ফজলুল্লাহর সৌভাগ্যের জাদুমন্ত্রটি কী

‘এ কে এম ফজলুল্লাহর খুঁটির জোরটি কোথায়, কেনই-বা বারবার তাঁকেই অবিকল্প ভাবা হচ্ছে, এর কোনো সদুত্তর পাওয়া সত্যি মুশকিল।’

কর্মক্ষেত্রে এমন কিছু সাফল্য দেখাতে পারেননি তিনি। চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে ব্যর্থতার পাল্লাটাই বরং ভারী। তাই ১৪ বছর ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে থাকার পরও ৮১ বছর বয়স্ক ব্যক্তিটিকে একই পদে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হলো কেন, এ নিয়ে বিস্ময়ের অন্ত নেই জনমনে। এ কে এম ফজলুল্লাহর খুঁটির জোরটি কোথায়, কেনই-বা বারবার তাঁকেই অবিকল্প ভাবা হচ্ছে, এর কোনো সদুত্তর পাওয়া সত্যি মুশকিল।

এ রহস্যের সুরাহা হয়নি খোদ ফজলুল্লাহ সাহেবের কথায়ও। প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, ‘অভিজ্ঞতা ও কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে সরকার মনে করছে, আমাকে দায়িত্ব দিলে প্রকল্পের কাজগুলো ঠিকভাবে শেষ হবে। কারণ, প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া আমার জানা।’

ফজলুল্লাহর কথা অনুযায়ী, অভিজ্ঞতাই যদি হবে পুনর্নিয়োগের অন্যতম কারণ, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তাঁর আগে চট্টগ্রাম ওয়াসার যেসব কর্মকর্তা নির্দিষ্ট সময়ান্তে অবসরে গিয়েছিলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কখনো কাজে লাগানোর উদাহরণ আছে কি না। প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া তাঁর জানা বলে যে দাবি তিনি করছেন, সেটি নিয়েও তো প্রশ্ন উঠবে।

ওয়াসা সরকারের একটি বড় সংস্থা। দক্ষ জনবল দিয়ে সেটি পরিচালিত হয় বলেই আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু এই সংস্থার হাতে থাকা সব প্রকল্প বাস্তবায়নের উপায় কেবল একজনই জানেন এবং সেই গোপন কুঠুরির চাবিটি তাঁর হাতেই আছে, এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে তো প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এমনকি চাকরিতে নিজের মেয়াদকাল পূর্ণ করার পর আরও ১৪ বছর কর্মরত থেকেও তিনি যে একজন যোগ্য উত্তরসূরি তৈরি করতে পারলেন না, এই দায়ও তো বর্তায় তাঁর কাঁধে।

আরও পড়ুন

আমাদের দেশে সাধারণত রাজনৈতিক পরিচয় ও দলীয় আনুগত্যের হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে সরকারি সংস্থায় পদ-পদবি বাগানোর বা পদে বহাল থাকার রেওয়াজ আছে।

কিন্তু এ কে এম ফজলুল্লাহর সে রকম কোনো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড যেমন খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি অত্যুৎসাহী হয়ে সরকারদলীয় সভা-সমাবেশে যোগ দিয়ে স্তুতি-বন্দনা করার ইতিহাসও নেই। তা সত্ত্বেও একবার-দুবার তো নয়, সাত দফায় ১৪ বছর একই পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এবার আরও ৩ বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে তাঁর কর্মজীবনের মেয়াদ। তাহলে তাঁর সৌভাগ্যের জাদুমন্ত্রটি কী?

শুধুই দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা? পরিসংখ্যান তো সে রকম বলে না। পাঁচ বছর আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, দুই বছরের মধ্যে (অর্থাৎ ২০২০ সালে) চট্টগ্রামবাসী ২৪ ঘণ্টা নিরাপদ পানি পাবেন। সেই সময়সীমা পেরিয়েছে তিন বছর আগে। ২৪ ঘণ্টা তো দূরে থাক, দিনে দু-চার ঘণ্টা পানিও পাওয়া যায় না, এমন এলাকা চট্টগ্রামে বরং বেড়েছে। আর ‘নিরাপদ’ ব্যাপারটা তো প্রমাণসাপেক্ষ। তবে এটুকু বলা যায়, লবণাক্ত পানি পান ও ব্যবহার করা এ অঞ্চলের মানুষ প্রায় নিয়তি নির্ধারিত হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

