ফ্রান্স ও জার্মানির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপের চালিকা শক্তি। এ সম্পর্কই ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা, একক মুদ্রা চালুসহ অনেক কিছুর ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই সম্পর্কেই ফাটল ধরেছে। গত দুই বছরে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ও অনৈক্য চূড়ায় পৌঁছেছে। এমানুয়েল মাখোঁ দ্ব্যর্থহীনভাবে এই প্রজন্মের সবচেয়ে বড় ইউরোপ-অন্তপ্রাণ প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের জোট সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ফেডারেল রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি কিছু মনে করে না।
ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আরও বিভক্তি তৈরি হোক, সেটা কারও কাছেই প্রত্যাশিত নয়। ভূরাজনীতির জন্য মহাবিপদের এই সময়টাতে এ ধরনের বিভক্তি ইউরোপকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে শলৎজ খুব বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এটি একটি বাঁকবদল বিন্দু। তখন তিনি জার্মানির সংযমী পররাষ্ট্রনীতি অবসানের কথাও তিনি জোরেশোরে বলেছিলেন। তাঁর এই বক্তব্য ইউরোপে একটি সমন্বিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পথ দেখাতে পারত। কিন্তু বাস্তবে অর্থপূর্ণ কিছুই ঘটেনি। বরং, ফ্রান্স-জার্মানির বেশ কয়েকটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়তে বসেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে ইউরোপের দেশগুলো একই সুরে গলা মেলানো সত্ত্বেও মহাদেশটির জন্য একটি স্বনির্ভর কৌশলনীতি প্রণয়ন করা যায়নি। ভূরাজনৈতিক সংকট এখন ইউরোপ ঘিরে ধরেছে। ধরন ও বিষয়বস্তু—দুই দিক থেকেই ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়ছে। উদাহরণ হিসেবে, মাখোঁর নিজেকে জাহির করার বিষয়টিকে জার্মানি অবজ্ঞার চোখে দেখছে। অন্যদিকে জার্মানি ধীরে ধীরে আরও জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠছে।
ইউরোপের আকাশ সুরক্ষিত রাখতে ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যকার পরবর্তী প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরির প্রকল্পটি প্রায় মরতে বসেছে। প্রথমত, এর কারণ হলো জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কিনছে। টাইমস–এ এই খবর বেরিয়েছে যে ফ্রান্সের সঙ্গে প্রকল্পটি পুরোপুরি বাতিল করে দিতে পারে জার্মানি। ইতালি ও জাপানের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের যে টেম্পেস্ট যুদ্ধবিমান প্রকল্প রয়েছে, সেটিতে যুক্ত হতে পারে জার্মানি। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে ফ্রান্সের জন্য হবে বড় ধাক্কা।
ফ্রান্সের নেকটার ও জার্মানির কেএমডব্লিউর মধ্যে পরবর্তী প্রজন্মের ট্যাংক উন্নয়নের প্রকল্পটিও ধীরে ধীরে ভেস্তে যেতে বসেছে। ফ্রান্স ও জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে যৌথ উদ্যোগে ট্যাংক উন্নয়ন করতে গেলে কমপক্ষে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর জার্মানির সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা কর্মসূচি হলো ইউরোপিয়ান স্কাই শিল্ড (ইউরোপের আকাশ সুরক্ষা)। ইউক্রেনে রাশিয়ার বিমান হামলার প্রেক্ষাপটে ইউরোপের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করার চিন্তা করা হয়েছে। কিন্তু ফ্রান্সকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জার্মানি এই প্রকল্প এগিয়ে নিচ্ছে।
জ্বালানি নীতির ক্ষেত্রে ফ্রান্স ও জার্মানির ভেতর মতভেদ বাড়ছে। আর এই উত্তেজনা ইউরোপের জ্বালানি ও জলবায়ু নীতিকে পেছনে টেনে ধরছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন নিয়ে সমস্যায় পড়লে জার্মানি সাধারণত ফ্রান্স থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করে। কিন্তু ২০২২ সালের গ্রীষ্মে ফ্রান্সের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা দেখা দেওয়ায় ঠিকমতো বিদ্যুৎ পায়নি জার্মানি। এর ফলে জার্মানির অর্থনীতিতে অস্তিত্বগত হুমকি তৈরি হয়েছিল। এ কারণে ফ্রান্সের পারমাণবিক নীতির ওপর জার্মানির অবিশ্বাস জন্ম হয়।
জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে উত্তেজনার কিছু ব্যাখ্যা এগুলো। কিন্তু পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হওয়ার আশা এখানে অল্প। মাখোঁ ও শলৎজ দুজনের সম্পর্ক ব্যক্তিগত অবিশ্বাসের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই ইউরোপের প্রতিযোগী দেশ দুটি জাতীয়তাবাদী অবস্থানের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা গেল ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জো বাইডেনের মূল্যস্ফীতি হ্রাস আইনের পর ফ্রান্স ও জার্মানির প্রতিক্রিয়ায়।
চূড়ান্ত অর্থে ফ্রান্স ও জার্মানি যা ভাবছে, পুরোপুরি তার বিপরীতে একটা স্বনির্ভর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলাটাই হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব থেকে ইউরোপকে বের করে আনার পথ।
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
● শাহিন ভ্যালি জার্মান কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশন্সের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো