আইনজীবী সমিতির নির্বাচন কি জাতীয় নির্বাচনের মহড়া?

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে বুধবার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। আইনজীবীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হলো; মারধর, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটল।
ছবি: প্রথম আলো

গত মঙ্গলবার রাতে সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ হলো। তাঁদের একজন আওয়ামী লীগের ঘোরতর সমর্থক, আরেকজন বিএনপির একনিষ্ঠ অনুসারী—দুজনই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে উৎকণ্ঠায় ছিলেন। তাঁদের একজন মনে করেন, আওয়ামী লীগ কোনো ভুল করতে পারে না। অপরজনের ধারণা, বিএনপি কোনো ভুল করতে পারে না।

তাহলে ভুলটা করল কে? কেন নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত সহিংস পরিস্থিতির দিকে গেল?

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে বুধবার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। আইনজীবীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হলো; মারধর, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটল। পুলিশ এসে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের বেধড়ক পেটাল। কারও কারও পরনের জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলল। সব আইনজীবী কিন্তু আক্রান্ত হলেন না। আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা নিরাপদেই ছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে বের করে দেওয়া হলো বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের। বৃহস্পতিবারও ঘটনার রেশ চলতে থাকে। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে প্রতিকার চেয়েছেন। নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা বলছেন, নির্বাচন ভন্ডুল করতেই বিএনপিপন্থীরা ভাঙচুর ও হাঙ্গামা করেছেন।

নির্বাচনে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেল হলো বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সমর্থিত প্যানেল ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল।

ঘটনার সূত্রপাত হলো নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মনসুরুল হক চৌধুরীর পদত্যাগকে কেন্দ্র করে। বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের অভিযোগ, ‘বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক আলাদা ব্যালট পেপার তৈরি করে যেভাবে বলবেন, সেভাবে কাজ করতে বলেছেন। তাই উনি পদত্যাগ করেছেন।’ একতরফা নির্বাচন করার উদ্দশ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন।

এরপর আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক হিসেবে মো. মনিরুজ্জামানকে মনোনীত করেন। অন্যদিকে বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা এ এস এম মোকতার কবির খানকে আহ্বায়ক মনোনীত করেন।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা মো. মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক মনোনীত করার পর বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা মোকতার কবির খানকে আহ্বায়ক হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি  নির্বাচনী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ব্যালট পেপারে সই করতে সমিতির তিনতলার সম্মেলনকক্ষে যান। এতে আপত্তি জানান বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। তাঁরা কিছু ব্যালট পেপার ছিনিয়েও নেন। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল, হইচই ও হট্টগোল শুরু হয়। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া এবং হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়।

উল্লেখ্য, ২ মার্চ উভয় পক্ষের সম্মতিতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (২০২৩-২০২৪) নির্বাচন পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মনসুরুল হক চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট উপকমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছিল।  

সুপ্রিম কোর্ট আইনজবী সমিতির ১৪টি পদের বিপরীতে ২৯ জন প্রার্থী রয়েছেন। এবারের নির্বাচনে ভোটারসংখ্যা ৮ হাজার ৬০২। সভাপতি ১টি, সহসভাপতি ২টি, সম্পাদক ১টি, কোষাধ্যক্ষ ১টি, সহসম্পাদক ২টি, সদস্যের ৭টি পদসহ মোট ১৪টি পদে এক বছর মেয়াদের জন্য ওই নির্বাচন হয়ে থাকে।

গণমাধ্যমের খবরে আরও বলা হয়, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন উপলক্ষে বুধবার সকাল থেকেই আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের সাদা দল ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের নীল দলের সদস্যরা সক্রিয় ছিলেন। সাদা দলের পক্ষে আইনজীবীরা আদালত এলাকায় স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশ ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে। তখন পেশাগত দায়িত্বপালনের সময় পুলিশের হামলার শিকার হন অন্তত ১০ জন সাংবাদিক। আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এ ঘটনা ঘটে। এরপর আদালত এলাকা থেকে নীল দলের আইনজীবীদের জোর করে বের করে দেন পুলিশের সদস্যরা।

বিকেল ৩টায় বিএনপি সমর্থিত প্যানেল থেকে সভাপতি প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন অভিযোগ করেন, ‘এখানে ভোট হচ্ছে না। কেননা, কমিশনের বৈধতা নেই। যাঁরা আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছেন, তাঁদের বিচার করতে হবে। নতুন করে ভোট নিতে হবে। তা না হলে আমাদের আন্দোলন চলবে।’ তবে সমিতির বর্তমান সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, মাহবুব উদ্দিন খোকনের নেতৃত্বে রুহুল কুদ্দুস ও তাঁদের বাহিনী মঙ্গলবার রাতে সমিতির সম্মেলনকক্ষে ঢুকে ভাঙচুর ও কিছু ব্যালট পেপার ছিনতাই করেন। যখন শান্তিপূর্ণভাবে ভোট চলছিল, তখন তাঁরা প্যান্ডেল ভাঙচুর ও ভোট দিতে আসা আইনজীবীদের ওপর আক্রমণ করেন। এতে অনেক আইনজীবী আহত হন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পর এবার সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবীদের নির্বাচনেও ভোট চুরি হচ্ছে। অপর দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি ভোট চুরির মহারাজা। সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনে জিততে তারা ব্যালট পেপার ছিনতাই করতে গেছে। নির্বাচন পণ্ড করতে হামলা করেছে। ওবায়দুল কাদেরের অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্টে ভোট পণ্ড করার জন্য বিএনপি ৪০০ সন্ত্রাসী পাঠিয়ে জঙ্গি কায়দায় হামলা করেছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীদের মতো একটি পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচন নিয়ে এই হাঙ্গামা কেন হলো? মজার বিষয় হলো দুই দলই একে অপরের বিরুদ্ধে ‘নির্বাচন পণ্ড’ ও মাস্তানি করার অভিযোগ এনেছে।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়।  বৃহস্পতিবারও আওয়ামী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছে।  দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা জোরে জোরে স্লোগান দিতে থাকেন। একদল ‘ভোট চোর, ভোট চোর’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। অন্য পক্ষ আবার তার উত্তর দিতে থাকে।  পুলিশও মাঝে দাঁড়িয়ে সতর্ক অবস্থায় থাকে।  নির্বাচনের দ্বিতীয় দিনে দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য অবস্থান নেন।

এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের আপিল বিভাগে ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন আইনজীবীরা। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘আপনারা ১১টার সময় খাসকামরায় আসেন। প্রয়োজন হলে অ্যাটর্নি জেনারেলকে ডেকে নেব।’ সকাল নয়টার আগে থেকেই আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির এজলাসে (১ নম্বর বিচারকক্ষে) আসতে শুরু করেন বিএনপিপন্থী তিন আইনজীবী। সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে এজলাসে আসেন প্রধান বিচারপতি ও অপর সাত বিচারপতি।

সামরিক শাসনামলেও পেশাজীবী সংগঠনগুলো শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করেছে। অথচ ‘গণতান্ত্রিক’ আমলে হাঙ্গামা হলো। আইনজীবীদের শীর্ষ সংগঠনের এই নির্বাচন আগামী জাতীয় নির্বাচনের মহড়া কি না, সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে।

আমরা যদি সুষ্ঠুভাবে দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচন না করতে পারি, তাহলে কীভাবে নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবি করতে পারি? কীভাবে আশা করতে পারি, আগামী জাতীয় নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে? ইতিমধ্যে দুই পক্ষই তাদের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছে, সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। বিএনপি বলেছে, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা যাবে না।

নির্বাচনটি তো কেবল আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির বিষয় নয়। নির্বাচন হলো জনগণের প্রতিনিধি বাছাইয়ের উপায়। এত দিন জাতীয় ও স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে জবরদস্তি লক্ষ করে আসছি। এখন পেশাজীবী সংগঠনগুলোও এ থেকে বাদ যাচ্ছে না। সাংবাদিকদের সংগঠন অনেক আগেই ভাগ হয়ে গেছে। বর্তমানে সাংবাদিকদের একটি সংগঠন আওয়ামী লীগের সমর্থক, আরেকটি বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচিত।

আইনজীবী, শিক্ষক ও চিকিৎসকদের সংগঠনগুলোও কি সেই বিভক্তির দিকে যাচ্ছে?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি
    [email protected]