১৫ আগস্ট: অতল গহ্বরের মুখোমুখি হওয়া

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

উনসত্তর থেকে একাত্তর—এক আশ্চর্য সময়। ছয় দফা থেকে শুরু করে এগারো দফার দাবিতে গণ-অভ্যুত্থান, সামরিক একনায়কের পতন, গণতন্ত্র-সমতা-সামাজিক ন্যায়বিচার আর মানবসত্তার মহিমা সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে একটি জাতির জন্ম, আর তার জীবনে বিরাট চড়াই-উতরাই। পাকিস্তানি শাসকদের হঠকারিতায় সাধারণ নির্বাচনের গণরায় বানচাল হওয়ার পর গণহত্যার প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা।

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে এল ১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের বিজয় দিবস। আনন্দ-বেদনায় মেশানো এ দেশের মানুষের সবচেয়ে গর্বের দিন। কিন্তু কোথায় যেন এক অপূর্ণতা। সেই অপূর্ণতার অবসান ঘটল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। যেদিন মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদী নেতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে এলেন। তাঁর চরম শত্রুরাও—যারা একটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার নৃশংস খেলায় মেতেছিল, যাদের সহিংসতার চিহ্ন তখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে—তারাও সাহস করেনি এই মানুষটার গায়ে একটি আঁচড় কাটতে; বরং বাধ্য হয়েছিল কোটি মানুষের প্রাণপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে তাঁর প্রিয় জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে।

শুরু হলো একটা নতুন জাতির পথচলা। জনগণের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা। সে প্রত্যাশা পূরণের উপায়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠার সময়-সুযোগ যেন ক্রমশই হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকল। ঘরে-বাইরে বৈরিতা। দেশ গড়ার নীতির ক্ষেত্রে যে অঙ্গীকার নিশ্চিত হয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করেছি, ঘুরেফিরে সেগুলোকেই আবার প্রশ্নবিদ্ধ করা হতে থাকল।

স্বাধীনতা অর্জনের তিন বছর পূরণ হতে না হতেই রাজনীতির নানা জটিলতার মধ্যে কোথায় কোথায় যেন ফাটলেরও সৃষ্টি হতে থাকল। জননেতা তখন রাষ্ট্রপতি। আমাদের সঙ্গে দেখা–সাক্ষাতের সুযোগ তখন একেবারেই সীমিত, যদিও তিনি আমাদের কাছে তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়িতেই থাকছিলেন। এরই মধ্যে ১৯৭৫ সালে জুলাইয়ের ২০ তারিখে পুত্র শেখ কামালের বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানে অন্তরঙ্গ পরিবেশে তাঁর সঙ্গে এক ঝলক দেখা। সেটাই তাঁকে শেষ দেখা।

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। উত্তেজনার শেষ নেই। কেমন হবে তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা, এসব আলাপ-আলোচনা শেষে বেশ রাত করে ঘুমাতে যাওয়া ১৪ তারিখে। ভোর পাঁচটার দিকে ভয়ংকর গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। সেই একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের মতো। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। হত্যা করতে চেয়েছিল এ দেশের মানুষের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাকেই। আজ শঙ্কা জাগে, যখন দেখি যাদের চেতনা বাংলাদেশের স্বরূপ সন্ধানে শাণিত নয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যাদের কাছে মূলত স্বার্থসিদ্ধির মূলমন্ত্র, রবীন্দ্রনাথের কথায় চতুর্দিকে তারাই আজকে ‘এসেছে ভক্ত সাজি’। ১৫ আগস্টের বেদনার সঙ্গে এই বেদনাও বুকে বাজে।

দৌড়ে গেটের কাছে গেলাম। আমাদের বাড়ির কয়েক গজ দূর থেকেই বিরাট এক ট্যাংক দিয়ে রাস্তা আটকে রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিক থেকে অনবরত গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এ ছাড়া চারদিকে অস্বাভাবিক নীরবতা। মা-বাবা, আমরা সবাই হতভম্ব। প্রায় সকাল দশটা পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারছি না। ভয়ানক কিছু একটা ঘটে গেছে বলে আঁচ করতে পারছি, কিন্তু কোনো পথ পাচ্ছি না খবর নেওয়ার। ৩২ নম্বর রাস্তা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ।

এক ফাঁকে একজন আত্মীয় এলেন মায়ের খবর নিতে। তঁার কাছেই প্রথম অবিশ্বাস্য নারকীয় ঘটনাটির কথা শুনলাম। আত্মীয়রা মায়ের জন্য আতঙ্কিত হয়েছিলেন। কারণ, শুধু বঙ্গবন্ধুকেই সপরিবার হত্যা করা হয়নি, লেকের অন্য পাড়ে শেখ ফজলুল হক মনির পরিবারকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অন্য আত্মীয়স্বজন এবং সহযোগীদেরও কারও কারও বাড়িতে আক্রমণ চালানো হয়েছে।

আত্মীয়টির কথায় রেডিওতে বিশেষ একটি চ্যানেল ধরলাম। সেখানে খুনিরা এই হত্যাকাণ্ডের ঘোষণা দিয়ে চলেছে। তখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, আমরা যা শুনছি তা সত্যি কি না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে বারবার চেনা মুখগুলো ভেসে উঠছে। প্রাণপণে ভাবতে চাইছি, যা শুনছি তা প্রকৃতপক্ষে ঘটেনি, ঘটতে পারে না। এ হয়তো সবাইকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলার জন্য শত্রুপক্ষের একটা কৌশল। যে মানুষটার মাথার ওপর পাকিস্তানি শাসকেরা বারবার ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়ে, কারাগারের সেলের সামনে কবর খুঁড়েও গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পায়নি, সেই মানুষটার দিকে তাঁরই দেশের মানুষ বন্দুক তাক করতে পারে—যে মানুষদের তিনি ভালোবাসায় আর বিশ্বাসে নিজের বলে জেনেছেন? এ–ও সম্ভব? খবরটা যখন সত্য বলে মেনে নিতে হলো, ভয়ানক এক বিপন্নতায় মনে হয়েছে এ যেন এক অতল গহ্বরের মুখোমুখি হওয়া। সেখান থেকে সরে দাঁড়ানোর সব শক্তি যেন কেউ শুষে নিয়েছে। এক অপমানিত অসহায়বোধে নিঃসাড় হয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই।

আরও পড়ুন

প্রায় অর্ধশতাব্দী কেটে গেছে সেই দিনটি থেকে। এখনো যেন তা থেকে উত্তরণ ঘটল না। দীর্ঘ ২০ বছরের সামরিক শাসন আর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ দেশের শাসনব্যবস্থায়, রাজনীতি ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, মেধায় ও মননে ভেদবুদ্ধি আর সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বিস্তার, মুক্তিযুদ্ধের নামে তার বিপরীত মূল্যবোধের কার্যকলাপের সমারোহ। গণতন্ত্রের অভিযাত্রাও যেন পথহারা ঘুরপাকে বিপর্যস্ত। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। হত্যা করতে চেয়েছিল এ দেশের মানুষের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাকেই। আজ শঙ্কা জাগে, যখন দেখি যাদের চেতনা বাংলাদেশের স্বরূপ সন্ধানে শাণিত নয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যাদের কাছে মূলত স্বার্থসিদ্ধির মূলমন্ত্র, রবীন্দ্রনাথের কথায় চতুর্দিকে তারাই আজকে ‘এসেছে ভক্ত সাজি’। ১৫ আগস্টের বেদনার সঙ্গে এই বেদনাও বুকে বাজে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

সুলতানা কামাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; মানবাধিকারকর্মী