রিকশা নিয়ে যে প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই

ঢাকা দিনে দিনে রিকশার নগরীতে পরিণত হয়েছেফাইল ছবি

ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশের রিকশা ও রিকশাচিত্র। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই পোস্ট দিচ্ছেন। বেশির ভাগ পোস্টেই এই স্বীকৃতি যে জাতিগতভাবে আমাদের জন্য গর্বের সেই অনুভূতি প্রকাশ করছেন। কেউ কেউ অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, রিকশা কেন আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হবে?

এই বিতর্কে না ঢুকে আগে বলে নেওয়া যাক, দেশের কিছুতে যদি বৈশ্বিক স্বীকৃতি মেলে, সেটা অবশ্যই আমাদের জন্য আনন্দের। কিন্তু রূঢ় হলেও এখানে সত্য যে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়া অন্যায় হবে, তা হলো একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের যে রমরমা সময়টাতে আমরা বাস করছি, সেখানে মানুষের শক্তিতে চালানো রিকশা কেন দেশের লাখো মানুষের পেশা হবে? সভ্য সমাজে এ ধরনের পেশা চালু থাকা বেমানানই।

পালকির উন্নত সংস্করণ রিকশার উদ্ভাবন দেড় শ বছর পেরিয়ে গেছে। মতভেদ থাকলেও অধিকাংশ গবেষকের মতে, রিকশার উদ্ভাবন জাপানে। রিকশা এসেছে জাপানি জিনরিকিশা শব্দ থেকে। যার নামের অর্থ হলো মানুষের শক্তিতে চালিত বাহন। জাপান থেকে রিকশা ভারত, চীন, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রথম দিকের রিকশা ছিল হাতে টানা। কলকাতায় এ ধরনের রিকশা এখনো দেখা যায়। প্যাডেলচালিত রিকশা সিঙ্গাপুর থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় আসে ১৯৩০-এর দশকে। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জে রিকশা আসে কমবেশি একই সময়ে। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় রিকশার সংখ্যা যখন বাড়ছিল, তখন যে দেশে রিকশার উদ্ভাবন, সে দেশে রিকশা চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দিন যত গড়িয়েছে, শুধু ঢাকা বা বড় শহর নয়, সব শহরেই আধা যান্ত্রিক এই যানের সংখ্যা চক্রবৃদ্ধি সুদহারের মতো বেড়েছে।

ঢাকার অনেক রিকশাচালক যে পরিবেশে বাস করেন, সেটা এককথায় মানবেতর। রিকশা গ্যারেজের ওপর বাঁশের তৈরি মাচায় গাদাগাদি করে তাঁরা যেখানে থাকেন, সেখানে একেকজনের শরীরটা ফেলে রাখার জন্য যতটা জায়গা, সেটাই তাঁর ঘুম ও থাকার জায়গা। এ রকম পরিবেশে থেকে দিনে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা রিকশা চালিয়ে যে টাকা আয় করেন, তার প্রায় সবটাই গ্রামে পাঠান। তাতে সচল থাকে গ্রামের অর্থনীতি।

২০১৮ সালে প্রকাশিত প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকা শহরে প্রায় পৌনে সাত লাখ রিকশা রয়েছে। অধিকাংশ রিকশা দিনে দুই শিফটে দুজন চালান। বিবিসি বাংলা জানাচ্ছে, ঢাকার ৪০ শতাংশ মানুষ তাদের নিয়মিত যাতায়াতের জন্য রিকশার ওপর নির্ভরশীল। গত কয়েক বছরে এই পরিস্থিতির খুব যে হেরফের হয়েছে, সেটা মনে করার কোনো বাস্তব কারণ নেই।

রিকশা ও ভ্যান চালানোর মতো পেশায় এত বিপুলসংখ্যক মানুষ নিয়োজিত হওয়ার কারণ কী? এর মূল কারণ আমাদের নীতিনির্ধারণীতে যাঁরা থেকেছেন, তাঁরা জনগণের বিপুল অংশের জন্য শোভন ও টেকসই কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারেননি। একুশ শতকে এসে মানুষ তাঁর গায়ের শক্তি দিয়ে অন্য মানুষকে টেনে নিয়ে যাবেন, তার বিনিময়ে তাঁরা জীবনধারণের জন্য অর্থটুকু পাবেন, এটা যেকোনো সভ্য সমাজে অবিশ্বাস্য, সেটা বোঝার মতো বিবেচনাবোধ কোথায়?

