নিউইয়র্কের মেয়রকে উপদেশ দিলে কি পানিতে পড়তে হবে

নিউইয়র্ক দেবে যাচ্ছে ভবনের ওজনে। নিউইয়র্কে বসে এই খবর পড়ছি প্রথম আলো ডটকমে। বেপরোয়া খাওয়াদাওয়া করে যেভাবে গত কয়েক দিনে নিজের ওজন বেধড়ক বাড়িয়েছি, তাতে সন্দেহের আঙুলটা প্রথমে উঠল নিজের দিকেই।

অপরাধবোধ হতে লাগল, নিউইয়র্ক শহরের দেবে যাওয়ার জন্য যেন আমিই দায়ী। তারপর, ‘ভবনের ওজন’ কথাটা ভালোভাবে পড়ে নিজেকে ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু নিউইয়র্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে খানিকটা শঙ্কা যে বোধ করছি না, তা বলব না।

এই শহর গগনচুম্বী ভবনের জন্য বিখ্যাত। প্রতিবছর নাকি দেবে যাচ্ছে এক মিলিমিটার থেকে দুই মিলিমিটার। আর ১৯৫০ সাল থেকে ৭২ বছরে এই শহর ঘেঁষে থাকা সমুদ্রের উচ্চতা বেড়েছে ৯ ইঞ্চি বা ২২ সেন্টিমিটার। আর্থ ফিউচার জার্নাল–এ বলা হয়েছে, ‘জলমগ্নতার কারণে নিউইয়র্কে ঘন হয়ে বসবাস করা ৮৪ লাখ মানুষ নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।’

আরও পড়ুন

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামস খুবই নাগরিকবান্ধব। কৃষ্ণকায় এই মানুষ সিটি অফিসে নিয়োগ দিচ্ছেন হাজার হাজার নাগরিক। তিনি নিজে রাস্তায় নেমে সিটির খালি থাকা পদগুলোয় লোক নিয়োগ দিচ্ছেন। আমি তাঁর জন্য খানিকটা উদ্বিগ্ন। ভাবছি, তাঁকে কিছু উপদেশ দেব। বলব, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আপনারা গাছ কাটবেন না। গাছ লাগান। সবুজ জ্বালানি ব্যবহার করুন। কার্বন নিঃসরণ কমান।

অযাচিত উপদেশ পেয়ে মেয়র কি খেপে যাবেন? গেলে যাবেন। নিউইয়র্কের মেয়র আমাকে হাডসন কিংবা ইস্ট রিভারের পানিতে চুবাতে চাইলে চুবাবেন। আমি কি ভয় পাই নাকি!

একজন রুশ, আরেকজন আমেরিকান বাহাস করছেন। আমেরিকান বললেন, ‘আমি হোয়াইট হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারব, বাইডেন, আমি তোমার শাসন পছন্দ করি না। তুমি ক্রেমলিনের সামনে দাঁড়িয়ে এ কথা বলতে পারবে?’

রুশটি বললেন, ‘কেন পারব না? আমি ক্রেমলিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলব, বাইডেন, আমি তোমার শাসন পছন্দ করি না।’

আরও পড়ুন

এবার নিউইয়র্কে দুই বাংলাদেশি বাবার গল্প বলি। জেএফকে বিমানবন্দরে নেমেছি। আমার স্ত্রী হুইলচেয়ার বলে রেখেছিলেন। প্লেন থেকে নামার পর হুইলচেয়ার নিয়ে যিনি এলেন, তিনি এসেই সালাম দিলেন। বললেন, ‘ভাই, কেমন আছেন?’ দেশি ভাই পেয়ে আমিও খুশিই হলাম। তিনি মেরিনার হুইলচেয়ার ঠেলতে লাগলেন। ইমিগ্রেশন পার হয়ে আমরা গেলাম লাগেজ নিতে। এই প্রবীণ ভদ্রলোক নিজে ছয় ডলার খরচ করে আমাদের জন্য ট্রলি নিয়ে এলেন। নিজে স্যুটকেস টানাটানি করতে লাগলেন।