আটবার একজনের মেয়াদ বাড়ানো হলে, বিশেষত তিনি যদি ৮১ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তি হন, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটিকে অস্বাভাবিক মনে হতে বাধ্য। আগেই বলেছি, তাঁর সৌভাগ্যের জাদুমন্ত্রটি আমাদের অজানা। এমনকি রাজনীতি বা দলীয় সম্পৃক্তির অভিযোগও ওঠেনি তাঁর বিরুদ্ধে।

পাঁচ বছর আগের দেওয়া ঘোষণা বাস্তবায়িত হলো না কেন, এ প্রশ্নের উত্তরে একটি সংবাদমাধ্যমে খুবই সাদামাটা একটি উত্তর দিয়েছেন ফজলুল্লাহ সাহেব। তিনি বলছেন, আমাদের শিল্প ও আবাসিক খাতে চাহিদা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ফলে পাঁচ বছর আগে তিনি যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, তার সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতার মিল নেই। সময়ের সঙ্গে চাহিদার চাপ বাড়ছে, এ ধরনের কথা বলার জন্য তো বিশেষজ্ঞ বা ওয়াসার এমডি হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই চাহিদার কথা মনে রেখেই তো প্রকল্প তৈরি হয়।

দুই বছরের মধ্যে নিয়মিত ২৪ ঘণ্টা পানি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যিনি ব্যর্থ হয়েছেন, তিনি ১৪ বছরে ১৪ দফা পানির দাম বাড়াতে কিন্তু দ্বিধা করেননি। এর মধ্যে গত বছর এক ধাক্কায় ৩৮ শতাংশ দাম বাড়িয়ে নগরবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত করেছেন। তাহলে কী বিবেচনায় পুরস্কৃত (চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি) হলেন তিনি?

আরও পড়ুন

ফজলুল্লাহ যেমন জানেন, আমরাও জানি, মানুষের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে পানির উৎপাদন বৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নিতে হবে। পয়োনিষ্কাশনের প্রকল্প বাস্তবায়নও ওয়াসারই কাজ। এসব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একইভাবে একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কর্মকাল অতিবাহিত হলে অন্য একজন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন, এটাও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু আটবার একজনের মেয়াদ বাড়ানো হলে, বিশেষত তিনি যদি ৮১ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তি হন, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটিকে অস্বাভাবিক মনে হতে বাধ্য। আগেই বলেছি, তাঁর সৌভাগ্যের জাদুমন্ত্রটি আমাদের অজানা। এমনকি রাজনীতি বা দলীয় সম্পৃক্তির অভিযোগও ওঠেনি তাঁর বিরুদ্ধে।

২০০০ সালে অবসরে যাওয়া মানুষটিকে আট বছর পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কেন চাকরিতে ফিরিয়ে আনা হলো, এ রহস্যের অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, লাহোরে পড়াশোনা করার সময় একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের দুই বছরের জুনিয়র ছিলেন তিনি। ধারণা করি, তখন থেকে দুজনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল।

পরবর্তীকালে দল ক্ষমতায় এলে হয়তো মোশাররফ হোসেনের এই করিতকর্মা ব্যক্তিটির কথা মনে পড়ে বা তিনি নিজে এসেও পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে মন্ত্রীর কাছে দেনদরবার করেন। এতে তাঁর অবসর থেকে ফিরে আসার পথ সুগম হয়। এসবই অনুমানের কথা।

তবে সেই পুরোনো সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় ফজলুল্লাহ সাহেব এখনো টিকে আছেন, এ কথা মনে করার তেমন ভিত্তি নেই। বরং সনাক-টিআইবির চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি যে বললেন, এ কে এম ফজলুল্লাহকে যাঁরা নিয়োগ দেন, তাঁদের সন্তুষ্ট রাখার কাজে তিনি পারদর্শী। বোর্ডের সদস্যদেরও তিনি সন্তুষ্ট রাখতে পারেন। এ কারণে পানির সংকট দূর করতে না পারলেও পুনর্নিয়োগে কোনো অসুবিধা হয় না, এ কথাকেই সত্য বলে মনে হয়।

বিস্ময়কর কোনো সাফল্য না থাকলে ৮১ বছর বয়সী একজনকে একই পদে পুনর্বহাল করাটাই বিস্ময়কর। তদুপরি এই নিয়োগ অনেক তরুণ-মেধাবী কর্মকর্তাকে হতোদ্যম করবে বলেই মনে করি আমরা।

  • বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক