পুরান ঢাকার বিস্মৃত পাঠাগার আন্দোলন

১৯৫২ সালে লালবাগের রাজা শ্রীনাথ রায় স্ট্রিটে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রন্থবিতান পাঠাগার।ছবি: প্রথম আলো

পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকা। দস্যু মোহন বই হাতে মহল্লার ফটিকচাঁদের চায়ের দোকানে বসেছেন তরুণ বইপ্রেমী নাজির হোসেন। দোকানে বসেই অপেক্ষায় থাকা শ্রোতাদের বইটি পড়ে শোনানো শুরু করলেন তিনি। জমজমাট গল্পের টানে বাড়ছিল শ্রোতার সংখ্যা। সবাই মনোযোগ দিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর গোয়েন্দা কাহিনি শুনছেন আর একটু পরপর চায়ের অর্ডার দিচ্ছেন। জমে উঠছে সান্ধ্য আসর।

নাজির হোসেনের চায়ের অভ্যাস ছিল না। ফটিকচাঁদ তাঁকে এনে দিত কাপভর্তি দুধ। অস্বীকৃতি জানালে ফটিকচাঁদ সহাস্যে বলত, ‘খাও, তোমার বই পড়নের লাইগাই তো আমার দোকানে বিক্রি বেশি হইতাছে।’

একটি পাঠাগারের ইতিকথা নামের ছোট্ট বইয়ে এমন বিবরণ পাওয়া যায়। বইটির লেখক নাজির হোসেন নিজেই। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘দোকানির কথায় ও শ্রোতাদের আগ্রহ দেখে সত্যি আমার অন্তরে একটা আনন্দহিল্লোল বয়ে যেত। সেই সঙ্গে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার সংকল্পটা শতরূপে আচ্ছন্ন করে ফেলত আমার মনটাকে।’

গত শতাব্দীর ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে পুরান ঢাকার লালবাগের আমলীগোলা অঞ্চলটি ছিল মুসলমানপ্রধান। আশপাশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে ছিলেন। এ সময় মুসলমানদের মধ্যেও একটু একটু করে সাংস্কৃতিক চেতনা গড়ে উঠছিল নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ থেকে প্রায় ৭৮ বছর আগে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আজাদ মুসলিম ক্লাব। অল্প দিনেই জনপ্রিয় হয়েছিল ক্লাবটি। এই ক্লাবেরই একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আজাদ মুসলিম পাবলিক লাইব্রেরি। এর যাত্রা ১৯৫২ সালের শুরুর দিকে, ভাষা আন্দোলনের চেতনা বুকে নিয়ে।

এককথায় বলা যায়, তখনকার প্রেক্ষাপটে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা ততটা সহজ ছিল না। এই পাঠাগারটির প্রাণপুরুষ ছিলেন পুরান ঢাকার বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী নাজির হোসেন। তিনি খ্যাত তাঁর কিংবদন্তীর ঢাকা গ্রন্থের জন্য।

একটি পাঠাগারের ইতিকথা বইয়ে নাজির হোসেন আরও লিখেছেন, ‘সে সময় আমার কাছে দস্যু মোহন ও অন্যান্য ডিটেকটিভ বই ছিল। অনেক সময় এসব বই মহল্লার লোকজনকেও পড়িয়ে শোনাতাম। সবচেয়ে দুঃখের কথা, বই পড়ে শোনাবার মতো তেমন কোনো ঘরও ছিল না।’

সেই পাঠাগার এখনো টিকে আছে। পাঠাগার নিয়ে নানা গবেষণার সূত্রে আজাদ মুসলিম পাঠাগারে আমাকে বেশ কয়েকবার যেতে হয়েছে। এখানে বইয়ের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। উর্দু বই আছে ৩১৩টি। বাংলাদেশে যে গুটিকয় মানুষ উর্দু সাহিত্য নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা একবার এই পাঠাগারে যেতে পারেন।

পুরান ঢাকা বলতে মানসপটে ভেসে ওঠে ঘিঞ্জি গলি, অসহনীয় যানজট, সড়কের পাশে অপরিসর দোকানে বাকরখানি তৈরির আয়োজন আর বিরিয়ানি–তেহারির ঘ্রাণ। শিক্ষা–সাহিত্য–সংস্কৃতিতে পুরান ঢাকার বাতি যেন টিমটিম করে জ্বলছে। কিন্তু আজ থেকে ৬০–৭০ বছর আগে কয়েকজন ব্যক্তি ও কয়েকটি সংগঠনের দৃঢ় প্রচেষ্টায় গণপাঠাগার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জ্বলেছিল সমাজ পরিবর্তনের মশাল। অতীতের আয়নায় দৃষ্টি রেখে সেই গল্প বলার চেষ্টা করব।

পুরান ঢাকার আরেকটি পুরনো পাঠাগার হলো গ্রন্থবিতান। সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা হয়ে আজিমপুর রোড ধরে সামান্য ভেতরে এগোলেই রাজা শ্রীনাথ রায় স্ট্রিট। এটাই ঠিকানা ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থবিতানের। প্রধান ফটক ঠেলে ভেতরে পা রাখতেই সবুজের স্নিগ্ধ পরশ। দুই পাশে নাতিদীর্ঘ মেহগনি, অর্জুন আর মেহেদি গাছ। প্রায় বৃক্ষহীন পুরান ঢাকার সঙ্গে অনেকটাই বেমানান।

২.

আজাদ মুসলিম পাবলিক লাইব্রেরির পর বলতে চাই আজিমপুর এস্টেট জনকল্যাণ সমিতি পাঠাগারের কথা। পঞ্চাশের দশকে পুরান ঢাকার আজিমপুরে প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারটি এখনো টিকে আছে। তবে এর পেছনে ব্যক্তি উদ্যোগ থেকে সাংগঠনিক উদ্যোগ বেশি ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর সেখানে সরকারি কলোনি নির্মিত হয়। বসবাস শুরুর পর দেখা গেল, সরকারি কর্মকর্তারা কেউ ‘চাঁটগাইয়া’, কেউ ‘বরিশাইল্লা’, কেউ ‘সিলেটি’, কেউ ‘অংপুরের’ (রংপুরের), কেউবা ‘খুলনের’। এক এলাকার মানুষের সঙ্গে অন্য এলাকার মানুষের কেমন যেন আন্তরিকতার অভাব। এ অবস্থায় নেতৃস্থানীয় কিছু ব্যক্তি উপলব্ধি করেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য বাড়ানো খুব দরকার। এই ভাবনা থেকে প্রথমে আজিমপুর এস্টেট জনকল্যাণ সমিতি ও পরে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা।

এই পাঠাগারের পক্ষ থেকে বইপ্রেমী মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়ে একাধিকবার কলোনির বাসাবাড়ি ও দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো হয়েছিল। এতে লেখা হয়েছিল, ‘সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে বিভিন্ন নতুন বইয়ের সমাহারে লাইব্রেরিকে আপনার জন্য সাজিয়ে তুলেছি। আসুন বই পড়ুন, জীবন গড়ুন।’

যৌবনে এই পাঠাগারে নিয়মিত যেতেন প্রয়াত প্রাবন্ধিক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি এক আলাপে বলেছিলেন, তাঁদের সমসাময়িক অনেকের লেখক হয়ে ওঠার পেছনে পুরান ঢাকার এসব পাঠাগারের রয়েছে বিশেষ অবদান। তবে ২০১৭ সালে একবার গিয়ে এই পাঠাগারের অবস্থা দেখে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন।

গ্রন্থবিতান পাঠাগারে গ্রন্থপাঠে নিমগ্ন পাঠক।
ছবি: প্রথম আলো

৩.

গেন্ডারিয়ার ‘আলোকশিখা সীমান্ত গ্রন্থাগার’–এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বামপন্থী নেতা নাসিম আলী। তিনি ‘কচি ভাই’ নামে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। মাত্র ৫০টি বই নিয়ে (কারও কারও মতে ১৩টি) ডিস্টিলারি রোডের বাড়িতে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ‘জন্মকথা’ নামে এক রচনায় তিনি পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় কাঠখড় পোড়ানোর কথা বলেছেন। খেলাঘরের ৪৫ বছর ও সীমান্ত গ্রন্থাগারের ৬৫ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত স্মরণিকা নব আনন্দে জাগোয় লেখাটি প্রকাশিত হয়।)

দেশবিভাগের পর ১৯৫০–এ দাঙ্গার ধাক্কা সামলাতে না পেরে পশ্চিমবঙ্গের চুঁচুড়া থেকে সপরিবার ঢাকায় চলে আসেন নাসিম আলীর পিতা। শিক্ষকতা ছিল তাঁর পেশা। তৎকালীন ঢাকার অন্যতম অভিজাত ও শান্তিপ্রিয় এলাকা গেন্ডারিয়ার ডিস্টিলারি রোডে বাড়ি কেনেন তাঁরা। নাসিম আলী লিখেছেন, ‘নতুন দেশ, নতুন এলাকা, অজানা পরিবেশ, অচেনা প্রতিবেশী, সব মিলিয়ে প্রথম দিকে জলের মাছ ডাঙায় তুললে যা হয়, তেমনি অবস্থা আমার। কাউকে চিনি না, কার সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে জানি না, কখন কোথায় কী বেয়াদবি হয়ে যায়—এমন আশঙ্কা আর সংকোচের মধ্যে বেশ কিছুদিন স্বেচ্ছাবন্দিত্বের বেড়াজালে নিজেকে গুটিয়ে রাখলাম।’

