বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে এবারও অভিন্ন পরীক্ষাপদ্ধতি পুরোপুরি কার্যকর হবে কি না, এ নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কেননা, ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে। সবকিছু ঠিক থাকলে নভেম্বরের মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার কথা। এরপর ডিসেম্বর থেকে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য যেসব উদ্যোগ এখনই নেওয়া জরুরি, সেগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফলে ধারণা করা যায়, ‘সময় নেই’—এই অজুহাতে এ বছরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেবে।
এখন দেশে ৫৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১১৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজের মতো করে ভর্তি পরীক্ষা নেয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক ভর্তি পরীক্ষা হয়। এর বাইরে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সাড়ে আট শতাধিক কলেজ। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে অনেক আবেদন ফরম কিনতে হয়। এতে শুধু বিপুল অঙ্কের অর্থই ব্যয় হয় না, ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য তাঁদের সীমাহীন ঝক্কিও পোহাতে হয়।
শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে এক দশকের বেশি সময় ধরে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের প্রতিনিধিত্বশীল কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে এ প্রক্রিয়া পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে গুচ্ছভুক্ত হয়ে ১৮টি সাধারণ এবং ৪টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একক প্রশ্নে ভর্তি পরীক্ষা নেয়। এ ছাড়া ৩টি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট, কুয়েট ও রুয়েট) আরেকটি গুচ্ছে এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষিশিক্ষাভিত্তিক ৭টি বিশ্ববিদ্যালয় অপর একটি গুচ্ছে পরীক্ষা নিচ্ছে। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থীর অর্থের অপচয় কমেছে, তবে ভোগান্তি পুরোমাত্রায় দূর হয়নি।
তবে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আন্তরিকতার অভাব এবং সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর দরুন ভর্তির কাজ শেষ করতে দীর্ঘ সময় লাগছে। কীভাবে পুরো প্রক্রিয়া স্বল্পতম সময়ে শেষ করা যায়—এ নিয়ে চলতি বছরের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক সভায় একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, নতুন পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে পারলে এক মাসের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে। অবশ্য কোন প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা নেওয়া হবে, ধারণাপত্রে স্পষ্ট করা হয়নি।
সত্যি বলতে কি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে শুরু থেকেই অনাগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় মনে করে, নিজস্ব ভর্তিপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে অধিকতর মেধাবী শিক্ষার্থী বাছাই করা সম্ভব। তা ছাড়া ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য ও স্বায়ত্তশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, এ নিয়েও দ্বিধা রয়েছে তাদের। এর ওপর গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তিপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা তাদের আগ্রহ আরও কমিয়েছে। তবে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও শোনা যায়, সমন্বিত পরীক্ষাপদ্ধতির অংশ হয়ে তারা ভর্তি পরীক্ষার ‘অর্থ-বাণিজ্য’ থেকে বঞ্চিত হতে চায় না।
বলতে হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত ভর্তি কার্যক্রমের বিকল্প নেই। ইউজিসি এ বছরের এপ্রিল মাসের এক সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন পরীক্ষা নেওয়া হবে।
ওই সভায় শিক্ষামন্ত্রীসহ দেশের প্রতিনিধিত্বশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তখন বলা হয়েছিল, নতুন নিয়মে ভর্তি পরীক্ষা নিতে ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ) নামে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। এনটিএর সদস্য হবেন দেশের শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পরপরই এনটিএ কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার ব্যবস্থা করবে। কত নম্বরের পরীক্ষা হবে কিংবা পরীক্ষা কত ঘণ্টার হবে, এগুলো পরে ঠিক করা হবে। তবে একক ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে এ বছরেই।
এ লক্ষ্য থেকে ইউজিসির চেয়ারম্যান এবং উপাচার্যদের নিয়ে ১৫ সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির কর্তব্য নির্ধারিত হয়—এনটিএ গঠনের আগপর্যন্ত অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা নিশ্চিত করা। কমিটি গঠনের সময়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে একক আওতাভুক্ত করে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য একটি অধ্যাদেশ জারি করা হবে। বলা হয়, ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে যা-ই থাকুক না কেন, এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে।
মুশকিল হলো, প্রতিবছর এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার কথা জোরেশোরে শোনা যায়। কিন্তু তখন আর পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের সময় বা সুযোগ থাকে না। তাই সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কাঠামো ও পদ্ধতি এখনই প্রকাশ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিতে গিয়ে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।
তা ছাড়া ভর্তি পরীক্ষার আবেদন খরচও অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। লাখ লাখ আবেদনকারীর ফরম কেনার টাকার ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা করতে হবে কেন? আর কেনই-বা বাকি ৬০ শতাংশ টাকার ‘ভাগ–বাঁটোয়ারা’ নিয়ে টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় খবর হবে?
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক