মঞ্চ কেন ভাঙে

বাবা কেন চাকর, গরিব কেন কাঁদে?, শান্ত কেন অশান্ত?, স্বামী কেন আসামি?, মফিজ কেন আইএ ফেল?—এই টাইপের টাইটেলওয়ালা বাংলা সিনেমা এই বাংলা-ওই বাংলা মিলিয়ে কুড়িখানিকের কম হবে না। তার সঙ্গে এবার মঞ্চ কেন ভাঙে? নামে কোনো ছবি যোগ হবে না তো!

গত ৬ জানুয়ারি রোজ শুক্রবার ছাত্রলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উদ্বোধকের বক্তব্য দেওয়ার সময় আচমকা হুড়মুড় করে মঞ্চ ভেঙে পড়ার পর নতুন বাংলা ছবিসংক্রান্ত এমন একটা বিদঘুটে আশঙ্কা জনমনে উঠতেই পারে।

মঞ্চ ভেঙে পড়ার ঘটনা খাট ভাঙার মতো ছোটখাটো ঘটনা না। এই ঘটনায় বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারত। কপাল ভালো, মাথার ওপর একগাদা নেতা-কর্মীর বোঝা নিয়ে মঞ্চটি উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো নিরীহ কায়দায় আলতো করে বসে পড়েছে। কেউ গুরুতর আহত হননি। দুর্ঘটনা তামাশার বিষয় না। কিন্তু ফেসবুকসহ যাবতীয় সামাজিক ও অসামাজিক—উভয় যোগাযোগমাধ্যমে মঞ্চ ভাঙার মুহূর্তের ভিডিওচিত্র কিলবিল করছে। আর পাবলিক তাই নিয়ে ‘ট্রল’ বা ঠাট্টা বা পরিহাস করছে। কেন করছে? সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে দেখি, খালি পাবলিকই না; স্বয়ং নিয়তি ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই নির্মম পরিহাস করেছে।

ভিডিওচিত্রে দেখা যাচ্ছে, বিকেল ৪টা ১০ মিনিটের দিকে কাদের তাঁর বক্তব্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’কে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরের প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। তিনি ছাত্রলীগকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘আমি তোমাদের কাছে স্মার্ট বাংলাদেশ...’। বাক্যটি আর শেষ হয়নি। সেই মুহূর্তেই আনস্মার্ট মঞ্চ পায়া ভেঙে বসে গেল। কাদেরসহ মঞ্চে দাঁড়ানো সবাই পড়ে গেলেন। অনেকেই বলছেন, কাদেরের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বলা আর মঞ্চটি ভেঙে পড়ার সন্ধিক্ষণটা, মানে টাইমিংটা ছিল অসাধারণ; পাকা তাল মাটিতে পড়ার ন্যানো সেকেন্ড আগে তালের ওপর কাক বসার মতো কাকতালীয়।

ওবায়দুল কাদের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ কথাটা মিনিটখানিক আগে বললেও তো বলতে পারতেন। অথচ তা তিনি বললেন না। নিয়তি পরিহাস করে মঞ্চ ভাঙার ঠিক আগের মুহূর্তে তাঁর মুখ থেকে অধিকতর প্রযুক্তিশীল স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয়ধ্বনি বের করল। তাঁর সেই বক্তব্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’সংক্রান্ত ‘আমরা করব জয় একদিন’ গোছের যে দৃশ্যমান প্রত্যয় ও অঙ্গীকার নিহিত ছিল, তাতে সাধারণ লোকের যে অদৃশ্যমান অনাস্থা প্রবল, তা তাদের ট্রলরূপী পরিহাসের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে।

