নটর ডেম কলেজের প্লাটিনাম জয়ন্তীর আনন্দে এগিয়ে যাক আমাদের শিক্ষা

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় ভিন্নধারা প্রবর্তনকারী কলেজের মধ্যে নটর ডেম কলেজ একটি সুপরিচিত নাম। ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষা বিস্তার, মানবিক শিক্ষার্থী তৈরিতে কলেজটি শুধু শিক্ষা দানে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে শিক্ষা–সম্পর্কিত নানামুখী কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। রোমান ক্যাথলিক যাজক দ্বারা পরিচালিত তথা কথিত ছাত্ররাজনীতিমুক্ত পূর্ণাঙ্গ একটি বিদ্যাপীঠ, যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে পরিণত করা হয় সত্যিকার মানুষ হিসেবে। যে সময়ের সঙ্গে সর্বত্র হয়ে ওঠে সংবেদনশীল, সৃজনশীল, দক্ষ ও দায়িত্বশীল মানবিক বিশ্বসমাজের প্রতিনিধি।

একটি ভালো কলেজ শুধু শিক্ষার্থীদের বোর্ড পরীক্ষায় ভালো ফলাফল প্রদান করেই ক্ষান্ত হয় না; বরং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অনুকরণীয়ও হতে পারে। নটর ডেম কলেজের ভালো বৈশিষ্ট্যগুলো অনেক কলেজ শুধু নয়; বরং অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ও অনুকরণ করে শিক্ষার মানোন্নয়ন সাধন করছে। এই কলেজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বহুমাত্রিক ক্লাব। কলেজে শিক্ষার্থী দ্বারা পরিচালিত প্রায় ২৫ থেকে ২৬টি ক্লাব রয়েছে, যার মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষার্থীর নেতৃত্ব বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এসব সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে নটর ডেম বিজ্ঞান ক্লাব, নাট্যদল, বিজনেস ক্লাব, নেচার ক্লাব, চেস ক্লাব, অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব, বিজনেস ক্লাব, মানবিক সংঘ, নেচার স্টাডি ক্লাব, ডিগ্রি ক্লাব, যুব রেড ক্রিসেন্ট, রোটার‍্যাক্ট ক্লাব অব নটর ডেম কলেজ, নাট্যদল, নটর ডেম ইকো অ্যান্ড স্পেস ক্লাব, ইন্টারন্যাশনাল আউটস্ট্যান্ডিং অ্যান্ড রিলেশনশিপ ক্লাব, সাংস্কৃতিক ক্লাব, নটর ডেম ইংলিশ ক্লাব, এথিকস ক্লাব, ফটোগ্রাফি ক্লাব, নটর ডেম আইটি ক্লাব ইত্যাদি।

 এর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম বিজ্ঞান ক্লাব কেন্দ্র হলো রিচার্ড উইলিয়াম টিমের প্রতিষ্ঠিত নটর ডেম সায়েন্স ক্লাব। নটর ডেম ইংলিশ ক্লাবকেও বাংলাদেশে প্রথমই বলা যায়। এ ছাড়া বিতর্কচর্চাবিষয়ক বাংলাদেশের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাব হলো নটর ডেম ডিবেটিং ক্লাব। এসব ক্লাবের মাধ্যমে নটর ডেমের শিক্ষার্থীকে সাংগঠনিকভাবে দক্ষ ও পরমতসহিষ্ণু করা হয়। তা ছাড়া দেশ–বিদেশে বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে এ কলেজের ছাত্ররা অত্যন্ত মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছে।

একটি বিশেষ কারণে নটর ডেম কলেজ অনন্য। অসচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য এই কলেজে কাজের বিনিময়ে অধ্যয়ন কর্মসূচি চালু আছে, যা বাংলাদেশ তথা সারা ভারতেই প্রথম। পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বিনা মূল্যে দরিদ্র ও পথশিশুদের শিক্ষাদান কার্যক্রম নটর ডেম কলেজে ১৯৭২ সাল থেকে চলমান।

 মহান মুক্তিযুদ্ধে নটর ডেম কলেজের অবদান অনস্বীকার্য। এই কলেজের অনেক শিক্ষার্থী সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছিলেন। কলেজের সে সময়ের অধ্যক্ষ রিচার্ড টিম দুর্গত মানুষের সহায়তার পাশাপাশি পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিপক্ষে গিয়ে বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য রিচার্ড টিমকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননায় ভূষিত করে। এদিকে তাঁর একান্ত ইচ্ছায় ১৯৭১ সালে নটর ডেম কলেজ পুরো বছর বন্ধ রেখে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক রেডক্রস তাদের দপ্তর হিসেবে এবং জাতিসংঘের তৎকালীন ৪৪ জন কর্মকর্তা কলেজটিকে তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। যুদ্ধ–পরবর্তী পুনর্বাসন, ত্রাণ ও অবকাঠামো নির্মাণে শিক্ষকতা ছেড়ে একটি বেসরকারি এনজিওতে চাকরি নেন কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টিম।

১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় ফাদার টিম ত্রাণ কার্যক্রম করার লক্ষ্যে ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংস্থা ‘কোর’ গঠন করেন এবং নটর ডেম কলেজ প্রাঙ্গণে প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার মানুষের খাবারের সংস্থান করে দিতেন। এদিকে সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৭ সালে উইলিয়াম টিম এশিয়ার নোবেলখ্যাত বিখ্যাত রামোন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার লাভ করেন।

 এ ছাড়া আমরা ছাত্র থাকাকালে ক্লাস বন্ধ করে ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় পূর্ব ঢাকার নিচু ‘মান্ডা’এলাকার উল্লেখযোগ্য বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে কলেজটি ব্যবহার করা হয়েছে। এসব সামাজিক কাজে কলেজের সম্পৃক্ততা প্রত্যক্ষ করে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা মানবিক ও কল্যাণমূলক কাজে যুক্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা পায়। এ ছাড়া গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ সুবিশাল নান্দনিক ক্যাম্পাসে সহশিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রতিদিনের কুইজ, ল্যাবে হাতে কলমে শিক্ষাদান, শিক্ষাসফর, দেশবরেণ্য শিক্ষক দিয়ে শিক্ষাদান, নিয়মিত বাধ্যতামূলক উপস্থিতি, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ নটর ডেম কলেজের ছাত্রদের বিশ্বের যেকোনো নামকরা কলেজের চেয়ে মেধা, মনন, শিক্ষাদর্শ, যোগ্যতা, মুক্তচিন্তা ও নৈতিকতার দিক বেশ আলাদা ও ব্যতিক্রমীই মনে হবে।

উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনয়নকারী কলেজ হিসেবে নটর ডেম কলেজের সফলতা শুধুই পরীক্ষার ফলাফলেই প্রকাশ পায় না। একটি সত্যিকার ও পূর্ণাঙ্গ আদর্শ ছাত্র তৈরিতে নটর ডেম কলেজ বাস্তবিক অর্থেই অনেকটাই সফল। তবে আরও অনেক পথ এখনো বাকি, পাড়ি দিতে হবে অনাগত ভবিষ্যৎকে, এগিয়ে নিতে হবে জ্ঞাননির্ভর একটি জাতি গঠনের প্রত্যয়ে। বাংলাদেশ বা দেশের বাইরে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না। নটর ডেম কলেজই বাংলাদেশে প্রথম দিককার প্রতিষ্ঠান, যেখানে নটর ডেম ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষাশিক্ষা দেওয়া হয়।

 নটর ডেম কলেজের সব শিক্ষার্থীর জন্য ইংরেজি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করা উচিত। এ ছাড়া নটর ডেম কলেজের একটা বড় অপূর্ণতা হলো, এখানে বিশ্বের নামীদামি কলেজের মতো বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি অন্য একটি বিদেশি ভাষাশিক্ষা কার্যক্রম সহশিক্ষা হিসেবে এখনো চালু হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুধু বাংলা ও ইংরেজির ওপর নির্ভর করলে চলবে না, বরং ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, ডাচ, চাইনিজ, আরবি, কোরীয় ভাষা শেখাও দ্রুতই শুরু করা উচিত। নটর ডেম ডিবেটিং ক্লাব যেমন বাংলাদেশের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাব হিসেবে অগ্রপথিকের মতো দ্যুতি ছড়িয়েই চলছে দিক-দিগন্তে, তেমনি কলেজ পর্যায়ে নটর ডেম থেকেই শুরু হোক বিদেশি ভাষা শেখার প্রয়াস।

বিশ্বব্যাপী হাজারো নটরডেমিয়ানদের কাছে অক্সিজেনস্বরূপ নটর ডেম কলেজ আত্মা ও হৃদয়ের ভেতরকার আবেগ, উচ্ছ্বাস, অনুভূতির অনুরণন। গুণগত মান ও আদর্শিক কারণেই নটর ডেম পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে বিনীতভাবে একটি ব্যক্তিগত অভিমত এ কলেজ–সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এই বলে, নটর ডেম কলেজের শাখা বাংলাদেশের অন্য কোনো জায়গায় দেখতে চাই না। নটর ডেম কর্তৃপক্ষ অন্য কোনো নামে কলেজ প্রতিষ্ঠা করতেই পারে, তবে নটর ডেম নামে কোনো প্রতিষ্ঠান আমরা চাই না।

যা–ই হোক, এ বছরই নটর ডেম কলেজ প্রতিষ্ঠার হীরকজয়ন্তী পালন করছে। হাজারো নটরডেমিয়ানদের কাছে একটি ভীষণ আনন্দের দিন। হয়তো কোনো এক দিন সহস্রতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হবে। তখন আমরা কেউই থাকব না। তখনো হয়তো রয়ে যাবে নটর ডেম কলেজের মানবিক মানুষ তৈরির অন্তহীন এই প্রচেষ্টা। উন্মুক্ত আকাশসংস্কৃতির যুগে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীসহ বাংলাদেশের সব শিক্ষার্থী আদর্শিকভাবে বলীয়ান হয়ে বিশ্বসমাজের পরিপূর্ণ নাগরিক হয়ে উঠবে—এই প্রত্যাশাই করি অহর্নিশ। পরিশেষে কবিগুরুর একটি উক্তি দিয়েই শেষ করতে চাই এই নিবন্ধ, ‘মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীন।’ জয় হোক নটর ডেম কলেজের।

  • শেখ হাফিজুর রহমান উপসচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়