন্য কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দায়ী নয়? বিসিএস পরীক্ষার্থীদের তো এসব দিন-তারিখ শিখতে হয়।

আফসান চৌধুরী: আমি শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলছি না। এটা তো সামগ্রিক ব্যবস্থার অংশ। এই শিক্ষা তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। ফলে শিক্ষায়ও রাজনীতিকরণ হয়েছে। সুবিধাবাদী ইতিহাসচর্চা হয়ে গেছে। বলা হচ্ছে, এখন এটা বলা যাবে, এটা বলা যাবে না। ইতিহাসচর্চায় তো সমাজ অনুপস্থিত। আমরা তো সমাজের ইতিহাস পড়াই না। রাজনৈতিক দলের ইতিহাস পড়াই। আমরা গণমানুষের কথা বলি না, বলি নেতাদের কথা।

প্রশ্ন :

আপনি স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আপনার অভিজ্ঞতা থেকে বলবেন, সেই গবেষণা করতে গিয়ে কোনো চাপের মুখোমুখি হয়েছেন কি? এই প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার পেছনে কী তাগিদ ছিল?

আফসান চৌধুরী: আমরা তো একাত্তরের প্রজন্ম। আমাদের বাড়িতেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। কিন্তু তাঁরা কেউ সেটা ফলাও করে বলতেন না। মনে করতেন, তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। এটা প্রচারের বিষয় ছিল নয়। প্রচারের বিষয় হলো অনেক পরে। ১৯৭৮ সালে আমরা ইতিহাস প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হই। এই প্রকল্পের প্রধান ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। অসাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর কারণেই প্রকল্পের কাজটি করা সহজ হয়েছে। এর আগে বাংলা একাডেমি মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিল। আমরা বাংলা একাডেমির কাছে সেসব তথ্য চাইলে তারা প্রথমে দিতে চায়নি। পরে হাসান ভাই সেটি আনার ব্যবস্থা করেন। কাজের ক্ষেত্রে আমাদের ওপর কোনো চাপ ছিল না। প্রথমে ঠিক হয়েছিল ছয় খণ্ডে ইতিহাসের দলিলপত্র বের হবে। কিন্তু আমরা এত তথ্য পেয়েছি যে ছয় খণ্ডে কুলাল না। আমি হাসান ভাইকে বললাম, সরকার ইতিহাস লিখতে পারে না। আমরা তথ্যগুলো সংগ্রহ করে রাখি। পরবর্তীকালে ১৫ খণ্ডে সেটি বের হয়। যদিও দলিলে সাধারণ মানুষের কথা আসেনি, এ জন্য এ প্রকল্প নিয়ে আমার একটা অসন্তুষ্টি ছিল। ফলে পরে মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক ইতিহাস, গ্রামের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা শুরু করি।

প্রশ্ন :

ইতিহাসের দলিলপত্র সংগ্রহের জন্য আপনারা গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন। অভিযোগ আছে, আপনারা সবার দলিল নেননি। প্রকৃত ঘটনা বলবেন কি?

আফসান চৌধুরী: দলিলপত্র নিইনি এই অভিযোগ ঠিক নয়। আমরা যা পেয়েছি, নথিভুক্ত করে প্রত্যয়ন কমিটির কাছে জমা দিয়েছি। তারাই ঠিক করেছে কোনটা গ্রন্থভুক্ত করবে, আর কোনটা করবে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করার ছিল না। অনেকে অনেক কিছু বলে কিন্তু আমরা তো সব দলিল পাইনি। আবার অনেক দলিল পেয়েছি। দেশের বাইরে ভারত থেকে পেয়েছি, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে পেয়েছি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মুজিবনগর সরকারের দলিলগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়। আবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দলিলের লগবুকে একটা তালিকা পেলেও দলিলগুলো পাইনি। এমভি স্যান্দ্রা নামে একটি জাহাজে অনেক দলিল এসেছিল, পরে যার হদিস মেলেনি। সরকারের যেসব দলিল পাওয়া গেছে, তা নিয়েছি। এরশাদ আমলে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। যে ভবনে দলিলগুলো ছিল, আটাশির বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মওদুদ আহমদ সেগুলো জাতীয় জাদুঘরে হস্তান্তর করতে ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো এখনো অযত্নে পড়ে আছে বলে ধারণা করি।

প্রশ্ন :

শুরুতে ইতিহাসচর্চার কথা বলছিলেন। গবেষক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে দেখা আর শিক্ষক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে দেখা, বিষয়টা কেমন?

