এজমালি গোচারণ ভূমি: মহেশ এখন কোথায় কেমন আছে?

‘গবাদিপশু হচ্ছে কৃষকের সঞ্চয়। যিনি গরু-ছাগল কিনতে পারেন না, তিনিও এসব পশু আধি করেন।’ছবি সৌজন্য: মো. রাফি

এক.

গেল বছর বন্যা হলো

এই বছরে খরা

খেতে ফসল ভাসিয়ে নিল

মাঠ শুকিয়ে মরা

এক মুঠো ঘাস পায় না মহেশ

দুঃখ ঘোচে না

তুমি জানো না-

গানটা লিখেছেন ভূপেন হাজারিকা।

যেসব জমির মালিক ব্যক্তি নয় এবং যেসব জমি সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের অধীনে থাকে, সেসব জমিকে খাসজমি বলা হয়। এই ধরনের জমিগুলো সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রণে থাকার ফলে কোনো প্রকার কর বা খাজনা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। সরকার এই ধরনের জমিগুলো সরকারি প্রয়োজনে ব্যবহার করে থাকে। সেই ব্যবহারগুলো হলো ভূমিহীনদের বরাদ্দ দেওয়া ও রাষ্ট্রীয় স্থাপনা নির্মাণ ইত্যাদি। কোথাও বন বা গোচারণ ভূমি ব্যবহারের কথা উল্লেখ নেই।

৮২ সাল। চিলমারীতে ভূমিহীনদের মাঝে জমিদান কার্যক্রম খুব সফলতার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। রেডিও-টিভিতে এই খবর দেখে সত্যাসত্য জানতে মোনাজাতউদ্দিন এসেছেন। গ্রামে যাবেন। তার আগে দরকার প্রাথমিক কিছু তথ্য। যেমন কতটুকু জমি বিতরণ হয়েছে, কারা পেয়েছে, তাদের নাম–ঠিকানা এই সব আরকি।

এসব খুঁজতে প্রথমে গেলেন সার্কেল অফিসার রাজস্বর কাছে। কিন্তু সার্কেল অনুপস্থিত। কর্মচারীরা কিছুতেই তালিকা দেবেন না বসের নির্দেশ ছাড়া। তাঁরা উল্টো প্রশ্ন করেন, তালিকার কী দরকার, জমি দেওয়া হয়েছে এটাই যথেষ্ট।

তারপর নানা কায়দাকানুন করে তালিকা উদ্ধার করলেন। তারপর গ্রামে গিয়ে জানলেন। চিলমারীতে কতটুকু খাসজমি বিতরণ করা হয়েছে তা হলো:

ক. মাজেদুল হক, কথিত ভূমিহীন। গ্রামের নাম পাটোয়ারী। পেশায় নাপিত। নিজের আছে এক বিঘা। সরকারি জমি পেয়েছেন ৩২ শতক। সেই জমি ভোগ করছেন গ্রাম-সরকারপ্রধান।

খ. কথিত ভূমিহীন আজরউদ্দিন। মাজারটারীর বাসিন্দা। পেশায় মসজিদের মুয়াজ্জিন ও কৃষক। নিজের আছে ৯ বিঘা। সরকারি জমি পেয়েছেন ২৭ শতক। জমি ভোগ করছে একটি মসজিদ কমিটি।

গ. রিয়াজুল হক। মাচাবান্ধা গ্রামে বাড়ি। নিজের জমি আছে পাঁচ একর। কৃষিজীবী। সরকারি জমি পেয়েছেন দেড় একর। ভোগ করছেন এক আত্মীয়।

ঘ. আবদুল আউয়াল। গ্রাম মাচাবান্ধা। নিজস্ব আছে আড়াই বিঘা। কৃষিজীবী। সরকারি জমি পেয়েছেন ৩০ শতক। জমি ভোগ করছেন নিজেই।

চিলমারী একযুগ বইতে মোনাজাতউদ্দিন লিখেছেন, বিরাশিতে চিলমারীতে আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ হাজার একর। কৃষি বিভাগ সে সময় বলেছিল, ওই ১০ হাজার একর জমিতেই বিভিন্ন খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিকল্পনা তারা নিয়েছে এবং অচিরেই তার কাজ শুরু হয়ে যাবে। চুরানব্বইতে দেখলাম, কথিত ওই উৎপাদন বাতাসে মিলেছে। আবাদযোগ্য কোনো পতিত জমিই চাষাবাদের আওতায় আসেনি, বরং ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হয়েছে আরও কিছু আবাদি জমি।

ব্রহ্মপুত্র নদের একটি চরে গোচারণভূমি। কুড়িগ্রাম
ছবি সৌজন্য: মো. মেহেদী

দুই.