ছোটবেলা থেকে তাঁর ছিল মানুষের সঙ্গে মেশা আর বই পড়ার নেশা। কাছেই ছিল বাংলাবাজার। বই পেয়ে গেলেন। বন্ধুত্ব গড়ে উঠতেও দেরি হলো না। তিনি লেখেন, ‘হঠাৎ একদিন পুরোনো বইয়ের দোকানগুলোর হদিস পেয়ে গেলাম। দুই আনা, তিন আনা বড়জোর চার আনায় একেকটি বই, গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ—সব ধরনের। এসব বই পড়তে পড়তেই আমার নজরে আসে আরও একটি বিষয়। তা হলোÑএই বইগুলোর বেশির ভাগই বিভিন্ন পাঠাগার বা গ্রন্থাগারের সিলমোহরকৃত এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সিলমোহরে উল্লেখিত ঠিকানাগুলোর প্রায় সবই ছিল গেন্ডারিয়া এলাকার বিভিন্ন পাড়ার।’

নাসিম আলী সে সময় গেন্ডারিয়াতেই ১১টি লাইব্রেরির নাম পেয়েছিলেন। পরে একটিরও অস্তিত্ব পাননি। কারণ, দেশ বিভাগের পরে গুটিয়ে ফেলা হয়েছে, নয়তো লুট হয়েছে।

নাসিম আলী একটি পাঠাগার গড়ে তুলতে মনস্থ করলেন। বন্ধুদের সঙ্গে আলাপও করলেন। গুরুজনেরা তেমন কেউ পাত্তা দিলেন না। কারণ, তিনি ছেলেমানুষ আবার স্থানীয় নন। নাসিম আলী লিখেছেন, ‘কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও শুধু কোনোরকমে একটা কমিটি দাঁড় করানো যায়নি। কাজ এক পা এগোয় তো দশ পা পিছোয়।’

নাম নিয়ে হলো আরেক ফ্যাসাদ! রীতিমতো অভিধান খুলে পাতা উল্টাতে লাগলেন নাসিম আলী। তিনি লিখেছেন, ‘হঠাৎ একটি শব্দের ওপর চোখ আটকে যায়।Ñনট নড়ন চড়ন। শব্দটি হলো ‘‘সীমান্ত’’। তৎকালীন ঢাকার পূর্ব সীমান্ত গেন্ডারিয়া এলাকার একটা পাঠাগারের নাম যদি “সীমান্ত গ্রন্থাগার” রাখা হয়, তাহলে তা যেমন মানানসই হবে, তেমনি আর কোনো নামে হবে না।’

কাঠির মাথায় ন্যাকড়া জড়িয়ে তৈরি হলো তুলি। সারা রাত জেগে লেখা হলো পোস্টার, ‘সীমান্ত পাঠাগার আপনার পাঠাগার’, ‘সীমান্ত পাঠাগারের সদস্য হউন, বই পড়ুন’, ‘অন্যকে বই পড়তে উৎসাহিত করুন’ প্রভৃতি স্লোগান।

নাসিম আলীর লেখায়, ‘মায়ের একটা আলমারিতে বইগুলো সাজিয়ে, আমাদের বাড়ির সামনের ঘরটায় যা আমার জন্যই বরাদ্দ ছিল, বিকেল পাঁচটা থেকে বসে রইলাম। সন্ধ্যার দিকে দল বেঁধে বন্ধুরা এসে হাজির। এদের সঙ্গে বহুবার গ্রন্থাগার গড়া নিয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু সেই গ্রন্থাগার আর বাস্তবে রূপলাভ করেনি। বন্ধুরা এসে প্রথমেই অনুযোগ করল, তাদের বাদ দিয়ে এত বড় কাজটায় হাত দেওয়া ঠিক হয়নি। অভিযোগ-অনুযোগ, পাল্টা অভিযোগ—সব মিলিয়ে প্রথম দিনের জমজমাট আমাদের গ্রন্থাগার। বন্ধুরাই প্রথমে যথারীতি চাঁদা দিয়ে সদস্য হয়ে গেল। খাতায় নাম-ঠিকানা লেখা হলো। বই ইস্যু করা হলো। এভাবেই সীমান্ত গ্রন্থাগারের যাত্রা হলো শুরু।’

’৫০ ও ৬০ দশকে সীমান্ত গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে সারা রাত ধরে গণসংগীতের আসর বসত। প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ও সংগীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদ এবং নিজামুল হক (ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের অনুজ) সারা রাত গণসংগীত পরিবেশন করতেন।

পরবর্তী সময়ে এই পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত হন লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. হায়াৎ মামুদ, চলচ্চিত্র অভিনেতা শওকত আকবর, নাট্যজন আলী যাকেরসহ আরো অনেকে।

৪.

