সুদহারের নয়-ছয়ের জোয়াল কেন সরাতে হবে

কোভিড মহামারির আগেই ব্যাংকিং খাতে সুদহারের এই নয়-ছয়ের টুপি পরানো হয়। নিয়ম হলো ঋণদানে সুদহার ৯–এ নামাতে হবে। অন্যদিকে, সঞ্চয় বা আমানতের ওপর কমপক্ষে ৬ ভাগ সুদ দিতে হবে। এ নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন একাধিক সদুদ্দেশ্য থেকেই। এক. মালিকদের অতিরিক্ত মুনাফা কমানো। দুই. উচ্চ সুদের যন্ত্রণা থেকে ক্ষুদ্র ও সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের মুক্তি দিয়ে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো। তিন. ঋণহার ও আমানত হারের মধ্যকার বিস্তার বা স্প্রেড কমিয়ে ব্যাংকমালিকদের মারহাবা মুনাফায় কিছুটা লাগাম টেনে ধরা। তিনটি উদ্দেশ্যই নৈতিক ব্যাংকিংয়ের অনুষঙ্গ ও যথার্থ। বলা বাহুল্য, ব্যাংকমালিকেরা এ নির্দেশ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন—অনেকটা নিমপাতার রস সেবনের মতোই। বড় অনিচ্ছায়। বড় বেদনায়।

অর্থনীতিতে কোনো আইনস্টাইন না থাকলেও আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এখানেও কার্যকর। সময় ও পরিস্থিতির বিচারে একসময়ের ভালো নীতি পরে এক বাধায় পরিণত হয়। একসময়ের সম্পদ পরে হয় দায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়াকে লাগাম টেনে ধরতে ব্যাংকে সুদহার বাড়িয়ে দিতে হয়। সুদহার বেশি হলে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা কম ঋণ নেবেন। সমাজে অর্থপ্রবাহ কমে আসবে। তাতে মূল্যস্ফীতি পড়বে উপোসের টানে। জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপার্নিকাসের সেই ষোড়শ শতাব্দীতে আবিষ্কৃত মুদ্রার পরিমাণতত্ত্ব অনুযায়ী, টাকাপয়সার ছড়াছড়ি কমে গেলে জিনিসপত্রের দাম কমতে বাধ্য। আধুনিক অর্থনীতির ভাষায় সুদহার বেড়ে গেলে কার্যকর চাহিদা কমে আসে। চাহিদা কমলে দাম কমে।

এ জন্য সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়ায়। এতে অর্থনীতির ক্ষতিও হয়। তারপরও সাময়িক উপোস থেকে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপদ স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সমীচীন। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ মাত্র গত কয়েক মাসে সুদের নীতি হার বাড়িয়েছে তিন দফায়। এত দ্রুত পিঠাপিঠি খাড়া বৃদ্ধি নীতি হারের ইতিহাসে আগে ঘটেনি। এতে বিনিয়োগ কমবে, কমবে জিডিপি। প্রবৃদ্ধি ৩ থেকে ৪ ভাগের ধনাত্মক সংখ্যা থেকে ঋণাত্মক সংখ্যায় নেমে আসবে। ধেয়ে আসছে মন্দা। অন্তত আইএমএফ জ্যোতিষীর মতো সে রকমই বলছে। তাতে কী। যেকোনো মূল্যে মূল্যবৃদ্ধির আগুন থামাতে হবেই।

বাংলাদেশে এই আগুন থামানোর কথা বাজেট বা মুদ্রানীতিতে যতই গর্জনীয় হোক না কেন, সুদহারের নয়-ছয় জোয়াল তা কার্যকর হতে দেবে না। এ হচ্ছে বন্দীকে শৃঙ্খলিত করে কারাগারের ফটক খুলে দেওয়ার মতো ঘটনা, যাতে প্রকৃত মুক্তি মেলে না। কারণ, বাংলাদেশের বিচিত্র জাতের সুদহার বিশ্বের বুকে বিস্ময়। অন্য দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদের হার বাড়ালে বা কমালে বাজারে প্রচলিত সব সুদের হার একই সঙ্গে বাড়ে বা কমে। বাংলাদেশে তা নয়। এখানে নীতি সুদের হার ৫ থেকে বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৫ করা হয়েছে। এতে বাজারে ঋণ সুদের হার বাড়ার ধাক্কা লেগেছে। কিন্তু ওটা শিকলে বাঁধা অবস্থায় ছটফট করছে। বাড়তে পারছে না। ওটাকে মুক্ত করে দিলেই যে ঋণের হার খুব দ্রুত ওপরে উঠে যাবে, তা নয়। কিন্তু কিছুটা উঠলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তা ভূমিকা রাখবে, মুদ্রানীতির কার্যকারিতা কিছুটা হলেও ভেসে উঠবে। দেশে যে একটা কিঞ্চিৎ সক্ষম কেন্দ্রীয় ব্যাংক আছে, সেটা সবাই জানবে। তাই আপাতত নয়-ছয়ের জোয়াল সরিয়ে ফেলা উচিত।

এরপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ থাকবে। যেহেতু দামের উল্লম্ফন চলছেই, সেহেতু নীতি সুদের হার ক্রমাগত বাড়িয়ে যেতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ সুদের হার বাড়াচ্ছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া গত মে মাস থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন দফায় নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। ঋণপ্রবাহের ওপর ব্রেক কষে মূল্যস্ফীতির ওপরও কিছুটা লাগাম টেনে ধরেছে। বাকিটা পারছে না। কারণ, এই মূল্যবৃদ্ধির বেশির ভাগই এসেছে পুতিনতাড়িত আগ্রাসন থেকে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থবছরের শুরুতে মাত্র ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ওই যে দিবানিদ্রায় গেছে, আর নড়াচড়ার লক্ষণ দেখাচ্ছে না। তারা জানে, ঋণের হারকে কারাবন্দী রেখে নীতি সুদের হারের নাচানাচি নাটকমাত্র। আবার ঋণের হারকে কারামুক্ত করে দিলেও নীতি সুদের হারে মাত্র শূন্য দশমিক ৫ ভাগের সংকোচন দাওয়াই কোনো কাজে আসবে না। এ সময় নীতি সুদের হার বাড়াতে হবে অনেকটা আগ্রাসী ভঙ্গিমায়, যে স্টাইলে চলছে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড কিংবা আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। বাজেট-আকাঙ্ক্ষিত ৭ দশমিক ৫ ভাগ প্রবৃদ্ধির লোভ মাথা থেকে না সরালে কিংবা ১৪ ভাগ ব্যক্তি খাতের ঋণবৃদ্ধির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য থেকে না নামলে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির তাণ্ডব কমাতে পারবে না।

৯ ভাগ ঋণহারের ছাদভাঙা উচিত আরও এক কারণে, যে কারণের কথা বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় রাজস্ব অক্ষমতা ঢাকার জন্য সঞ্চয়পত্রের দশোর্ধ্ব উচ্চ হার বজায় রেখেছে। বিদায়ী গভর্নরের মতো শান্ত-সুবোধ মানুষও যাওয়ার বেলায় সঞ্চয়পত্রের উচ্চ হারে সরকারের ধার করা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সাহস করে বলেই ফেলেছেন যে সঞ্চয়পত্রের উচ্চ হার আর্থিক ব্যবস্থাপনায় একটা বাধা। ধনী ও প্রভাবশালীরা ৯ ভাগ হারে ঋণ নিয়ে সাড়ে ১০ ভাগ হারের সঞ্চয়পত্রে টাকা খাটিয়ে শুয়েবসে থাকলেও কোটি টাকা ঘরে আসবে। এই অবাজারীয় হারগুলোর ‘আরবিট্রাজ’ সুবিধা নিয়ে পরের ধনে পোদ্দারি করতে বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই অশুভ ব্যবসার সুবিধা রোধেও ঋণহারের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া ৯ ভাগের জোয়াল সরিয়ে নিতে হবে।

গত জুনে ভারতে গড় ঋণের হার ছিল ৮, আমানতের হার ৫। তাদের সঞ্চয়পত্রের হার ছিল ৬ দশমিক ৮। সঞ্চয়ের হার যদি ঋণহারের ওপরে উঠে যায়, তাহলে সে সমাজে বাড়ে আলস্য, বাড়ে সঞ্চয়ের প্রবণতা। কিন্তু সে হারে বিনিয়োগ বাড়ে না। বাংলাদেশেও জিডিপির অংশ হিসেবে সঞ্চয়ের চেয়ে ব্যক্তিবিনিয়োগের হার অনেক কম। মোট বিনিয়োগ ও মোট সঞ্চয়—এ দুটোই জিডিপির অংশ হিসেবে সমান সমান, প্রায় ৩১ ভাগ। জন মেনার্ড কিনসের মডেলে আমাদের মতো অর্থনীতিতে সঞ্চয়ের চেয়ে বিনিয়োগের হার বেশি হওয়া উচিত। ভারতে ২৮ ভাগ সঞ্চয়ের বিপরীতে বিনিয়োগের হার প্রায় ৩৩। এর মূল কারণ ওদের সঞ্চয়পত্রে উদ্ভট উচ্চ হার নেই। বিনিয়োগের এই একটু বাড়তি চাহিদা—যাকে কিনস সঞ্চয়-বিনিয়োগ ফারাক বলছেন—অর্থনীতিকে এগিয়ে যেতে তাড়িত করে। এই তাড়না বাংলাদেশে প্রবল নয় বলেই জিডিপির অংশ হিসেবে ব্যক্তিবিনিয়োগ ওই ২২ থেকে ২৩ ভাগে অশ্ব অক্ষাংশের মতো স্থবির হয়ে আছে বছর দশেক। এই স্থবিরতা ভবিষ্যৎ নিয়োগ বৃদ্ধির জন্য শুভ নয়।

অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, সুদহারকে নয়-ছয়ের ছকে আটকে না রাখলে ওটা ২০ থেকে ২২ ভাগ উঠে যেত। এর কোনো সমীক্ষা বা গবেষণাগত প্রমাণ নেই। এটা হবে কেন? ঋণের বাজার তো প্রতিযোগিতামূলক। সুদের হার অত তুললেই ব্যবসায়ীরা ঋণ নেবেন কেন? তাঁদের তো বাইরের স্বল্পহারে ঋণ নেওয়ারও সুযোগ আছে। ভারতে তো নয়-ছয়ের হাতকড়া নেই। কই, তাদের গড় ঋণহার তো ১০ ভাগও ছোঁয়নি। আসলে বাজারব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস বা অজ্ঞতার কারণে একের পর এক উদ্ভট সুদহার সৃষ্টি করা হয়েছে নানা জাতের বেড়াজাল দিয়ে। এসবই নব্বইয়ের শুরুতে গৃহীত আর্থিক মুক্তায়ন বা ফাইন্যান্সিয়াল ডিরেগুলেশনের পরিপন্থী।

সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ বসানোর ফল যে ভালো হয় না, তার প্রমাণ সাম্প্রতিক ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এত দিনে বিনিময়ের হার বাজারের হাতে সঁপে দেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতির আগুন অন্তত কিছুটা নির্বাপণ করতে হলে ঋণ ও আমানতের সুদহারগুলোকেও নয়-ছয়ের হাতকড়া খুলে দিয়ে বাজারের হাতে সঁপে দিতে হবে। বেশি দেরি হলে আর্থিক স্থিতিশীলতায় অনেক বেশি ঝাঁকুনি খেতে হবে। পরিস্থিতি যেন সত্তরের দশকের দিকে না গড়ায়।

ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