বিএফআইইউ কি অর্থ পাচার রোধ করতে পারছে

২০১৫ সালের ১১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি জারিকৃত একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ সংশোধন করা হয়েছিল। অধ্যাদেশটি আইনে প্রণীত হয় ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর। সংশোধিত এ আইনের অধীনই বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট গঠিত হয়। সংস্থাটি বিএফআইইউ নামে বেশি পরিচিত।

মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের মতো আর্থিক অপরাধ প্রতিরোধ করতে অনুসন্ধান বা তদন্তের প্রয়োজন পড়ে। এ ক্ষেত্রে বিএফআইইউর ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যে কাজগুলো বিএফআইইউর এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে, তা হচ্ছে আর্থিক অপরাধসংক্রান্ত তথ্য ও প্রতিবেদন সংগ্রহ করা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে তথ্য বিশ্লেষণ ও বিনিময় করা এবং মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন চিহ্নিত করা।

আরও পড়ুন

বিএফআইইউর গঠন

আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পাদনের লক্ষ্যে বিএফআইইউ একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে কাজ করে। এর একটি স্বতন্ত্র কার্যালয় বাংলাদেশ ব্যাংকে অবস্থিত। কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় অফিসস্থান, লোকবল, তহবিল, প্রশাসনিক সুবিধাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় সরবরাহ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে থাকবেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে গঠিত বাছাই কমিটির মাধ্যমে নির্ধারিত শর্ত অনুযায়ী সরকার কর্তৃক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাবেন।

প্রধান কর্মকর্তা যাবতীয় প্রশাসনিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করবেন। প্রধান কর্মকর্তা মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করবেন। তাঁর চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদায়ন করতে পারবে। প্রয়োজন অনুযায়ী আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সরকারি অন্য কোনো সংস্থা থেকে প্রেষণে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের জন্য সরকারকে অনুরোধ করতে পারবে।

আরও পড়ুন

মানিলন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ প্রায়ই ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করে সংঘটিত হয়। এ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমঝোতার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একত্রে মিলিত হয়েও কাজ করে। যদি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতা ও তথ্য বিনিময়ের ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে আইনি কঠোরতাও অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।

মানিলন্ডারিং অপরাধ থেকে অর্জিত অর্থের মূল উৎস গোপন করে বৈধ অর্থ বাজারে প্রবেশ করানোর উদ্দেশ্যে নানা ধরনের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। তারা অর্থের প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, স্থানান্তর ইত্যাদি গোপন করতে চায় এবং এরূপ অর্থপ্রাপ্তির পেছনের অপরাধমূলক ইতিহাস চিরতরে মুছে ফেলতে চায়। যারা সন্ত্রাসে অর্থায়নে আগ্রহী, তারাও অর্থের উৎস ও বেআইনি ব্যবহারের প্রমাণ লুকিয়ে ফেলতে চায়। তাদের খুঁজে বের করতে না পারলেও মানিলন্ডারিং আইন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে।

বিএফআইইউ দেশে বিদ্যমান আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে এবং মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধের লক্ষ্যে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের (যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন, সিআইডি ইত্যাদি) কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদান বা বিনিময় করে।

বিএফআইইউ প্রয়োজন অনুসারে বিদেশের বিভিন্ন সরকার বা অন্য কোনো দেশের একই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে প্রয়োজনীয় তথ্য বিনিময় করে থাকে। আর্থিক অনুসন্ধান বা তদন্তের মূল লক্ষ্য হচ্ছে অবৈধ অর্থের সন্ধান ও চিহ্নিত করা, এর গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য আহরণ করা এবং অপরাধমূলক কাজের জন্য আদালতের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

আর্থিক তদন্তের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে অপরাধী কর্তৃক রেখে যাওয়া আর্থিক লেনদেনের চিহ্ন-রেখা খুঁজে বের করা। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তদন্তকারীরা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব ও লেনদেনের নথি রেকর্ড, স্থাবর সম্পদের রেকর্ড, লিয়েনে রাখা নথি, ব্রোকার ও মিউচুয়াল ফান্ডের হিসাব, বিমা চুক্তি এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক লেনদেন বিবেচনায় নেন।

বর্তমানে আর্থিক খাতের অপরাধীরা নতুন নতুন কৌশলে অপরাধ করে চলেছে। এ জন্য প্রচলিত পন্থায় তদন্ত না করে আধুনিক পদ্ধতিতে আর্থিক অপরাধের তদন্ত করা দরকার। মানিলন্ডারিং একটি আন্তরাষ্ট্রীয় ও সদা পরিবর্তনশীল প্রকৃতির অপরাধ। তদন্তকারী সংস্থা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নিরিখে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ ধরনের তদন্ত করবে—এটাই প্রত্যাশিত।

