জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২২ উপলক্ষে তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘এই দিনে আমরা ঐতিহ্যগত জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারীর অবদান ও ভূমিকাকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরছি। আদিবাসী নারীরাই ঐতিহ্যগত খাদ্যব্যবস্থা এবং ঐতিহ্যগত ওষুধপত্রসহ বিশেষ জ্ঞানের ধারক। এই নারীরা নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে চ্যাম্পিয়ন। তারা পরিবেশ সংরক্ষণ ও নিজের জাতির মানবাধিকার সুরক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। “কাউকে পেছনে ফেলে নয়”—এই স্লোগান বাস্তবায়ন এবং একটি সমতাভিত্তিক সমাজ ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে হলে আদিবাসী নারীর কণ্ঠকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করতে হবে। আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক যৌথ চ্যালেঞ্জ সমাধানে অবদান রাখতে পারে। আমি সম্প্রতি সুরিনাম সফরে গিয়েছিলাম। এই সফরে আমি প্রথম শিখেছি, কীভাবে আদিবাসীরা রেইনফরেস্ট এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করছে।’
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে সব সদস্য রাষ্ট্রকে জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে বলেন, সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে তাদের ঐতিহ্যগত জ্ঞান বিকাশে ভূমিকা রাখতে হবে, যাতে সবাই উপকৃত হয়।
২.
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে রেজল্যুশন ৪৯/২১৪ গ্রহণ করে ৯ আগস্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং তা পালনের জন্য সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে আহ্বান জানায়। গত ২৮ বছরে বৈশ্বিক পর্যায়ে অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ২০০০ সালে জাতিসংঘে স্থায়ী ফোরাম গঠন, ২০০১ সাল থেকে এ-বিষয়ক স্পেশাল র্যাপোটিয়ার নিয়োগ, ২০০৫-১৪ সালের সময়কালকে দ্বিতীয় দশক হিসেবে পালন, ২০০৭ সালে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র গ্রহণ, ২০১৪ সালে সাধারণ পরিষদের বিশ্ব সম্মেলন আয়োজন এবং এ সম্মেলনে ঐতিহাসিক ‘আউটকাম ডকুমেন্ট’ গ্রহণ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘কাউকে পেছনে ফেলে রাখা নয়’ স্লোগান নিয়ে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ২০৩০ যেসব এজেন্ডা জাতিসংঘ গ্রহণ করেছে, সেখানে আদিবাসীদের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে।
জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের ৯০টি দেশে ৪৮ কোটি ইনডিজিনাস পিপলস বা আদিবাসী রয়েছে। এদের কোনো কোনো দেশে ফার্স্ট নেশনস, এবরিজিনাল, নেটিভ পিপল, ট্রাইবাল, জনজাতি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করা হয়। এসব জনজাতি মানুষ দরিদ্রদের মধ্যেও দরিদ্রতম, অধিকতর প্রান্তিক। তারা ঐতিহাসিকভাবে শোষণ, বৈষম্য, বঞ্চনা ও অবিচারের শিকার, যাকে জাতিসংঘ বলছে হিস্টরিকাল ইনজাস্টিস। করোনার কারণে জনজাতিদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। আমরা করোনার সময় সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলাম, এদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক প্রণোদনা সহায়তা দেওয়া হোক। কিন্তু করোনা-সহায়তা হিসাবে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ বাজেটে রাখা হয়নি। এমনি নানারকম অবহেলা উপেক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা এই দিবস উদ্যাপন করছি।
আমরা শুধু আশা করব, দেশে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার জীবনধারা, মৌলিক মানবাধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতি, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সদস্য রাষ্ট্র, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সবাই আরও বেশি সচেতন হবেন, সংবেদনশীল হবেন। এটিই এই দিবস উদ্যাপনের মূল লক্ষ্য।
দেশের ৩০ লাখের বেশি সংখ্যালঘু জাতির মানুষ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ক্রমাগতভাবে ওদের ভূমি অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। নিজ ভূমিতে পরবাসীতে পরিণত হওয়া এই সব মানুষের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, এখন আত্মপরিচয়, মাতৃভাষা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
৩.
