মার্কিন চিন্তাবিদ রবার্ট রটবার্গের বয়স এখন ৯০। তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও বিশ্ব শান্তি ফাউন্ডেশনের দীর্ঘদিনের সভাপতি। জীবনের বড় সময়ই তিনি কাটিয়েছেন আধুনিক জাতিরাষ্ট্র কেন ব্যর্থ হয়—এই প্রশ্নে গবেষণায়। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হোয়েন স্টেটস ফেইল; কজেস অ্যান্ড কনসিকুয়েন্সেস। অর্থাৎ যখন জাতিরাষ্ট্র ব্যর্থ হয়, তার ফলাফল কী দাঁড়ায়।
২০০৪ সালে প্রকাশিত সেই গ্রন্থে রটবার্গ লিখেছিলেন, জাতিরাষ্ট্র ব্যর্থ হয় তখনই, যখন সে নিজের মৌলিক দায়িত্ব পালন করতে পারে না, অথবা তা পালনে করতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে। এই সব মৌলিক দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং জনগণের জন্য প্রাথমিক রাজনৈতিক অধিকার ও সেবা প্রদান করা।
আজকের বাংলাদেশ দ্রুত একটি ব্যর্থ জাতিরাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে, কারণ তার ওপর যে মৌলিক দায়িত্ব আরোপ করা হয়েছে, তার কোনোটাই সে পূরণে সক্ষম নয়। অথবা আরও স্পষ্ট করে বলি, সে দায়িত্ব পালনে সম্ভবত সে আদৌ ইচ্ছুক নয়। বাংলাদেশ নিয়ে এমন কঠোর ও হৃদয়বিদারক কথা আমি কখনো বলিনি, বলব সে কথাও ভাবিনি। গত কয়েক দিনের ঘটনা আমাকে এই কথা ভাবতে বাধ্য করেছে। কারণ হিসেবে আমি চারটি ঘটনার কথা বলব।
এক.
শরিফ ওসমান হাদির হত্যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই হত্যার আগাম সংবাদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে ছিল না, এমন দাবি তারা করতেই পারে। কিন্তু সে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পনেরো দিন পরও কেন হত্যাকারী ধরা পড়ল না? আমরা ইন্টারনেটে দেশি-বিদেশি সূত্র থেকে সে হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তাবৎ ঠিকুজিকুষ্টি জেনে বসে আছি অথচ এখনো দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অন্ধকারে ঘুষি ছুড়ছে।
শোনা যাচ্ছে, প্রধান খুনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। কীভাবে, কার বাহনে, কার প্রহরায়? কেউ কেউ বলছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সম্মতি ও সমর্থনেই তাঁদের দেশ ছেড়ে পালানো সম্ভব হয়েছে। এ কথা সত্যি হলে আমরা তো অনায়াসেই বলতে পারি, রাষ্ট্র তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে শুধু ব্যর্থ নয়, দায়িত্ব পালনে সে অনাগ্রহীও বটে।
এই ব্যর্থতা আমাদের নিয়তি নয়। দেশটা আমাদের সবার। তা ব্যর্থ হোক, দেশি-বিদেশি চক্র তা চাইতে পারে, কিন্তু আমরা তা চাইব কেন? এই অবনমন ঠেকানোর ক্ষমতা আমাদের রয়েছে, কিন্তু সে জন্য চাই ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে নাগরিক ঐক্য। ইতিমধ্যে দেখেছি মবতন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্যের একটি প্রাথমিক উদ্যোগ এসেছে। আপাতত উদ্যোগটি নাগরিক ও সুশীল সমাজ পর্যায়ে প্রতিবাদে সীমিত, এই প্রতিবাদ কার্যকর হতে হলে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ প্রয়োজন। শুধু প্রতিবাদ নয়, চাই জবাবদিহি।
দুই.
ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় অথবা সে হত্যাকাণ্ডকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের দুটি প্রধান সংবাদপত্রের কার্যালয়ে হামলা হয়েছে। কার্যালয় দুটি আগুন দিয়ে আংশিক জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। একাধিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর হয়েছে। এই কাজে যাঁরা নেতৃত্ব দেন; যাঁদের অশুভ চক্র বা উগ্রবাদী নামে বর্ণনা করা হচ্ছে, তাঁরা সংবাদপত্র দুটির ভবন জ্বালিয়ে দেওয়াতেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, সম্ভবত তাঁরা এই দুই দপ্তরে কর্মরত সাংবাদিকদের পুড়িয়ে মারতেও চেয়েছিলেন।
আক্রান্ত হওয়ার পর ভবনে আটকে পড়া একজন সাংবাদিক ফেসবুকে জানিয়েছেন, চারদিকে আগুনের ধোঁয়ায় তাঁর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এখন আমরা জানি, একজন দুজন নয়, বিপুলসংখ্যক উন্মত্ত জনতা খুব পরিকল্পিতভাবে এতে অংশ নিয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলে পুরো ঘটনা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে, বিদেশে বসে আমরাও তা দেখেছি। সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সরকারি কর্তৃপক্ষ জানতেন না, সেটাও নয়। শুরু থেকেই পত্রিকা দুটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারপরও কেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হলো না?
এই প্রশ্নের দুটির সম্ভাব্য উত্তর অধ্যাপক রবার্ট রটবার্গ কুড়ি বছর আগেই দিয়ে রেখেছেন: যাদের সে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল, তারা হয় সে দায়িত্ব পালনে সক্ষম নয়, অথবা তা পালনে আগ্রহী নয়।
এমন অভাবিত ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে শুকনা দুঃখ প্রকাশ ছাড়া একজনও তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেননি, সে জন্য ক্ষমা চাননি। পদত্যাগের তো প্রশ্নই উঠছে না। শাসক মহল যদি দায়িত্ববান হতো, তাহলে এই ব্যর্থতার দায়ভার তাঁদের কেউ না কেউ মাথায় পেতে দায়িত্ব থেকে সরে যেতেন।
ফুটবল খেলার মাঠে উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস পদত্যাগ করেছেন।
২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলা রোধে ব্যর্থতার জন্য ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরাজ পাতিল পদত্যাগ করেছিলেন। ২০১৯ সালে ইস্টারের রোববার বোমা হামলা রোধে ব্যর্থতার জন্য শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রধান পুজিথ জায়াসুন্দ্রা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে ভয়াবহ ফেরি দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী চুং হন-ওয়ান শুধু হাঁটু মুড়ে ক্ষমাই চাননি, পদত্যাগ করে দায়িত্ব থেকে সরেও গিয়েছিলেন।
দায়িত্ব পালনে এই ব্যর্থতা অথবা অনাগ্রহের একটা ফল হলো, এতে সব ধরনের সহিংসতা ‘নরমালাইজড’ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ঠিক সে ঘটনাটাই ঘটেছে। মবতন্ত্র এখন আর অভাবিত কোনো ব্যাপার নয়, নিয়মিত ব্যাপার। আর যাঁরা এই সহিংসতাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চান, তাঁরা সরকারের তরফ থেকে এই স্পষ্ট সিগন্যাল পেয়ে যান যে সহিংসতা যত তীব্র হোক না কেন, উদ্বেগের কিছু নেই।
তিন.
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন ডিন একযোগে তাঁদের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। না, স্বেচ্ছায় নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদেরএকজন নেতা প্রকাশ্যে এই ছয়জনের নাম উল্লেখ করে তাঁদের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি ছয় অধ্যাপকের অফিসে গিয়ে তালা লাগিয়ে আসেন। অধ্যাপকদের ‘অপরাধ’, তাঁরা বিগত সরকারের সমর্থক ছিলেন। ঠিক এই অভিযোগে শিক্ষকদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে, এমন আইন কোথায় লেখা আছে, আর এই সিদ্ধান্ত ছাত্র সংসদের এক ছাত্র তাঁর অনুগত সমর্থকদের জোরে বাস্তবায়িত করবেন, সে নিয়মই–বা কবে থেকে বহাল হলো?
বলাই বাহুল্য, বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারের কেউ এ ব্যাপারে তাঁদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেননি। হয় তাঁরা সে দায়িত্ব পালনে অক্ষম অথবা অনাগ্রহী।
চার.
ময়মনসিংহের ভালুকায় দীপু দাস নামের এক কারখানা শ্রমিককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সত্যি কোনো অবমাননা হয়েছে বা কী সেই অবমাননা, তার কোনো সদুত্তর নেই। হত্যার পর দীপু দাসের লাশ বিবস্ত্র করে একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এই অবিশ্বাস্য বর্বরোচিত কাজটি চোখের পলকে ঘটে যায় তা নয়, বেশ লম্বা সময় ধরে ঘটেছে। কয়েক শ লোক সেটা প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন, পুলিশ কোথায়, কারখানা কর্তৃপক্ষ কোথায়, স্থানীয় সরকারি প্রশাসনই–বা কোথায়? নেই, হয় তারা দায়িত্ব পালনে অপারগ, অথবা অনাগ্রহী।
রবার্ট রটবার্গ ব্যর্থ রাষ্ট্রের যে তিন লক্ষণ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন, ওপরের এই চার উদাহরণ থেকে স্পষ্ট যে বাংলাদেশ ক্রমে তেমন একটি রাষ্ট্রের পথে হাঁটছে। উদাহরণ বাড়ানো যায়, কিন্তু তাতে একই কথার পুনরাবৃত্তি হবে।
সত্যি সত্যি রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে তার নাগরিকদের কী দুর্দশা হয়, তা বুঝতে দয়া করে আজকের হাইতি, সোমালিয়া বা সুদানের দিকে তাকিয়ে দেখুন। স্বাধীনতার সাড়ে পাঁচ দশক পর আমরাও সেই একই মহাদুর্যোগে নিক্ষিপ্ত হব, সে কথা লিখতে আমার হাত কাঁপছে। কিন্তু এ কথা যে মোটেই অতিরঞ্জন নয়, তাতেও বড় কোনো ভুল নেই।
এই ব্যর্থতা আমাদের নিয়তি নয়। দেশটা আমাদের সবার। তা ব্যর্থ হোক, দেশি-বিদেশি চক্র তা চাইতে পারে, কিন্তু আমরা তা চাইব কেন? এই অবনমন ঠেকানোর ক্ষমতা আমাদের রয়েছে, কিন্তু সে জন্য চাই ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে নাগরিক ঐক্য। ইতিমধ্যে দেখেছি মবতন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্যের একটি প্রাথমিক উদ্যোগ এসেছে। আপাতত উদ্যোগটি নাগরিক ও সুশীল সমাজ পর্যায়ে প্রতিবাদে সীমিত, এই প্রতিবাদ কার্যকর হতে হলে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ প্রয়োজন। শুধু প্রতিবাদ নয়, চাই জবাবদিহি।
অধিকাংশ সভ্য দেশে এ–জাতীয় সংকটের সময় একাধিক ‘প্রেশার পয়েন্ট’ কাজ করে—যেমন আদালত, আইন পরিষদ, মানবাধিকার কমিশন ও সংবাদমাধ্যম। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম ছাড়া আর অন্য কোনো প্রেশার পয়েন্ট কার্যকর নয়। তার আশু সম্ভাবনাও নেই। অতএব সংবাদমাধ্যমকে একই সঙ্গে জাতির বিবেক ও জাতির পথপ্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমার বিশ্বাস, সে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা তার রয়েছে।
এক শ বছরের আগে, ১৯০৪ সালে জোসেফ পুলিৎজার মন্তব্য করেছিলেন, কোনো দেশের উত্থান ও পতন সে দেশের সংবাদপত্রের উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িত। সৎ, দক্ষ ও জনস্বার্থে নিবেদিত সংবাদপত্রের পক্ষেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে ভণ্ডামি ও প্রহসন থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
আমাদের সংবাদমাধ্যমের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ—দেশকে তারা ভণ্ডামি ও প্রহসনে নিক্ষেপ করবে, না তাকে বাঁচাতে জননৈতিকতাকে আয়নার মতো তুলে ধরবে? এর উত্তর তারাই দেবে, সে আশা করি।
হাসান ফেরদৌস সাংবাদিক
মতামত লেখকের নিজস্ব