আরও পড়ুন

তথ্য আহরণ

দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে অনুমোদিত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্দেশিত হলে একটি দেশের ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা প্রতিষ্ঠান, মানিচেঞ্জার, স্টক এক্সচেঞ্জ, মূল্যবান ধাতু ব্যবসায়ী, অনুমোদিত জুয়া কেন্দ্র, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ও অন্যান্য আর্থিক সংস্থা বা আর্থিক বাজারের সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাকে সব অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক লেনদেনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে বিএফআইইউর কাছে রিপোর্ট করতে হয়। ফলে বিএফআইইউ একটি দেশের আর্থিক লেনদেনের তথ্যাদি গ্রহণ ও সংরক্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার কথা। এতে দেশের সব আর্থিক লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ করে সন্দেহজনক বিষয়াদি সম্পর্কে অনুমান করা সম্ভব হয়।

সন্দেহজনক লেনদেন

সন্দেহজনক লেনদেনের অপর নাম অস্বাভাবিক লেনদেন। অর্থাৎ স্বাভাবিক লেনদেনের ধরন থেকে ভিন্ন। কোনো অপরাধমূলক কার্যক্রম থেকে অর্জিত সম্পদ বা যা সন্ত্রাসে অর্থায়ন, তা-ই সন্দেহজনক লেনদেন। যদি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সন্দেহ হয় বা সন্দেহ করার মতো যুক্তিসংগত কারণ থাকে যে লেনদেনকৃত অর্থ অপরাধ থেকে উদ্ভূত হয়েছে বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন-সংশ্লিষ্ট, তাহলে বিষয়টি সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে বিএফআইইউকে রিপোর্ট করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিছু কিছু ঘটনা বা লেনদেনের উদ্ভব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বা একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর রিপোর্টিং প্রতিষ্ঠানগুলো বিএফআইইউকে প্রতিবেদন দেয়।

তথ্য বিশ্লেষণ

বিএফআইইউ কর্তৃক দেশের সব ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় রিপোর্ট গৃহীত হওয়ায় এগুলোর মধ্য থেকে সন্দেহজনক লেনদেন খুঁজে বের করা সুবিধাজনক। তবে প্রাপ্ত অস্বাভাবিক অথবা সন্দেহজনক লেনদেন ও অসংগতিপূর্ণ তথ্যের অধিকাংশই প্রকৃতপক্ষে মানিলন্ডারিং বা সন্ত্রাসে অর্থায়নের সঙ্গে সম্পর্কহীন হতে পারে। আবার উল্টো দিকে আপাতদৃষ্টে খুব সাধারণ ও নির্দোষ বলে অনুমিত জমা, উত্তোলন, তহবিল স্থানান্তর, সিকিউরিটি ক্রয় বা বিমা পলিসি ক্রয় বড় অঙ্কের মানিলন্ডারিং বা সন্ত্রাসে অর্থায়নের প্রাথমিক তথ্য হতে পারে।

কোনো লেনদেন অপরাধীদের দ্বারা সংঘটিত লেনদেন কি না, তা কেবল বিএফআইইউ কর্তৃক তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমেই বুঝতে পারা সম্ভব। আবার অপরাদের গুরুত্ব অনুসারে সন্দেহজনক বিষয়গুলো সাজানোর জন্যও বিশ্লেষণ একান্ত প্রয়োজন। বিশ্লেষণ ব্যতীত আধুনিক পন্থায় আহৃত উন্নত মানের তথ্যও অর্থহীন হয়ে যায়।

বিএফআইইউ কর্তৃক দক্ষতার সঙ্গে তথ্য বিশ্লেষণ করার জন্য আইনগত ক্ষমতা ও যথাযথ মানবসম্পদের প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ডেটাবেজে প্রবেশাধিকার, সরকারি সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করার ক্ষমতা ও রিপোর্টিং প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় যেকোনো রকম তথ্য সংগ্রহের অধিকার বিএফআইইউর থাকতে হবে। তদন্তকারীদের আধুনিক গোয়েন্দা অনুসন্ধানের কৌশল জানতে হবে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার থাকতে হবে। একই সঙ্গে আর্থিক খাতের গোপনীয়তার নীতির সঙ্গে বিএফআইইউর তথ্য আহরণ ও বিশ্লেষণের প্রক্রিয়া সমন্বিত হতে হবে।

বিএফআইইউর সক্ষমতা

অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ কতটা সফল, তা অনেকাংশেই নির্ভর করছে বিএফআইইউর সক্ষমতার ওপর। প্রয়োজনে বিএফআইইউকে শক্তিশালী করার জন্য আরও ক্ষমতা দিতে হবে, নিজস্ব তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করতে হবে এবং সময়ে সময়ে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুসারে গোপনীয়তা রক্ষা করে জনগণকে তথ্য জানাতে হবে। এর কারণ হলো, অনেক মানুষের ধারণা, বাংলাদেশ টাকা পাচার প্রতিরোধ করতে পারছে না। এ রকম অবস্থায় বিএফআইইউ যে অর্থ পাচার প্রতিরোধে সক্ষম—কাজের মাধ্যমে এটা প্রমাণ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

  • মো. খুরশীদ আলম খান সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সম্পাদক, ঢাকা ল রিপোর্ট