পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ১২ জানুয়ারি থেকে ঢাকায় পার্বত্য মেলা শুরু হয়েছে। এ পার্বত্য মেলার মাধ্যমে পাহাড়ের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবন, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, রীতিনীতি ও ঐতিহ্যকে দেশের আপামর মানুষের মধ্যে তুলে ধরা হয়। এ আয়োজন নিঃসন্দেহে পাহাড় ও সমতলের মানুষের মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরি করে। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তির শর্ত মোতাবেক গঠিত পার্বত্য মন্ত্রণালয় মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন, সংস্কৃতিসহ সব দিক দেখভাল করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’ প্রণীত হয়েছিল। পার্বত্য মেলার মাধ্যমে পাহাড়ের সব জাতিসত্তার সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়, এতে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই; কিন্তু আমাদের প্রশ্ন অন্য জায়গায়।
খ্রিষ্টীয় নতুন বছরের আমেজ না কাটতেই বান্দরবানের ম্রো পাহাড়ের আকাশ ভূমিদস্যুদের সহিংসতার আগুনে পুড়ে গেছে। ম্রো পাহাড়ের এসব মানুষের ওপর এবারই প্রথম আক্রমণ এসেছে, তা নয়। গত বছরের মার্চ থেকে রবার কোম্পানির লোকজনের হামলার শিকার হচ্ছে এসব পাহাড়ি পরিবার।
২ জানুয়ারি ভূমিদস্যু লামা রাবার কোম্পানির লোকেরা রাতের আঁধারে এসে লামার রেঙয়েন ম্রোপাড়ার কমপক্ষে সাতটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন এবং পাঁচ থেকে ছয়টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালান বলে অভিযোগ উঠেছে (সূত্র: ডেইলি স্টার)। এ ঘটনার আগেও বেশ কয়েকবার সশস্ত্র হামলা, ভাঙচুর, ফলদ বাগান পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখ্য, বান্দরবানের লামার সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রোপাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরাপাড়া, রেঙয়েন ম্রোপাড়ার ৩৬টি পাহাড়ি পরিবারকে উচ্ছেদ করার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে গত বছরের মার্চ থেকে। বারবার হামলার শিকার হয়ে ভুক্তভোগীরা বিশুদ্ধ পানি ও খাবার-সংকটে পড়ে। এমনকি পাহাড়ি ঝিরিতে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়। এতসব সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বরং ভূমিদস্যুদের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। তাই প্রশ্ন জাগে, একই জায়গায় বারবার হামলা হচ্ছে, বসতভিটা জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথচ দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না কেন?
আগেই উল্লেখ করেছি, লামার এসব পাহাড়ি মানুষকে তাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য রবার কোম্পানির লোকেরা গত বছর থেকে হামলা করছেন। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রীর উপস্থিতিতেও বারবার বৈঠক হয়েছে। সরেজমিন তদন্তের পর বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে রবার কোম্পানির লিজ বাতিলের সুপারিশ চেয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনও পাঠানো হয়। কিন্তু কাদের স্বার্থ রক্ষার্থে এ সমস্যাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে! পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় কেন লামা রাবার কোম্পানির বিষয়ে উদাসীন আর নিশ্চুপ, সে প্রশ্ন আজ সবার।
পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, ঘটনার পরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শনে করেছে। এ সময় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ক্যংজরী চৌধুরী এ সমস্যার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যাকে দায়ী করে বলেন, যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন ঠিকমতো কাজ করতে পারত, তাহলে এ সমস্যা হতো না। তিনি আরও বলেন, ‘ভূমি কমিশন সভা আহ্বান করলেই একটি পক্ষ হরতাল ডাকে।...হরতাল-পক্ষ এতই শক্তিশালী যে সরকার তাদের কাছে জিম্মি কি না, তা-ও জানি না’ (সূত্র: বিডিনিউজটুয়েন্টিফোরডটকম, ৫ জানুয়ারি)।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরকারী দল আওয়ামী লীগ একটানা ১৪ বছর ক্ষমতায় আছে। তারপরও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত রয়ে গেল। ভূমি সমস্যাকে পার্বত্য সমস্যার অন্যতম প্রধান সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে চুক্তির পরে ১৯৯৯ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন’ গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু ২৩ বছরেও এ কমিশনের বিধিমালা চূড়ান্ত না হয়নি, পর্যাপ্ত জনবল ও বাজেটের অভাবে ভূমি কমিশন অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে আছে—এসব খুবই দুর্ভাগ্যজনক। অথচ ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য কমিশনের কাছে ইতিমধ্যে ২২ হাজারের অধিক আবেদন জমা পড়ে আছে। অন্যদিকে বিশেষ কিছু গোষ্ঠী ভূমি কমিশনের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে পাহাড়ের সমস্যাকে জিইয়ে রাখার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা তিমিরেই রয়ে গেছে। যে শান্তির লক্ষ্যে চুক্তি হয়েছিল, তা যে পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি আনতে পারেনি, তার বহু ঘটনা আমাদের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। সেখানে যুক্ত হলো ম্রো পাহাড়ের ঘটনাবলিও।
তাই কেবল দিবস উদ্যাপনের জন্য রঙিন ফেস্টুন উড়িয়ে র্যালি করা কিংবা কনসার্ট বা মেলা আয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে উন্নয়নের চশমা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করলে, সেটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। কারণ, দেশের একটা অংশকে গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত রেখে বাকি অংশের উন্নয়ন কখনোই টেকসই হবে না। তাই দেশের সব নাগরিককে সমান আস্থায় আনতে হবে। তবেই দেশ সমৃদ্ধির পথে এগোবে।
● ইলিরা দেওয়ান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক