হাসপাতালে নেই ওষুধসামগ্রী

দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবা না পেয়ে রোগীদের বিক্ষোভ। গতকাল হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় পরিচালকের কক্ষের সামনেছবি: প্রথম আলো

রেজা হুমায়ুন কবীর (৪৩) ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে অসুস্থ হন, জানতে পারেন তাঁর দুটি কিডনিই নষ্ট। এরপর শুরু হয় ডায়ালাইসিস। সাত বছর ধরে সপ্তাহে তিন দিন রুটিন করে ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন। রেজা পেশায় কৃষক। বিঘা চারেক জমি আছে তাঁর। স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। জমানো অর্থ যা ছিল চিকিৎসায় ব্যয় করেছেন। এবার হাত দিয়েছেন জমিতে। সম্প্রতি ১৩ কাঠা জমি বিক্রি করতে হয়েছে তাঁকে। তাঁদের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের রানীসংকৈলের সহোদর গ্রামে।

১৮ ডিসেম্বর ডায়ালাইসিস নিয়ে ফেরার সময় দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে কথা হয় নাসিমা-রেজা দম্পতির সঙ্গে। রেজা জানান, একমাত্র সন্তানকে (১০ বছর বয়স) তার নানির কাছে রেখে আসেন। অসুস্থ জীবনে স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই রেজার। পাশে দাঁড়ানো স্ত্রীকে দেখিয়ে বলেন, সাত বছর ধরে স্ত্রী একটি মুহূর্তও একা রাখেননি। শীত-রোদ-বৃষ্টি, অভাব-অনটন উপেক্ষা করে সেবা করে যাচ্ছেন।’

সম্প্রতি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস খরচ বেড়েছে। চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন রেজা। জানালেন, হাসপাতালের ফি, যাতায়াত খরচসহ একবার ডায়ালাইসিসে খরচ হতো মাত্র ৯০০ টাকা। সেখানে গত পাঁচ মাস থেকে খরচ পড়ছে প্রায় ২ হাজার ৭০০ টাকা। ডায়ালাইসিস বাদেও প্রতি মাসে তাঁকে ওষুধ কিনতে হয় ২ হাজার ৮০০ টাকার। হিসাব অনুযায়ী প্রতি মাসে চিকিৎসায় তাঁর ব্যয় হচ্ছে ১৩ হাজার ৬০০ টাকা।

এদিকে গতকাল মঙ্গলবার হাসপাতাল থেকে কিডনি রোগীদের ওষুধ ও সামগ্রী দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন রোগীরা।

দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস করা রোগীদের গল্প প্রায় একই রকম। বেশির ভাগই ৫-৭ বছর ধরে ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন। ১৮ ডিসেম্বর কথা হয় হেমন্ত চন্দের সঙ্গে (৪৫)। পেশায় তিনি ট্রাকশ্রমিক। তিন বছর ধরে কিডনি ডায়ালাইসিস করাচ্ছেন। প্রথম দিকে সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতেন। অর্থাভাবে এখন দুবার ডায়ালাইসিস করাচ্ছেন। হেমন্ত বলেন, ‘আর পারছি না ভাই। শ্রমিক অফিস থেকে যা পাই তা দিয়ে চলছে। ৬ শতক ভিটেমাটির মধ্যে বছরখানেক আগে ২ শতক বিক্রি করেছি। সেই টাকাও শেষ। এখন শ্বশুরবাড়ি, বড় ভাইসহ আত্মীয়স্বজনদের সহযোগিতায় চিকিৎসা চালাচ্ছি।’

ডায়ালাইসিস খরচের হিসাব করতে গিয়ে হেমন্ত চন্দ্র বলেন, ‘ডায়ালাইজার কিনতে লাগে ৮৫০ টাকা (তিনবার ব্যবহারযোগ্য), ব্লাডলাইন ২০০ টাকা, হেপারিন ইনজেকশন ৩৫০ টাকা, নিডল ৬০ টাকা, পানি (রেনাল-এ) ৫০০ টাকা (দুবার ব্যবহারযোগ্য), পানি (রেনাল-বি) ৪০০ টাকা, স্যালাইন (নরমান) ১০০ টাকা, গ্লাভস ৪০ টাকা, ডায়ালাইসিস ফি ৪০০ টাকাসহ মোট খরচ পড়ছে প্রায় ২ হাজার ৪০০ টাকা। অথচ মাস পাঁচেক আগেও ৭০০-৯০০ টাকার মধ্যে ডায়ালাইসিস করা যেত। সবকিছু হাসপাতাল থেকেই পাওয়া যেত। এখন বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। হাসপাতাল থেকে বলছে, সাপ্লাই নেই।’

এখন থেকে বছর দশেক আগেও পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুরের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশেষ করে কিডনি রোগীদের ছুটতে হয়েছে ঢাকা-রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে স্বজনদের ছিল আহাজারি-আর্তনাদ। দূরবর্তী রাস্তা আর অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার জাঁতাকলে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই রোগীর মৃত্যুর ঘটনাও কম নয়। স্বজন হারানোর আফসোস বয়ে বেড়াতে হতো মানুষকে। ২০১৩ সালের মার্চ থেকে অদ্যাবধি এই হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা পাচ্ছেন রোগীরা।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, দ্বিতীয় তলায় মাঝের ব্লকে দুটি কক্ষে কিডনি রোগীদের জন্য ২৯টি শয্যা আছে। প্রতিটি শয্যার সঙ্গে রাখা অত্যাধুনিক ডায়ালাইসিস মেশিন। দৈনিক তিন পালায় ৬২-৬৯ জন কিডনি রোগী চার ঘণ্টা ডায়ালাইসিস সেবা নেন। শুরু থেকে সোমবার পর্যন্ত ২ হাজার ৭০০ রোগী ডায়ালাইসিস সেবা নিয়েছেন এখান থেকে। এর মধ্যে দুই হাজারের বেশি রোগী কেউ বাসায়, কেউ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন। ডায়ালাইজার, ওষুধপত্র, সিমুলার ক্যাথেটার-জুবোলর ক্যাথেটারসহ সবকিছুর সরবরাহ ছিল এখানে। হঠাৎ রোগী বেড়ে যাওয়ায় এসব জিনিসের মজুত শেষ হওয়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন রোগীরা।

হাসপাতালে ডায়ালাইসিস ইউনিটে শুরু থেকে দায়িত্ব পালন করছেন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আবু ইউসুফ। তিনি বলেন, ওয়ার্ডে যারা দায়িত্বে আছি, প্রত্যেক রোগীর নাম–পরিচয়ের পাশাপাশি পারিবারিক অবস্থার কথাও জানি। অনেকের পরিবারের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে। রেজিস্টার দেখে জানালেন, শুরুতে ১০টি মেশিন দিয়ে সেবা চালু হয়। বর্তমানে ২৯টি মেশিন আছে। তবে পাঁচটি মেশিন সম্প্রতি অকেজো। জানালেন, রংপুর মেডিকেলে ডায়ালাইসিস সেবা সাময়িক বন্ধ থাকায় এখানে রোগীর চাপ বেড়েছে। এ জন্য ওষুধপত্রসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক সাওয়ার আলম বলেন, ওষুধপত্রসহ অন্যান্য সামগ্রীর ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে এ সমস্যা সাময়িক। ইতিমধ্যে দরপত্র প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হয়েছে।