গত বছর মহাসমারোহে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা উদ্যাপন করলাম। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের অপ্রতিরোধ্য যাত্রার নানা গল্প আমরা প্রতিদিন শুনছি। আবার বিশাল বৈষম্য ও অসমতার কথা অনেকে বলছেন। যে মাথাপিছু আয়ের গড় হিসাব আমরা দেখছি, তা কোনোভাবেই পাহাড়ি মানুষ, হাওরাঞ্চলের কৃষক, চা-শ্রমিক, দলিত জনজাতি, প্রতিবন্ধীসহ অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের জন্য সত্য নয়। ওই গানের মতো, ‘এ কেমন রঙ্গ জাদু, এ কেমন রঙ্গ’। প্রায় তিন হাজার ডলারের এই মাথাপিছু আয়ের হিসাব এই সময়ে জনজাতির সঙ্গে এক নিষ্ঠুর পরিহাস।
আমরা বহু বছর ধরে বলে আসছি, জনজাতিদের উন্নয়ন ও অধিকারের বিষয়টি ওদেরই দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হবে। সম্ভব হলে চোখের দেখা শুধু নয়, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে হবে।
দেশের ৩০ লাখের বেশি সংখ্যালঘু জাতির মানুষ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ক্রমাগতভাবে ওদের ভূমি অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। নিজ ভূমিতে পরবাসীতে পরিণত হওয়া এই সব মানুষের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, এখন আত্মপরিচয়, মাতৃভাষা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
৪.
আমরা সব সময় দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজকে সঙ্গে নিয়ে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশের প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলি। দেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিক সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র অনুযায়ী ওদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারসহ সাংবিধানিক স্বীকৃতির মধ্য দিয়েই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়ন ও ১৬৯ নম্বর কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করতে হবে। আর সমতল অঞ্চলের জনজাতির জন্য পৃথক মন্ত্রণালয়সহ ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য অবিলম্বে ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে। বিভিন্ন জনজাতির ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাস কর্তৃক প্রণীত আদিবাসী অধিকার আইন প্রণয়ন করতে হবে। সরকারের প্রতিশ্রুত সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সংখ্যালঘু জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেখানে আস্থাহীনতা ও পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব রয়েছে, সেখানে আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তি রচনায় কাজ করতে হবে।
৫.
এ বছর এই দিবসের মূল সুর, ঐতিহ্যগত জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারীর ভূমিকা। জাতিসংঘসহ বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জ্ঞানের স্বীকৃতি রয়েছে। অতীতে ওদের ছিল বিশাল সভ্যতা। আমরা আজটেক, ইনকা, মায়া সভ্যতার কথা জানি। এই পৃথিবীর নানা খাদ্যদ্রব্য, শিল্প, চারুকলা, নির্মাণসামগ্রী, ওষুধসহ অনেক কিছুর আবিষ্কারক হলো এই আদিবাসী জনগণ বা ইনডিজিনাস পিপলস। হাজার বছর ধরে কঠিন বিশ্বের বুকে তাল মিলিয়ে, সংগ্রাম করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা, বিকাশ ও উন্নয়নের সূচনা তারা করেছিল। তারা জানত কীভাবে পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন করতে হয়। আমাদের দেশেও পাহাড়-পর্বত, বন, নদী, প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি সংরক্ষণে তাদের রয়েছে বিশাল অবদান। সন্তান ও পরিবার লালনপালন, সংস্কৃতি রক্ষা, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীর রয়েছে অসামান্য অবদান। আসুন আমরা এই দিবসে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতির পাশাপাশি উদ্যাপন করি। কাউকে পেছনে না ফেলে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলি।
সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
[email protected]