রংপুরের নতুন মেয়রের কাছে যে প্রত্যাশা থাকবে

রংপুর সিটি করপোরেশনের বয়স ১০ বছর। এই ১০ বছরে রংপুরের প্রভূত উন্নয়ন হতে পারত। বাড়তে পারত নাগরিকের সেবার মান। গত ১০ বছরের প্রথম ৮ বছর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও অনেক ভালো ছিল। দেশজুড়ে উন্নয়নের অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। দেশে বড় বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিন্তু রংপুরের উন্নয়নচিত্র খুবই হতাশাব্যঞ্জক। গত ১০ বছরের উন্নয়নে রংপুরে নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করার ব্যবস্থাই হয়নি। পৌর সেবার চেয়ে মহানগরের সেবার মান কমেছে।

রংপুর সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন না হওয়ার দায় কি কেবল মেয়রের? সরকারের পক্ষে কি খুব সহায়তা করা হয়েছে? কার্যত রংপুরের উন্নয়নের জন্য দলীয় ও প্রশাসনিক সমন্বয়ের ভীষণ অভাব। বলা যায়, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার পরিবেশই এখানে আছে। ত্বরান্বিত হওয়ার কোনো ক্ষেত্র এখনো প্রস্তুত হয়নি।

সরকারের পক্ষে রংপুর সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল নামমাত্র, নিজস্ব আয় খুব সামান্য। নিজস্ব আয় দিয়ে কোনো উন্নয়ন চিন্তাও করা যায় না। এর ফলে এখানকার উন্নয়নের জন্য সরকারের বিশেষ বরাদ্দ অবশ্যই থাকতে হবে।

মেয়র তাঁর মেয়াদকালে কী কী কাজ করবেন, তিনি শুরুতেই একটি ছক আঁকবেন। কোন মেয়াদে, কোন পর্য়ায়ে, কোন কাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি কাজ করবেন, তার একটি লিখিত পরিকল্পনা রংপুরবাসীর কাছে হাজির করা জরুরি

৫০ বর্গকিলোমিটারের পৌরসভা বেড়ে সিটি করপোরেশনের আয়তন হয়েছে ২০৫ বর্গকিলোমিটার। অতিরিক্ত ১৫৫ বর্গকিলোমিটার পূর্বে ছিল ইউনিয়ন। এগুলো মূলত গ্রাম। এসব অঞ্চলে নাগরিক সুবিধা বাড়াতে হলে অবশ্যই বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে ইউনিয়নগুলোকে নগরের পর্যায়ভুক্ত করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি।

নতুন মেয়র পদে যাঁরা নির্বাচন করছেন, তাঁদের মধ্যে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। জাতীয় পার্টির সদ্য সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান রংপুরের উন্নয়নে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পেরেছেন, এমন কথা বোধ করি তিনি নিজেও বলবেন না। তবে মেয়র থাকাকালে তিনি নিরহংকার চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর অনেক গ্রহণযোগ্যতা আছে। নির্বাচনে সেটি বড় শক্তি হিসেবে কাজ করবে। জাতীয় পার্টির পক্ষে রংপুরের উন্নয়ন কতখানি করা সম্ভব হবে, তা–ও ভাবনার বিষয়। কার্যত এবার নির্বাচনে মূল্যায়ন প্রতীকের বদলে ব্যক্তির ভূমিকার ওপরই নির্ভর করবে।

আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে মেয়র পদে নির্বাচন করছেন হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া। তিনি সংরক্ষিত আসনে এক মেয়াদে সংসদ সদস্য ছিলেন। সেই সময়ে তিনি রংপুরে উল্লেখযোগ্য কিছু করেছেন, এমন দৃষ্টান্ত নেই। আইনজীবী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়াও সদালাপী ও মিশুক।

যাঁরা তাঁকে চেনেন-জানেন, তাঁরা কেউ তাঁর নিন্দা করবেন না। তিনি নির্বাচিত হলে খুব বেশি কিছু করতে পারবেন, এমন আশা করাও কঠিন। তবে সরকারি দল পরিচয়ে হয়তো কিছুটা কাজ করা সম্ভব। আওয়ামী লীগ সরকার চলতি মেয়াদে আর এক বছর আছে।

রংপুরের উন্নয়নের পথ কী—এটাই সাধারণ প্রশ্ন হিসেবে দেখা যায়। যিনিই নির্বাচিত হোন না কেন, এ বছর এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে হবে। দেশের রংপুর অঞ্চল ছাড়া আর সব অঞ্চল সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, তারা দলমত–নির্বিশেষে নিজেদের এলাকার উন্নয়নের প্রসঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই ঐক্যবদ্ধ। আমাদের নতুন মেয়রের প্রধানতম কাজ হবে এই ঐক্য সৃষ্টিতে সমন্বয় সাধন করা। মেয়র রংপুর সিটি করপোরেশনের স্বার্থ দেখবেন। রংপুর জেলা প্রশাসন, বিভাগীয় প্রশাসন এবং সংসদ সদস্য-মন্ত্রীদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবেন। সরকারদলীয় আর বিরোধীদলীয় বিষয়টি ভাবা সমীচীন হবে না। রংপুর সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে রংপুর আসনের সংসদ সদস্য অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারতেন। কিন্তু রংপুরের জন্য দুর্ভাগ্যজনক; জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত রংপুরের সংসদ সদস্যের সঙ্গে রংপুরের কোনো সম্পর্ক দৃশ্যত নেই।

রংপুর নগরের উন্নয়নে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ আছে। চোখের সামনে শ্যামাসুন্দরী নদী (খাল নামে প্রচলিত) মরতে বসেছে, দখল–দূষণ আর অযত্নেœ হাঁসফাঁস করছে, অথচ নির্বিকার সিটি করপোরেশন। পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার কার্যকর উন্নতি সাধন করাও কঠিন কাজ হবে। পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা দিন দিন অকার্যকর হয়ে উঠছে। ময়লা-আবর্জনারও কোনো ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। অনিবার্য চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খেয়েছে অতীত প্রশাসন। নতুন মেয়রের এসব কাজ করতেই হবে।

নতুন সিটি করপোরেশন হিসেবে এখানকার সব উন্নয়নের কাজই বাকি। আবাসন, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ কোনো সেবার মান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার উপায় নেই। সেবার মান বাড়ছে পিপীলিকার গতিতে। আর শহরে জনগণ বাড়ছে বর্ষার জলের মতো। এ কারণে বিদ্যমান সেবাব্যবস্থাও ভেঙে পড়ছে।

রংপুর সিটি করেপারেশন নির্বাচনে নাগরিকদের আগ্রহ খুবই কম। এর প্রধান কারণ, সেবার মান বৃদ্ধি না হওয়া। যিনি নতুন মেয়র হবেন, তিনি এ বছর যেন একটি দিনও নষ্ট না করেন। দেশ-বিদেশের আদর্শ শহরের খবর নিতে পারেন। রংপুরের সবচেয়ে কাছের সিটি করপোরেশন রাজশাহী। প্রয়োজনে সেই সিটি করপোরেশনের উন্নয়নচিত্র দেখে আসতে পারেন। মেয়র তাঁর মেয়াদকালে কী কী কাজ করবেন, তিনি শুরুতেই একটি ছক আঁকবেন। কোন মেয়াদে, কোন পর্য়ায়ে, কোন কাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি কাজ করবেন, তার একটি লিখিত পরিকল্পনা রংপুরবাসীর কাছে হাজির করা জরুরি।

সরকারের কাছ থেকে টাকা বের করে আনতে পারাও একটি বড় কাজ। একটি কথা আমাদের সবারই মানতে হবে, রংপুরের উন্নয়নে বাধা হয়ে থাকেন দেশের অন্য এলাকার রাজনীতিক, আমলা।

এই বাধার জাল ভেদ করে রংপুরের মাটিতে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের এমন মেয়র প্রয়োজন, যিনি সব পক্ষের মধ্যে ভালো সমন্বয় করবেন। বাধা অতিক্রম করে সরকারের কাছ থেকে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে তা নাগরিক সেবায় ব্যয় করবেন।

২৭ ডিসেম্বর নির্বাচন। এই নির্বাচন সুষ্ঠু হোক। জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটুক। নবনির্বাচিত মেয়র কেবল জনগণের বন্ধু নয়, চাহিদাভিত্তিক সেবাদানে সফল হোক। বাংলাদেশের গরিব বিভাগের বিভাগীয় শহর এবং অন্যতম গরিব জেলা রংপুরের প্রশাসনিক কার্যালয় রংপুর। সরকার এই পিছিয়ে পড়া রংপুরের উন্নয়নে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা অতীতে গ্রহণ করেনি। আগামী দিনে সদিচ্ছায় করবে, এমন আশা নেই। সেই আশাহীন ভবিষ্যতে মেয়রকে উন্নয়নের মশাল জ্বালতে হবে। বৈধভাবে যিনিই মেয়র হোন না কেন, তাঁকে আগাম অভিনন্দন।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

[email protected]