আমরা জন্ম থেকেই রিকশা দেখে অভ্যস্ত, তাই আমাদের মনে খুব একটা প্রশ্ন আসে না। ব্যক্তিস্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের মতো মৌলিক বিষয়গুলো এখনো কাগজের বিষয় হয়ে থাকায় সাধারণ মানুষের যে মর্যাদা আছে, সেই বিষয়ের স্বীকৃতি নেই। কিন্তু অভ্যস্ত চোখের বাইরে থেকে দেখলে অনেক সময়ই একই বাস্তবতার ভিন্ন বয়ান হাজির হয়। অন্য দেশগুলোয় রিকশার মতো যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেও বাংলাদেশে কেন তা অপ্রতিরোধ্যভাবে বেড়েছে?

বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির রূপান্তরের মৌলিক প্রশ্নটি এখানে জড়িত। একসময়ের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বাংলাদেশে অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস ঘটেছে। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিতে কৃষির হিস্যা ক্রমান্বয়ে যত কমে গেছে, ততই জনগোষ্ঠীর বিপুল অংশ কৃষি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। কিন্তু তাদের কর্মসংস্থানের জন্য শিল্প ও সেবা খাতের বিকাশ হয়নি। বরং পাট, কাগজ ও চিনির মতো পুরোনো শিল্পগুলো ক্ষয় হয়েছে।

এ বাস্তবতা বিপুলসংখ্যক মানুষকে জীবনধারণ ও জীবিকার জন্য নগরে আসতে বাধ্য করেছে। হয় রাস্তার পাশে হকারগিরি কিংবা টংদোকান দিতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন, নাহয় রিকশা চালানোর মতো পেশা বেছে নিতে হয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্পকারখানার বেকার শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের লোকদের অনেককে নিরুপায় হয়ে পা রাখতে হয়েছে রিকশার প্যাডেলে।

এই রূঢ় বাস্তবতা ঢাকাকে রিকশার নগরীতে পরিণত করেছে। ২০১৪ সালে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ঢাকাকে এই স্বীকৃতি দিয়েছিল। এখন ইউনেসকো আমাদের রিকশা ও রিকশাচিত্রকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিল। কিন্তু রিকশা আমাদের দেশের কয়েক লাখ মানুষের সস্তা এবং আধা যান্ত্রিক ও আধা মানবিক শ্রমের প্রতীক। টেকসই কর্মসংস্থান না হওয়ায় প্যাডেলে চাপ দেওয়ার মতো পায়ের জোর একজন শ্রমিকের যখনই থেমে যাবে, তখন থেকেই তাঁর আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।

অবশ্য শুধু রিকশাচালক নন, আমরা আমাদের শ্রমজীবী মানুষের জন্য আমরা মানবিক, নিরাপদ, টেকসই কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারিনি। আমাদের সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আনা দুই খাত—প্রবাসী শ্রমিক ও পোশাকশিল্প; বিশ্বে সস্তা শ্রম ও আধা দক্ষ শ্রমের ব্র্যান্ডিং হয়ে উঠেছে।

আমরা হয়তো রিকশায় যেতে যেতে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে ইউনেসকোর ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়ার আনন্দে উচ্ছ্বসিত হচ্ছি, কিন্তু সেই রিকশাচালকটি কোথায় থাকেন, ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা রিকশা চালিয়ে কত টাকা আয় করেন, সারা দিন কী খান, তাঁর সংসারের লোকজন কোথায় থাকেন—এই খবর কি আমরা কখনো জানতে চেষ্টা করি?

ঢাকার অনেক রিকশাচালক যে পরিবেশে বাস করেন, সেটা এককথায় মানবেতর। রিকশা গ্যারেজের ওপর বাঁশের তৈরি মাচায় গাদাগাদি করে তাঁরা যেখানে থাকেন, সেখানে একেকজনের শরীরটা ফেলে রাখার জন্য যতটা জায়গা, সেটাই তাঁর ঘুম ও থাকার জায়গা। এ রকম পরিবেশে থেকে দিনে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা রিকশা চালিয়ে যে টাকা আয় করেন, তার প্রায় সবটাই গ্রামে পাঠান। তাতে সচল থাকে গ্রামের অর্থনীতি।

রিকশা বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেলেও রিকশা যাঁরা চালান, তাঁদের নিয়ে এসব মূর্ত প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

● মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

[email protected]