আফসান চৌধুরী: ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস পড়াতে গিয়ে ৬০ বছরে এসে আমি মূলত শিক্ষিত হয়েছি। কারণ কী? আমরা সবাই আসলে খণ্ডিতভাবে ইতিহাসটাকে পড়ি। তো, একটা কোর্স আমাকে পড়াতে হতো। সেখানে দুই হাজার বছরের ইতিহাস ছিল। মুক্তিযুদ্ধ তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেটি ছিল বিশাল একটা বিষয়। ইতিহাস নিয়ে তখন আমার পুরো ধারণাই বদলে গেল। তখন এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ইতিহাস আমার কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে যায়। এখন আমরা কী করি? শেখ মুজিবুর রহমান কী করেছেন, মাওলানা ভাসানী কী করেছেন, জিয়াউর রহমান কী করেছেন—এসবই তখন ইতিহাস হয়ে যায়। এখন দুই হাজার বছরের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে যে চর্চাটা হয়, সেটি তখন আর ব্যক্তিনির্ভর থাকে না। এভাবে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস শিক্ষা না হলে শিক্ষার্থীরা তৈরি হয় না। সে তখন বুঝতে পারবে না, কোনটা থেকে কী হলো, কেন হলো, কীভাবে এল।

প্রশ্ন :

কিন্তু এ ভূখণ্ডের ইতিহাস নিয়ে এখানে যে গবেষণা হয়েছে, তার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এমনকি পাকিস্তানে তার চেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে।

আফসান চৌধুরী: শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বলি। আমরা যখন চার খণ্ড নিয়ে কাজ করছিলাম, তখন আড়াই হাজার বই পেয়েছিলাম। একাত্তরের ওপরে এখন হয়তো ১০-১২ হাজার বই হয়েছে। সংখ্যার দিকে অনেক বেশি মনে হলেও সেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে আমার মতে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে আমরা বিদেশি বইয়ের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করেছি। সেগুলোর ওপর আমরা অনেক বেশি বিশ্বাস করেছি। কিন্তু সেগুলো তলিয়ে দেখেনি। তবে আমি যেখানে যা পেয়েছি, সেটির খোঁজ নিতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়েছি। এমন অনেক কিছু নিয়ে ছয় মাস ধরে ঘুরে ঘুরে একটি টিভি চ্যানেলের জন্য আমি ১৬ পর্বের একটি সিরিজও তৈরি করেছিলাম। তা আর সম্প্রচারিত হয়নি। আমরা যেহেতু ইতিহাসটাকে রাজনৈতিকভাবে নির্মাণ করে ফেলেছি, সেখান থেকে আমরা এখন সরব না। তার মানে হচ্ছে, ইতিহাসচর্চা এখন ব্যক্তিপর্যায়েই হবে। জাতীয়, রাষ্ট্রীয়, সামাজিকভাবে ইতিহাসচর্চা থেকে আমরা এখন অনেক দূরে সরে এসেছি। এখন মানুষ যদি সন্ধান করতে চায়, তাহলে এ জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে। কিন্তু মানুষের তো এ নিয়ে কোনো আগ্রহই নেই।

প্রশ্ন :

এখানে যে গণহত্যা হয়েছে, সেটি তো আন্তর্জাতিকভাবে এখনো স্বীকৃতি পায়নি। এখানে আমাদের ব্যর্থতা কোথায়? 

