বিএনপি কি চেয়ে চেয়ে দেখবে

৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর জন্য আওয়ামী লীগ যে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার দুয়ার খুলে দিয়েছিল, সেটি এখন আর বন্ধ করতে পারছে না। আগে স্থানীয় রাজনীতির চাবিকাঠি ছিল জেলা–উপজেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে। এখন কমিটি কেউই নয়। নৌকা কিংবা স্বতন্ত্র—যেকোনো পরিচয়ে নির্বাচন করে যিনি সংসদ সদস্য হয়ে আসবেন,  তাঁর হাতেই রাজনীতির নাটাই। 

আগামী ৮ মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্ব। এ পর্বে ১৫২টি উপজেলায় ভোট হবে। আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু ২৩ এপ্রিল থেকে। যদিও আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ইতিমধ্যে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন। 

১ এপ্রিল প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের ভেতরের ‘গৃহদাহ’ আরও প্রকট হয়েছে। দলীয় প্রতীক না থাকায় মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূলের নেতারা।

অনেক উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনগুলোর সাত-আটজন পর্যন্ত ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছেন। কোনো কোনো উপজেলায় মন্ত্রী, প্রভাবশালী নেতা ও সংসদ সদস্যরা তাঁদের সন্তান, ভাই, শ্যালকসহ নিকটাত্মীয়দেরও প্রার্থী করছেন। এ নিয়ে কোথাও বিক্ষোভও হয়েছে। 

উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের বিভেদ ঠেকাতে কেন্দ্রীয় নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। নির্দেশনা দিচ্ছেন। এসব বৈঠকে তৃণমূলের নেতারা মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে স্বজনতোষণের অভিযোগ এনেছেন। স্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ উপজেলায় একক প্রার্থী দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হওয়ায় সেটি সম্ভব হবে না। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়
নেতৃত্ব চেষ্টা করছে, দলের ‘প্রার্থীর’ সংখ্যা যতটা কম রাখা যায়।  

মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগের এই বিভক্তি কতটা বিরূপ প্রভাব ফেলবে, তা নির্ভর করছে বিএনপির নির্বাচনে আসা না আসার ওপর। জাতীয় নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনও যদি বিএনপি বর্জন করে, তাহলে আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সুযোগ পাবে।

জাতীয় পার্টি কোনো অবস্থাতেই তাদের প্রবর্তিত উপজেলা নির্বাচন বর্জন করবে না। জামায়াতে ইসলামীও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ‘যেসব স্থানে তাদের নেতাদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেসব স্থানে তারা প্রার্থী দেবে।’

বিএনপি ২০২১ সালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। তা সত্ত্বেও বিএনপির তৃণমূলের অনেক নেতা স্থানীয় পর্যায়ের একাধিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং কেউ কেউ জয়ীও হয়েছেন। যাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, দল তাঁদের বহিষ্কার করেছে। বিএনপির নেতাদের মনে রাখতে হবে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েও সেটি ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, সিলেটের চার উপজেলায় জামায়াতের সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থীরা প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। যেখানে আওয়ামী লীগের তিন–চারজন করে প্রার্থী মাঠ গরম করছেন, সেখানে জামায়াত থেকে একজন করে প্রচার চালাচ্ছেন। প্রশ্ন হলো বিএনপি কী করবে? তারা উপজেলা নির্বাচন করবে, না আওয়ামী লীগকে আরেকবার ‘ওয়াক ওভার’ দেবে? 

বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের অনেকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। তাঁরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশ এই নির্বাচনকে দলের জন্য ‘ফাঁদ’ হিসেবে দেখছেন। তাঁরা মনে করছেন, বিএনপি এ নির্বাচনে গেলে আওয়ামী লীগ সরকারকে রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়া হবে।

দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ৪ মার্চ বগুড়ায় এক অনুষ্ঠানে জানিয়েও দিয়েছেন, ‘বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যাবে না। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ নির্বাচনে গেলে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আরও পড়ুন

বিএনপি ২০২১ সালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। তা সত্ত্বেও বিএনপির তৃণমূলের অনেক নেতা স্থানীয় পর্যায়ের একাধিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং কেউ কেউ জয়ীও হয়েছেন। যাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, দল তঁাদের বহিষ্কার করেছে। 

বিএনপির নেতাদের মনে রাখতে হবে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েও সেটি ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি। সরকার যেভাবেই হোক নির্বাচনটি করে ফেলেছে। আন্তর্জাতিকভাবে যারা অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল, তারাও কিন্তু বিএনপির বর্জননীতি সমর্থন করেনি। নির্বাচনের পর বহির্বিশ্ব ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ সরকারকে মেনে নিয়েছে। 

অনেকে মনে করেন, আন্দোলনের অংশ হিসেবেও বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে। নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি হচ্ছে—প্রথমত, নির্বাচনে গেলে স্থানীয় পর্যায়ের নেতা–কর্মীদের ওপর সরকারের যে দমন–পীড়ন, সেটা অনেকাংশে কমবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনটি ঠেকানোর অবস্থানে বিএনপি এখন নেই। বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী তো যেসব স্থানে দলীয় প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা আছে, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছে।

মিত্রদের আপত্তি সত্ত্বেও জামায়াতকে বিএনপি প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য সঙ্গী হিসেবে রেখেছে ভোটের হিসাব–নিকাশের কারণেই। তৃতীয়ত নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিলে বিএনপি নেতারা দলকে সংগঠিত করার সুযোগ পাবেন। সরকারের অন্যায় অবিচারের কথা ভোটারদের কাছে তুলে ধরতে পারবেন।  

আর নির্বাচনে না গেলে বিএনপির নেতাদের ভাষায় ‘আরেকটি সাজানো নির্বাচন’ চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার থাকবে না।

 জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনের ফল সব সময় এক না–ও হতে পারে। সম্প্রতি তুরস্কে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এরদোয়ানের দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির ভরাডুবি হয়েছে। অথচ গত বছর তিনি বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন। 

এ ক্ষেত্রে বিএনপির নেতারা ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের কথা স্মরণ করতে পারেন। আগের বছর জাতীয় নির্বাচনে ভয়াবহ বিপর্যয় সত্ত্বেও বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে ভালো ফল করেছিল। ক্ষমতাসীনেরা জবরদস্তি না করলে হয়তো বিএনপিই সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জয়ী হতো।

নির্বাচনে অংশ নিয়ে এর কারচুপি বা জবরদস্তির কথা বললে সেটা জনগণের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হবে। মাঠের বাইরে থেকে চিৎকার করলে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। অতএব উপজেলা নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিএনপির নেতৃত্বের উচিত তৃণমূলের নেতা–কর্মীদের মতামত নেওয়া। নির্বাচনে গেলে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন এবং ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে—কেবল এই যুক্তিতে যদি বিএনপি বর্জনের নীতি অব্যাহত রাখে, সেটা রাজনৈতিকভাবে প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে হয় না। 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]