লোহিত সাগরে নৌ আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মরিয়া কেন রাশিয়া

রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার সামরিক শক্তির দুর্বলতাকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। এখন ক্রেমলিনের উদ্বেগের একটা প্রধান জায়গা হলো, তাদের নৌবাহিনীর সক্ষমতা কতটা, তা নিয়ে। কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার নৌবহর ইউক্রেনের জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সহজ লক্ষ্যবস্তু হওয়ায় মস্কো বিকল্প পথ খুঁজছে। এর মধ্যে একটি হলো সুদানে নৌঘাঁটি করার পরিকল্পনা।

২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় মস্কো তার প্রভাব শক্তিশালী করার চিন্তা করে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর সঙ্গে আলোচনাকালে সুদানের সে সময়কার প্রেসিডেন্ট ওমর আল আসাদ সুদানে রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছিলেন।

এর তিন বছর পর মস্কো ও খার্তুম একটি চুক্তির খসড়ায় স্বাক্ষর করে। চুক্তির সম্ভাব্য মেয়াদকাল ধরা হয়েছিল ২৫ বছর। সুদানের বর্তমান সামরিক শাসকেরা এ মাসেই চুক্তিটির অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে নির্বাচিত কোনো রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করলে চুক্তিটি পার্লামেন্টে পুনরায় অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। কিন্তু মস্কো সেটিকে বাধা বলে বিবেচনা করছে না। ইউরোপে যেভাবে একঘরে হতে বসেছে, তাতে ক্ষমতা ও ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য লোহিত সাগর অঞ্চলে রাশিয়া নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া।

সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের উমেদারি নিয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এ বছরেই দুবার ওই অঞ্চলে সফরে যান। তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে সুদান উপকূলে রাশিয়ার নৌবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিতে ঘাঁটি নির্মাণ অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত।

বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিনিময়ে নিজেদের সমুদ্রসীমায় রাশিয়ান নৌবাহিনীর প্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে খার্তুম মস্কোর হাতকেই শক্তিশালী করতে চলেছে। কিন্তু এখানে সুদানের স্বার্থটাও গুরুত্বপূর্ণ। একটি বিষয় হলো, সুদান মূল চুক্তিটি সংশোধন করেছে। তারা রাশিয়ার নৌবাহিনীর জাহাজকে মাত্র পাঁচ বছরের জন্য তাদের পানিসীমায় থাকার অনুমোদন দিয়েছে। ইজারা বাড়িয়ে সেটি ২৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে।

সুদানের এভাবে পিছুটান দেওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। শুধু পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন নয়, ইসরায়েলের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায় দেশটি।

এ ছাড়া সুদানের নেতারা তাদের ওয়াশিংটনবিরোধী মনোভাবকে সুবিধা আদায়ের ভিত্তি হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে। সুদানে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, দেশটিতে বড় ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। সুদানের নেতারা মনে করতে পারেন, রাশিয়াকে তারা যে কম সুযোগ দিচ্ছে, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব সুদানকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারে।

কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সুদানে রাশিয়ার নৌবাহিনীর প্রবেশাধিকারের সুযোগ দেওয়ার বিনিময়ে মস্কো সুদানের সেনাবাহিনীকে সামরিক সহায়তা দিতে চেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেটি কতটা সম্ভব তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সেনাবাহিনী অস্ত্র-গোলাবারুদে টান পড়েছে। ইরান ও উত্তর কোরিয়া থেকে ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আমদানি করতে হচ্ছে তাদের।

ওই অঞ্চলে একমাত্র সামরিক পরা শক্তি যুক্তরাষ্ট্র। তারা লোহিত সাগরে রাশিয়ার বন্দর স্থাপনের পরিকল্পনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। ওয়াশিংটন এরই মধ্যে সুদানকে সতর্ক করেছে দেশটি যেন ক্রেমলিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাড়াটে সেনা দল ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করে। ভারত মহাসাগরের জিবুতি ও দিয়েগো গার্সিয়ায় নৌঘাঁটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। বাহরাইনে তাদের পঞ্চম নৌবহর রয়েছে। ফলে রাশিয়ার নৌবাহিনী কোনো প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী সেখানে ছায়া হিসেবে হাজির থাকবে।

এ ছাড়া পশ্চিমাদের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়াই রাশিয়ার লোহিত সাগর অভিযান বেশ কিছু বাধার সম্মুখীন হবে।  প্রথমত, সুদানকে বাংলাদেশের পানিসীমায় নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়ান জাহাজের প্রবেশ ও দেশটির বন্দরে নোঙর না করতে পারার ঘটনাটি স্মরণ করতে হবে।

আরও পড়ুন

একটা সম্ভাবনা আছে যে সুদানগামী রাশিয়ান জাহাজ সুয়েজ খাল দিয়ে যাওয়ার সময় সেগুলো আটকে দেওয়া হতে পারে। মিসর এই খাল পরিচালনা করে। গত বছরের মার্চ মাসে তুরস্ক তাদের বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালিতে রাশিয়ার জাহাজ চলাচলের ওপর একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। রাশিয়ার সবচেয়ে বড় গম আমদানিকারক দেশ মিসর। সুদানে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি যাতে না হয়, সে জন্য জোরালো বিরোধিতা করেছে দেশটি।

দ্বিতীয়ত, কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সুদানে রাশিয়ার নৌবাহিনীর প্রবেশাধিকারের সুযোগ দেওয়ার বিনিময়ে মস্কো সুদানের সেনাবাহিনীকে সামরিক সহায়তা দিতে চেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেটি কতটা সম্ভব তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সেনাবাহিনী অস্ত্র-গোলাবারুদে টান পড়েছে। ইরান ও উত্তর কোরিয়া থেকে ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আমদানি করতে হচ্ছে তাদের।

তৃতীয় প্রতিবন্ধকতা হলো, সুদানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৫০ সাল থেকে ১৭টি অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছে, এর ছয়টি সফল হয়েছে।

এখন পর্যন্ত যে বাস্তবতা, তাতে উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় ক্রেমলিনের লক্ষ্যে পূরণ হওয়ার সুযোগ খুব কম। ইউক্রেনে যেভাবে বেকায়দায় পড়েছে এবং যেভাবে তাদের যুদ্ধ সরঞ্জামের ভান্ডারে টান পড়েছে, তাতে লোহিত সাগরে নৌ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার মতো সামর্থ্য মস্কোর নেই।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর নিজেদের নাকের ডগায় থাকা কৃষ্ণসাগরের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ওদেসা বন্দর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ক্ষমতা নেই। লোহিত সাগরে মস্কোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সে কারণেই অবাস্তব কল্পনা। এরপরও যদি রাশিয়া সুদানে তাদের ঘাঁটি নির্মাণ করতে পারে, তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ পানিপথে ক্ষমতার ভারসাম্য নতুন করে লিখতে হবে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

নিকোলা মিকোভিচ সার্বিয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক; রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশের পররাষ্ট্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