বলা হয়ে থাকে, ‘বিপদ বলেকয়ে আসে না’। আর যেটি বলা হয় না, সেটি হলো, ‘কিছু বিপদ বলেকয়েই আসে।’ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরেই দেখা যাচ্ছে, মঞ্চে নির্ধারিত নেতাদের বাইরে কাউকে না দাঁড়ানোর জন্য আগেভাগেই বলা হয়েছিল। কিন্তু ‘আধা নেতা’ ও ‘সিকি নেতা’রা সে কথায় কান দেননি। তাঁরা ‘কড়ি যখন ফেলেছি, তেলও আমি মাখব’ টাইপের গোঁ ধরে গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় মঞ্চের দশা হয়েছিল ‘তিল ঠাঁই আর নাহিরে’। বারণ না শুনে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক দাঁড়ানোয় যা হওয়ার হয়েছে। বলেকয়েই বিপদ এসেছে।

বিপদের নানা উপযোগিতা আছে। যথা: বিপদ মানুষকে শিক্ষা দেয়। ওবায়দুল কাদের পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছেন, ‘একটা স্টেজ ভেঙে পড়েছে। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে আমি বলব এই যে নেতাদের মঞ্চে ওঠা...এত নেতা আমাদের দরকার নাই। আমাদের আরও কর্মী দরকার। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট কর্মী দরকার। এত নেতা আমাদের দরকার নাই। যেকোনো মঞ্চে গেলে সামনের লোকের থেকে মঞ্চে লোক বেশি। কেন? এত নেতা কেন? নেতা উৎপাদনের এত বড় কারখানা আমাদের দরকার নাই। কর্মী উৎপাদনের কারখানা দরকার, সেটাই হোক ছাত্রলীগ।’

ওবায়দুল কাদেরের সেই দিনের সেই বিপদ থেকে পাওয়া শিক্ষার ফল গত বুধবার (১১ জানুয়ারি) আমরা দেখেছি। ওই দিন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় মঞ্চে ওঠা নেতাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া অন্যদের তিনি নামিয়ে দেন। অনেক নেতা মঞ্চের ওপরে সামনের দিকে বসতে গেলে তিনি নিজে ডায়াস থেকে গিয়ে তাঁদের সরিয়ে দেন। লেখা বাহুল্য, সেদিন মঞ্চ ভেঙে পড়েনি।

চিনুয়া আচেবে মনের কষ্টে থিংস ফল অ্যাপার্ট (সবকিছু ভেঙে পড়ে) লিখে যে শিক্ষা আমাদের দিতে চেয়েছেন, তা বোঝার আগে ছাত্রলীগের মঞ্চ কেন ভাঙল, তা নিয়ে ভালোমতো তদন্ত করা দরকার। অতিরিক্ত লোকের চাপে, নাকি মঞ্চের ঠিকাদারেরা ঘুণে ধরা বাঁশ দিয়ে পায়া বানানোয় এই কাণ্ড ঘটেছে, তা তলিয়ে দেখা দরকার। যেহেতু বড় বড় প্রতিষ্ঠানেরই স্তম্ভ বা খুঁটিতে ঘুণ ধরে দেশজুড়ে থিংস ফল অ্যাপার্ট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেখানে একটা মঞ্চ ভাঙা তো আদতেই ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় ‘স্বাভাবিক ব্যাপার’।

২.

এলসিনর দুর্গের অতি সাধারণ দারোয়ান ছিলেন মার্সেলাস। কিন্তু হ্যামলেট নাটকে শেক্‌সপিয়ার এই ‘তুচ্ছ’ দুর্গরক্ষীর উক্তিতে এমন একটি বাক্য লিখেছিলেন, যা প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছে। মার্সেলাস বলেছিলেন: ‘সামথিং ইজ রোটেন ইন দ্য স্টেট অব ডেনমার্ক’।

প্রিয় পাঠক, আমি কিন্তু আপনাকে ‘ডেনমার্ক’ এর জায়গায় মনে মনে অন্য কোনো দেশের নাম বসিয়ে পড়তে বলিনি। অথচ আপনি সম্ভবত সেই কাজটাই করলেন!

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

[email protected]