আফসান চৌধুরী: এর জন্য আসলে এখানে যে গণহত্যা হয়েছে, তা আমাদের প্রমাণ করতে হবে। সেটি কিন্তু কঠিন কিছু না। আমি আমার বইয়ে অনেক প্রমাণ দিয়েছি। অনেকগুলো জায়গায় একেবারে নিজে গিয়ে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছি। এখন আমার মতে গণহত্যার চেয়েও গণনির্যাতন প্রমাণ করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নির্যাতনটা যখন গণহারে গোটা জনগোষ্ঠীর ওপর হয়, সেখানে হত্যাটা আর বড় থাকে না। আমি যখন ১৯৯৮ সালে সোহাগপুর গণহত্যা নিয়ে কাজ করছিলাম; তখন অবাক হলাম, এত দূর এল কী করে পাকিস্তানিরা। আমাদেরই তো যেতে প্রায় সারা দিন লেগে গেল। তো, সেখানে যেটি হয়েছে, প্রতিটি ঘরের প্রত্যেক পুরুষকে হত্যা করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে খেয়াল করলাম, সেখানকার মানুষের জীবন এত কষ্টের! আমার ভিডিওতে একজন মহিলাকে দেখিয়েছি। তার বড় কষ্ট হলো স্বামী ও ছেলেকে দুজনকেই মেরে ফেলা হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে একটা গর্ত করে কোনোভাবে কবর দিয়েছে, গোসলও দিতে পারেনি। গণহত্যার ভয়াবহতা বোঝাতে দেখাতে হবে এসব মানুষকে। রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার যোগীষুপালসা নামে একটা গ্রামে আমরা গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছি, ভিডিও করেছি। সেখানে পাকিস্তানিরা গ্রামের সব পুরুষকে ডেকে নিয়ে গিয়ে, হিন্দু ও মুসলমানকে আলাদা করেছে। তারপর প্রত্যেক হিন্দুকে গুলি করে মেরেছে। তারপর মুসলিমদের বলেছে মাটি খুঁড়ে কবর দিতে। এরপর যে বর্ণনাটা আমার সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ লেগেছে, তা হলো সেই কবরের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রস্রাব করেছে। রিফিউজি ক্যাম্পে কী অবস্থা হয়েছিল মানুষের? ওই গ্রামেরই এক মেয়ে বলেছিল, তার একটামাত্র শাড়ি ছিল। উলঙ্গ অবস্থায় বাচ্চা প্রসব করেছে সে। এ রকম তো অসংখ্য ঘটনা আছে, সেগুলো ডকুমেন্ট করে তো প্রমাণ করা যায়।

প্রশ্ন :

এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের উদ্যোগটা কে নেবে? সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কেউ?

আফসান চৌধুরী: আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না, আন্তর্জাতিক কোনো স্বীকৃতির দরকার আছে। এখানে গণহত্যা হয়েছে, এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে অনেকে এই স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। এখন এর জন্য সরকার অন্তত দশটা প্রমাণ উপস্থাপন করুক। দশটা প্রমাণ তো অবশ্যই পাওয়া যাবে। আরও অনেক প্রমাণ পাওয়া যাবে, কিন্তু ৫০ বছর পার হয়ে গেছে, বেশির ভাগ মানুষ তো মারাই গেছে। অনেক তথ্য চলে গেছে। কপালগুণে আমি এই জীবনে যতটা তথ্য সংগ্রহের দরকার, তা আমি করে ফেলেছি। আমি আর পারব না। আমি চাইলে এখনো কিছু তথ্য দিতে পারব। তবে সংখ্যাগত কোনো তথ্য দিতে পারব না। সংখ্যাগত প্রমাণ করতে চাইলে সরকারকেই করতে হবে। তবে সেটার দরকার নেই বলে মনে করি। গণহত্যা প্রমাণের জন্য সংখ্যার প্রয়োজন হয় না। এখনো প্রমাণ করা যাবে এবং সহজে পারা যাবে।

প্রশ্ন :

আপনি গ্রামের একাত্তর মানে সাধারণ মানুষ নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের যে ত্যাগের বিনিয়মে আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র পেলাম, সেই সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কি পরিবর্তন হয়েছে?