পুরান ঢাকার আরেকটি পুরনো পাঠাগার হলো গ্রন্থবিতান। সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা হয়ে আজিমপুর রোড ধরে সামান্য ভেতরে এগোলেই রাজা শ্রীনাথ রায় স্ট্রিট। এটাই ঠিকানা ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থবিতানের। প্রধান ফটক ঠেলে ভেতরে পা রাখতেই সবুজের স্নিগ্ধ পরশ। দুই পাশে নাতিদীর্ঘ মেহগনি, অর্জুন আর মেহেদি গাছ। প্রায় বৃক্ষহীন পুরান ঢাকার সঙ্গে অনেকটাই বেমানান।

প্রথমে নাম ছিল হরিদাস পাঠাগার। ১৯৪৩ সালে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়। সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের অভিঘাতে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর স্থানীয় ছাত্ররা দায়িত্ব নিয়ে নাম দিল নবারুণ পাঠাগার। কিন্তু টিকল না। এরপর ইউনাইটেড সার্ভিস ক্লাবের অধীন এসে নাম হলো গ্রন্থবিতান।

ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল সময়ে পুরান ঢাকার একদল সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা যুবকের একান্ত আগ্রহে প্রতিষ্ঠিত হয় পাঠাগারটি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করা হয় চাঁদা। সারা দিনে ওঠে একটি বা দুটি টাকা। চাঁদা চাইতে গেলে ‘লোকজন এদিক-ওদিক সরে পড়ত।’ রাস্তায় শিশুরা বলত, ‘আব্বা বলেছেন, তিনি বাড়িতে নেই।’

শুরুর দিকের ইতিহাস বলতে গিয়ে প্রথম সভাপতি সৈয়দ মনোয়ার হোসেনের উদ্যোগ প্রসঙ্গে সাবেক সম্পাদক গোলাম সোলায়মান গ্রন্থবিতানের ইতিহাস নামের পুস্তিকায় লিখেছেন, ‘রাস্তা দিয়ে যে–ই যাক, তাঁকে ধরে গ্রন্থবিতানের সভ্য হতে বলতেন। পানওয়ালা, মাঠাওয়ালা কাউকে বাদ দিতেন না।’

খুব রসিয়ে লিখেছেন গোলাম সোলায়মান, ‘গ্রন্থবিতান তো চালু হলো। কিন্তু পাঠক নেই, তবু আলো জ্বেলে বসে থাকতাম। মশার সে কি পুনপুনানী। একলা পেয়ে চামচিকার সে যে কী ছুটাছুটি, তাদের রাজ্য দখল করেছি বলে। এর ওপরে আবার গৃহিণীদের কানে উঠে গেল আমাদের এই কাণ্ড। একেলা মৎস্যশিকারী বকের মত বসে থাকা। মনোয়ার সাহেব আর আমার সে কী মর্মান্তিক নিগ্রহ!’

পাকিস্তান আমলে এই পাঠাগারের উদ্যোগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দেওয়া হতো। স্বাধীনতার পরেও এ উদ্যোগ চলেছিল কয়েক বছর।

বয়সী পাঠক ও সংগঠকদের সূত্রে জানা গেছে, যেসব বই ও পত্রপত্রিকা সে সময়ের পাঠকেরা পড়তেন, তার মধ্যে রয়েছে রবীন্দ্র–নজরুলের কবিতা, শরৎচন্দ্রের বই, বিভূতি–বঙ্কিম–মানিকের উপন্যাস। একটি পাঠকগোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়। এই অঞ্চলের লেখকদের মধ্যে আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, জহির রায়হান। পাঠাগারগুলোতে কলকাতা থেকে আসত দেশ, সন্দেশ ও আনন্দবাজার পূজাসংখ্যা।

ঢাকার নাগরিক সমাজ তৈরি হওয়ার পেছনে এই পাঠাগারগুলোর ভূমিকা রয়েছে। ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যে বুদ্ধিবৃত্তিক তাড়না ছিল, সেখানে কিছুটা হলেও এই পাঠাগারগুলোর অবদান রয়েছে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সমাজ বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদরা পাঠাগার নিয়ে আরো গবেষণা করবেন– এমনটাই প্রত্যাশা করি।

  • কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
    [email protected]