আমি তাঁকে কিছু বকশিশসহ ছয় ডলার ফেরত দিতে গেলাম। তিনি বললেন, ‘আনিস ভাই, আমি আপনার জন্য এই সামান্য উপহার দিতে পারব না?’ এরপর বললেন, ‘আমি বাংলাদেশে একটা ব্যাংকে জিএম ছিলাম। অবসর নিয়েছি। আমার দুই ছেলে। এক ছেলে সিঙ্গাপুরে পিএইচডি করছে। পিএইচডি শেষ হলে সে আমেরিকায় চলে আসবে। আমার দ্বিতীয় রিটায়ারমেন্ট শুরু হবে। আরেক ছেলে ঢাকায় বড় চাকরি করছে। সে–ও চলে আসবে।’

আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। তাঁর গায়ে সিনথেটিকের জ্যাকেট। তাতে একটা চুমু দিলাম। আমার চোখ ছলছল করতে লাগল।

আরও পড়ুন

আরেক বাবাকে পেলাম নিউইয়র্কের বাঙালি পাড়া জ্যাকসন হাইটসের এক বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে। এক প্রবীণ ভদ্রলোক একা বসে নুডলস খাচ্ছেন। পাশের টেবিলে বসে তিনি আমাদের গল্পের মধ্যে অংশ নিতে লাগলেন।

আমি বললাম, ‘আপনি এত বাঙালি খাবার রেখে নুডলস খাচ্ছেন কেন?’

তিনি বললেন, ‘ভাত তো বাসায়ই আছে। রোজই খাই।’

—আপনার বাসায় কে আছেন?

—আমার স্ত্রী। আমার ছেলে আর ছেলের বউ থাকে সিয়াটলে। বুয়েট থেকে পাস করেছে। আমাকে আর ওর মাকে এনে নিজের কাছে রেখেছিল তিন বছর। আমাদের গ্রিন কার্ড আছে। তারপর একদিন প্লেনের টিকিট কেটে আমাদের দুজনকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।

—তারপর?

—তারপর আমরা আবার চলে এসেছি। নিউইয়র্কে বাসা নিয়েছি। আমার ছেলে চায় না যে আমরা তার কাছে থাকি।

—কেন চায় না? তিন বছর তো রেখেছিল!

—আপনি আপনার ওয়াইফের কথা শোনেন না?

—শুনি।

—আমিও আমার ওয়াইফের কথা শুনি। আমার ছেলেও তার ওয়াইফের কথা শোনে। ভদ্রলোক বললেন। তারপর বলতে লাগলেন, ‘কী খাবেন খান! মিষ্টি খান। জিলাপি খান।’

—না না, আমরা খেয়েছি। আপনি দেশে না থেকে নিউইয়র্কে থাকছেন কেন?

—কারণ, আমার ছেলে এই দেশে থাকে। নাহয় তার সঙ্গে আমার প্রতিদিন দেখা হয় না। তবু এখন অন্তত আমরা একই দেশে থাকছি। সময়ের পার্থক্যটা অন্তত দিন আর রাত নয়।

—আচ্ছা, শোনেন, বাংলাদেশের নির্বাচনে কিন্তু বাধা সৃষ্টি করবেন না। সহিংসতা করবেন না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেবেন না। যদি এসব করেন, তাহলে আপনাকে কিন্তু আর আমেরিকান ভিসা দেওয়া হবে না।

‘আমার গ্রিনকার্ড!’ বলে তিনি হাসতে লাগলেন! বললেন, ‘আমি কীভাবে নির্বাচনে বাধা দেব? আমি তো বাংলাদেশে আপাতত যাচ্ছি না। আর শোনেন, যাঁদের এসব করার ক্ষমতা আছে, তাঁদের আমার মতো আমেরিকায় এসে থাকতে হয় না। ভিসা না পেলে তাঁদের কী ক্ষতি! ক্ষমতা থাকলে ভিসা লাগে না। ভিসাপ্রার্থীদের ক্ষমতা থাকে না।’

আমি তাড়াতাড়ি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। কী বলতে কী বলে ফেলেন! নিউইয়র্কের রেস্টুরেন্টের দেয়ালেরও তো কান থাকতে পারে।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক