তাপদাহে স্কুল খোলা নিয়ে এ কেমন মশকরা

বেলা সাড়ে ১১টায় স্কুল ছুটির পর রোদ থেকে নিজেকে রক্ষায় মাথায় হাত দিয়েছেন এই শিক্ষার্থী। রোববার, লক্ষ্মীবাজার, ঢাকাছবি: দীপু মালাকার

পথের পাঁচালীর ‘প্রসন্ন গুরুমহাশয় বাড়ীতে একখানা মুদীর দোকান করিতেন। দোকানেরই পাশে তাঁহার পাঠশালা ছিল। বেত ছাড়া পাঠশালায় শিক্ষাদানের বিশেষ উপকরণ-বাহুল্য ছিল না।’

সেই পাঠশালায় শিশু অপুর প্রথম যাওয়ার বর্ণনা ছিলঃ

‘মা আসিয়া ডাকিল—অপু, ওঠ শীগগির ক’রে, আজ তুমি যে পাঠাশালায় পড়তে যাবে! পাঠশালার নাম শুনিয়া অপু সদ্য-নিদ্রোত্থিত চোখ দুটি তুলিয়া অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার ধারণা ছিল যে, যাহারা দুষ্টু ছেলে, মা’র কথা শোনে না, ভাইবোনদের সঙ্গে মারামারি করে, তাহাদেরই শুধু পাঠশালায় পাঠানো হইয়া থাকে। কিন্তু সে তো কোনদিন ওরূপ করে না, তবে সে কেন পাঠাশালায় যাইবে?’

আরও পড়ুন

গতকাল (২৮ এপ্রিল রোববার) ঠা ঠা রোদে যখন রাজধানী পুড়ছিল, অগ্নিস্নাত লু হাওয়ার হলকা যখন চোখে মুখে বাড়ি মারছিল, সেই সময় আমার শিশুপুত্রকে তাঁর মা কতকটা সর্বজয়ার মতো করে বললেন, ‘রেডি হও, ইশকুলে যেতে হবে’ (বলা বাহুল্য হলেও লেখা দরকার, তৃতীয় শ্রেণির এই ছাত্রটির ক্লাস শুরু হয় দুপুর সাড়ে বারোটায়, শেষ হয় বিকেল সাড়ে চারটায়)।

মাথা নষ্ট করা গরমের মধ্যে স্কুলে যেতে হবে শুনে ক্ষুদ্র শিক্ষার্থীটি অনেকটা অপুর মতো করেই ‘চোখ দুটি তুলিয়া অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।’

কিন্তু সেই অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে যে অনুনয় ছিল তা তাঁর স্কুলে না যাওয়ার পক্ষে বিশেষ ওকালতি করতে পারল না। সরকারি আদেশ অনুসরণ করা অলংঘেয় মাতৃআজ্ঞায় শেষ পর্যন্ত তাকে স্কুলে যেতে হলো।

অকস্মাৎ আগত তাপদাহরূপী ভীষণ অসুরকে এক তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে দেশের তাবৎ কোমলমতি ছাত্রপাত্রকে রাতারাতি একেকটি চলিষ্ণু বিদ্যাকল্পদ্রুম মার্কা আস্ত বিদ্যাসাগরে পরিণত করার সরকারি অভিলাষ বাস্তবায়নে আমার শিশুপুত্র যখন ক্লাস করছিল, তখন ফেসবুকের নিউজফিডে মেরুদণ্ডে শীতল স্রোত বইয়ে দেওয়ার মতো কিছু আতঙ্ক জাগানিয়া খবর আসছিল।

আরও পড়ুন

‘মানিকগঞ্জে হিট স্ট্রোকে প্রধান শিক্ষকের মৃত্যু’, ‘তীব্র গরমে শ্রেণিকক্ষেই জ্ঞান হারাল শিক্ষার্থী’, ‘নোয়াখালীতে প্রচণ্ড গরমে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১৭ শিক্ষার্থী অসুস্থ’, ‘গরমে অসুস্থ হয়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু’, ‘হিট স্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু’, ‘তীব্র গরমে টিউবওয়েলের পানি পান করে ১৩ স্কুল শিক্ষার্থী অসুস্থ’—এই ধরনের খবর পড়ছিলাম।

ভাবছিলাম, দেশে কয়টা বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে বৈদ্যুতিক পাখা আছে? কয়টি বিদ্যালয়ের ভবনের ওপর রড-সুরকিতে ঢালাই করা ছাদ আছে? কোনো শিক্ষার্থী বা শিক্ষক হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তার তাৎক্ষণিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা দেওয়ার জ্ঞান কয়টি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আছে?

ভাবছিলাম, সরকার কি জানে না, সারা দেশে টিনের চালের তলে বৈদ্যুতিক পাখাবিহীন পাঠশালায় লাখ লাখ ‘অপু-দুর্গা’ পড়াশোনা করে? সেই টিনের চাল উত্তপ্ত হলে ক্লাসঘরগুলো যে আস্ত একেকটা লোহা গলানো রি-রোলিং মিল হয়ে ওঠে সে আন্দাজ কি শিক্ষামন্ত্রীর নেই? তাপের চোটে যেখানে রাস্তার পিচ গলে যাচ্ছে, সেখানে এই সব শ্রেণিকক্ষে বসে টেন্স বা সেনটেন্সের পাঠ নিতে গেলে যে কেউ যে সেন্সলেস হয়ে পড়তে পারে, তা বোঝার মতো সেন্স কি বিদ্যানুরাগী কর্মকর্তাদের মাথায় নেই?

আরও পড়ুন

‘কিছু হলেই স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার আলোচনা কেন? সবকিছু খোলা থাকবে আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে, এ প্রত্যাশা যথাযথ নয়’—শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের এই বক্তব্য ওপরোক্ত ভাবনার পারদকে চড়িয়ে দিচ্ছিল। এরপর স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা নিয়ে একেক মুনির একেক মত দেখছিলাম।

তাপদাহের কারণে বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অসুস্থ হয়ে পড়ার খবরের মধ্যে গতকাল রোববার ঢাকা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা ও রাজশাহী-এই ৫ জেলার মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা এল।

তবে এসব এলাকার যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ চাইলে প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে পারবে বলে বলা হয়েছিল।

সেই ঘোষণায় প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখার কথা ছিল না। অর্থাৎ প্রাথমিকের পড়ুয়াদের স্কুলে যাওয়ার আদেশ আগের মতোই জারি ছিল।

আজ সোমবার দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় ২ মে পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা এল।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরেক ঘোষণায় আগামীকাল মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) দুটি বিভাগের সব জেলাসহ দেশের ২৭টি জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দিল।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা বা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে যে নীতি নির্ধারকদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলা আছে তা এখন মোটামুটি স্পষ্ট।

কারণ এটি নিয়েও হাইকোর্টকে পর্যন্ত রুলিং দিতে হয়েছে। হাইকোর্ট আজ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসার ক্লাস আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন

গত ১৯ এপ্রিল থেকে দফায় দফায় ৭২ ঘণ্টার ‘তাপ সতর্কতা’ জারি করে যাচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তার মানে একটা প্রাকৃতিক জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। একটা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।

আবহাওয়া দপ্তরও বলে যাচ্ছে, তাপপ্রবাহ দু একদিনের মধ্যে কমার কোনো লক্ষণ নেই। এই বাস্তবতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সরকারের ব্যাগ্রতার বাহুল্য শিক্ষার্থীর অভিভাবক হিসেবে আমাদের অনেকের মনে যথেষ্ট বিরক্তি উৎপাদন করছে।

রুটি-রুজির জন্য অনেক লোককে রিকশা চালনা কিংবা এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হচ্ছে। এসব কাজ করতে গিয়ে ইতিমধ্যেই কয়েকজন হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।

শিক্ষামন্ত্রী রোববার রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘কিছু হলেই প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে, এ ধারণা রাখা চলবে না। আমাদের নতুন কারিকুলাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক; তাই শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে আসা জরুরি।...ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বিবেচনা করে সারা দেশের বিদ্যালয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানসিকতা পরিহার করতে হবে।’ যে মুহূর্তে দেশের প্রায় সবখানে মানুষ তীব্র গরমে অতিষ্ঠ ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে, সে মুহূর্তে শিক্ষামন্ত্রীর এই বিপ্লবী বিদ্যোৎসাহ এবং স্কুল খোলা নিয়ে সরকারের দফায় দফায় সিদ্ধান্ত দেওয়া পীড়াদায়ক।

যেখানে জীবন-জীবিকার প্রশ্ন, সেখানে হয়তো পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করা বা ন্যূনতম ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখানো যেতে পারে।

কিন্তু তাপদাহের মতো তুলনামূলক ক্ষণায়ু দুর্যোগের মধ্যে বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যায়তনে ছাত্র-ছাত্রী পাঠানো নিয়ে কেন ‘অন-অফ’ টাইপের সিদ্ধান্ত আসবে সেটি আমার মতো অনেকেরই মোটা মাথায় ঢুকছে না।

শিক্ষামন্ত্রী রোববার রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘কিছু হলেই প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে, এ ধারণা রাখা চলবে না। আমাদের নতুন কারিকুলাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক; তাই শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে আসা জরুরি।...ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বিবেচনা করে সারা দেশের বিদ্যালয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানসিকতা পরিহার করতে হবে।’

যে মুহূর্তে দেশের প্রায় সবখানে মানুষ তীব্র গরমে অতিষ্ঠ ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে, সে মুহূর্তে শিক্ষামন্ত্রীর এই বিপ্লবী বিদ্যোৎসাহ এবং স্কুল খোলা নিয়ে সরকারের দফায় দফায় সিদ্ধান্ত দেওয়া পীড়াদায়ক।

সরকারকে বুঝতে হবে, আমাদের কারও হাত নেই এমন একটি খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে আমরা পড়েছি। এই পরিস্থিতি খুবই সাময়িক।

করোনায় টানা দুই বছর শিশুরা স্কুলে যেতে পারেনি। তাতে যখন মহাভারত অশুদ্ধ হয়নি, তখন এই তাপদাহে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে পাঠানো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত না হলেও চলবে।

প্রথমে ‘হীরক রাজার দেশে’র উদয়ন পণ্ডিতের মতো করে বলি, ‘পাঠশালা খুলবেই’; পরে একজন জনপ্রিয় রাজনীতিকের মতো করে বলি, ‘এ নিয়ে রাজনীতির কিছু নেই।’

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    [email protected]