আফসান চৌধুরী: একাত্তরে সাধারণ মানুষের ইতিহাস হচ্ছে বিদ্রোহের ইতিহাস। এটা আমাদের ইতিহাসচর্চায় নেই। এটি শুরু ব্রিটিশ আমলের কৃষক বিদ্রোহ থেকে। কৃষক কোনো সরকার বা রাষ্ট্র বোঝেন না, তিনি বোঝেন তাঁর পেটে টান পড়েছে। তিনি যখন দেখেন তাঁর ধান ও মেয়ের ওপর হাত পড়েছে, তখন তিনি তো আর আপনার পক্ষে থাকবেন না। তখন তিনি বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। ২০১৮ সালে এক গ্রামে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে এক ব্যক্তিকে পেয়েছিলাম, রাজাকারদের মেরেছেন তিনি। যিনি একাত্তরেও কামলা ছিলেন, এখনো কামলা। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে আমার সমাজে ডেটা অনুযায়ী, যেহেতু আমি গবেষণা করি, আজকের দিনে সাধারণ মানুষ উন্নত হয়েছে। তবে ওরা শহরের মানুষকে ও সুশীল সমাজকে পাত্তা দেয় না। হ্যাঁ, কিছু মানুষ এখানে দরিদ্র আছে। এখন যে প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্রের কথা আমরা বলি, তার গণ্ডি খুব সীমিত। সাধারণ মানুষেরা সেই রাষ্ট্রের বাইরে বসবাস করে। তাদের কাছে এই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব দুর্বল।

প্রশ্ন :

২০২৩ সালের মার্চে বসে একাত্তরের মার্চকে কীভাবে দেখেন?

আফসান চৌধুরী: একাত্তরের মার্চ তো অনেক বিস্তৃত। ১ মার্চ যা ঘটল, তাতে মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারপর এল ৭ মার্চ। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে আমি ছিলাম না। আমার ভাই টেপরেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিল। সে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করে নিয়ে এসেছিল। আমার কাছে ২৬ মার্চের গোলাগুলিরও টেপ রেকর্ড ছিল। সব হারিয়ে গেছে। তো, তখন আমরা বুঝছিলাম না, কী হতে যাচ্ছে। স্বাধীন হব কি হব না, সেটি সাধারণ মানুষের কাছে ভাসা–ভাসা ধারণা হিসেবে ছিল। তবে রাজনৈতিকভাবে যাঁরা সক্রিয় ছিলেন, তাঁরা বলতেন, আমরা প্রস্তুত আছি। দরকার হলে আমরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে লড়ব। কিন্তু এখন তো বোঝা যায়, ও রকম প্রস্তুতি কারোরই ছিল না। একটি সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়ার প্রস্তুতি কেবল আরেকটা সেনাবাহিনীই নিতে পারে। যেটা আমরা দেখি, পিলখানা ও রাজারবাগে। সেটি ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বাহিনীর মুখোমুখি হওয়া। তবে এপ্রিল মাসে এসে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শক্তি একত্র হয়ে যায়। একত্র হয়ে লড়েছে। এটিই মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে স্বর্ণকাল। বীরত্বের কথা যদি বলতে হয়, সেটি হচ্ছে এই একত্র হয়ে যাওয়াটা। এরপর মুজিবনগর সরকার হচ্ছে, আরও আরও ঘটনা ঘটছে। তো, সাধারণ মানুষের কথা এ জন্য আসা উচিত, তাদের বীরত্বের কথা ভুলতে ভুলতে এখন যেটা হয়েছে, অনেক কিছু পাওয়া যায়, কিন্তু তথ্যভিত্তিক নয়। এখন ইতিহাসচর্চার এই অসুখ কে সারাবে? আমাদের মতো মানুষেরা চলে যাওয়ার পর কেউ হয়তো সারাবে না। পরে যা হবে, ওই সব বয়ানের ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারবে না।   

প্রশ্ন :

আপনাকে ধন্যবাদ।

আফসান চৌধুরী: আপনাদেরও ধন্যবাদ।