পাবনা ও সিরাজগঞ্জের খামারিরা ৫ ডিসেম্বর ডেইলি স্টার–এ প্রকাশিত রিপোর্টে জানান, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় তাঁরা ব্যবসা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার রামখারুয়া গ্রামের খামারি মো. রাজু আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গোখাদ্যের দাম বাড়ছে। প্রতি বস্তা ব্রানের দাম ১ হাজার ৮০০ টাকা। এক মাস আগেও এর দাম ছিল ১ হাজার ৭০০ টাকা। গোখাদ্যের দাম বাড়লেও মাংসের দাম কমছে। আমরা খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি মণ মাংস উৎপাদনে আমাদের ২৪-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। পাচ্ছি ২০-২২ হাজার টাকা। খামার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।’

রাজু গত মাসে পাঁচ লাখ টাকায় ১০টি ছোট গরু বিক্রি করেছেন। গোখাদ্যের খরচ হিসাব করলে তাঁর এক লাখ টাকা লোকসান হয়েছে বলে জানান তিনি।

রাজু আরও বলেন, ‘যদি খামার টিকিয়ে রাখতে চাই তাহলে প্রচুর খরচ। সেই টাকা তুলতে পারব কি না, তা অনিশ্চিত। পশু পালনের খরচ তুলতে কয়েকটি গরু বিক্রি করেছি।’

গবাদিপশু হচ্ছে কৃষকের সঞ্চয়। যিনি গরু-ছাগল কিনতে পারেন না, তিনিও এসব পশু আধি করেন। ডাঙ্গা বা কায়েম এলাকার লোকেরা চরবাসীর কাছে গবাদিপশু আধি দিতেন। বাছুরকে বড় করে বিক্রি করে সমান ভাগ কিংবা গাই বাছুর হলে তাকে বড় করে গাভি করে বাছুর ভাগ করে নিতেন। চরাঞ্চলে গবাদিপশুর খাবার কিনতে হতো না। যাঁর জমি নেই এভাবে তাঁরও দুটো গরু, কয়েকটা ছাগল-ভেড়া থাকত।

৬৩ শতক জমিতে বছরে দুবারে মোট ইউরিয়া লাগে ১২০ কেজি। আর একটি গরু বছরে ৩ হাজার লিটার মূত্র দেয়। যার সঙ্গে ৯ গুণ পানি মিশিয়ে ইউরিয়ায় পরিণত করা যায়। মানে একটা গরু ২৭ হাজার লিটার প্রাকৃতিক ইউরিয়া সার দেয়। আর সমপরিমাণ গোবর তো আছেই। গরু, মহিষ এমন প্রাণী যারা কয়েক ঘণ্টাতেই সার উৎপাদন করতে পারে। পৃথিবীতে এমন প্রযুক্তি এখনো আসেনি, যা এত কম সময়ে সার প্রস্তুত করতে পারে। তাই কৃষকমাত্রই গোলা ভরা ধানের সঙ্গে গোয়াল ভরা গরুর উপমা ব্যবহৃত হয়।

এই গবাদিপশুগুলো এজমালি জমি কাশিয়া খেতে (কাশবন) ঘুরে ঘুরে পেট ভরাতেন। এখন এই এজমালি সম্পত্তি বা কাশিয়া খেত বণ্টিত হয়ে চাষের আওতায় এসেছে। অবস্থাপন্নরা জমিতে বিদেশি ঘাসের চাষ করেন। আর গরিবদের তা না থাকায় বাজারের ওপর নির্ভরতা তৈরি হওয়ায় ভাওয়াইয়া গানের ‘বাথান’ হারিয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে চর-নদীর বাস্তুসংস্থান।

ভাস্কর সাভে একজন ভারতীয় কৃষক। তিনি ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে লিখেছিলেন, প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, দেশের মুখ্য জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থাগুলি যদি আমরা ধ্বংস হয়ে যেতে দিই, তাহলে বাকি সবকিছু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। বাস্তুতন্ত্রে ক্যানসার সৃষ্টিকারী উন্নয়ন–এর ফলে জমে থাকা মোটা অর্থ-কয়েক শ কোটি ডলার -এক নিষ্ঠুর পরিহাস।

তিন.

‘প্রাচীনকাল থেকেই পরগণা বাহারবন্দে আমাদের ভিটেমাটি, আদি কৃষকদের বংশধর হিসাবেই আমরা এ জায়গায় বাস করি-পূর্বতন জমিদাররা আমাদের প্রত্যেকের জমির খাজনা ‘ভিতওয়ারি’ হিসাবে ধার্য করতেন আমাদের পরিবার বা বাড়ির আওতার জমি খুদকস্তা বলে বিবেচিত হতো এইভাবে শুখা-হাজার সময়, অথবা খারাপ বা পতিত জমির বিচার অনপেক্ষেই আমরা একটি নির্দিষ্ট খাজনা সব সময় দিয়েছি। চাঁদ রায় থেকে রানি ভবানীর সময় অর্থাৎ পরপর পাঁচজন জমিদারের আমলে জমির মাপজোখ হয়নি।’

—এটি একটি আরজি। কৃষ্ণকান্ত নন্দী যখন সারা জমিদারি মাপজোখ করতে চান আর জমার পরিমাণ ঠিক করেন ৩ লাখ টাকা, তখন প্রীতম দাসের নেতৃত্বে বাহারবন্দের (বাহারবন্দ পরগণা সীমানা ছিল বর্তমান ভূরুঙ্গামারী থেকে চিলমারী পর্যন্ত) রায়তরা কোম্পানির কাছে ওপরের আরজিটি পেশ করেন।

তাঁদের মতে, ১১৯০ সাল (১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত কৃষ্ণকান্ত নন্দী তথা লোকনাথ নন্দী নাকি এই বন্দোবস্তে রাজি ছিলেন। তখন প্রজারা দরবার খরচা ইত্যাদি মাথট দিত। তাঁরা বলেন, কিন্তু ‘এখন সমস্ত প্রথালংঘনকারী লোকনাথ আমাদের জমির সাধারণ জরিপের (a general measurement) বন্দোবস্ত করেছেন। আপনারা দেশের প্রভু আর আমরা গরিব রায়ত। আমরা আশা করি যে, আপনারা জমি জরিপ স্থগিত রাখবেন আর আমাদের পূর্ব পদ্ধতিতে পূর্ব-নির্ধারিত জমা দিতে অনুমোদন করবেন।’

ফলে বাহারবন্দের (কুড়িগ্রাম জেলা) ‘ধুরন্ধর রায়তেরা’ প্রতিরোধে নেমে পড়ে। তারা মাথট প্রত্যাহারের পরিবর্তে জমি মাপতে দিতে রাজি নয়। হরগোবিন্দ বকশীর নেতৃত্বে তাদের একদল কলকাতায় যায় আর কোম্পানির কাছে ফরিয়াদ করে। অন্যদিকে মফস্বলে কার্তিক মাস থেকেই রায়তেরা খাজনা বন্ধ করে দেয়। মোহন বকশী বলে আরেকজন ভূতপূর্ব ইজারাদার উসকানি দেন আর মনিরাম হাজরা চার পাঁচ শ সশস্ত্র লোকের নায়কপদে বৃত হন।

তিনি কাশিমবাজার রাজপরিবারের আমলাদের পরগনা থেকে মেরে ধরে বের করে দেন এবং খাজনা- প্রদানে ইচ্ছুক রায়তদের ভয় দেখান। কিন্তু সরকারি সৈন্য সব সময় কান্তবাবুর পেছনে মজুত ছিল এবং কান্তবাবুর বিরুদ্ধে বাহারবন্দের প্রজা বিদ্রোহ দমনে কালেক্টর গুডল্যাড সাহেব তাঁর সব শক্তি দিয়েই মদদ দেন।

শুকুর মুহম্মদের পুথির লেখন্দার মানুল্লা মণ্ডলের ‘কান্তনামায়’ এই ঘটনার বর্ণনায় এত যুক্তির বালাই নেই। অবশ্যই বাহারবন্দের প্রজারা ‘খল’, লোকনাথের ভাষায় ‘ধুরন্ধর’ খুদকস্তা প্রজাদের অধিকার প্রসঙ্গে এখানে কোনো উল্লেখ নেই। দোয়ানি পরগনা সৎ প্রজাদের এলাকা আর বাহারবন্দ পরগনা বিদ্রোহী প্রজাদের এলাকা। একটায় হুকুম বরদারি হয়, অপরটার লক্ষণই হচ্ছে হুকুম না ফরমানি করা। ভালো আর মন্দের ফারাক টানার জন্যই বাহারবন্দ পরগনার কথা আসে।

‘কহিলে রাজ্যের বাক্য ষুনিতে লাগে ধন্দ

বরো খল রাজ্য সেহি খল তার প্রজা

খাজনা না দেএ কাখো নাহি মানে রাজা।’

তারও আগে ময়নামতির গানে, গোপীচন্দ্রের গাথায় ‘ধনকাঙ্গালী’ রাজার কথা শোনা যায়। যেখানে পতিত জমিতেও খাজনা নেওয়া হয়। প্রজাপীড়ক রাজাকে নেংটিপরা প্রজারা শাস্তি দেয়।

লেংটি চাপিয়া শাপ দিল সকলে মানিকচান বলিয়া

আঠার বছরের পরমাই ছিল রাজার ফেলাইল টুটিয়া।

বাহারবন্দ পরগণার লড়াইটাই ছিল এই এজমালি জমি নিয়া। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এই লড়াইকে ভুলে গেল!

  • নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক

ই–মেইল: [email protected]