সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বই: তাঁরা লজ্জিত-বিব্রত হোন, আমরা তা আর চাই না

সপ্তম শ্রেণির নতুন বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তকে বেশ কিছু অনুচ্ছেদের ‘কুম্ভিলকবৃত্তি’ নিয়ে প্রথম আলোয় আমার একটি লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ সাড়া পেয়েছি। পাঠ্যপুস্তকের মতো একটি সংবেদনশীল বিষয়ে এমন ভুল–ত্রুটি অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যপুস্তক আসার পর আমরা এই সমালোচনা পত্রপত্রিকা কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখতে পাই।

পাঠ্যপুস্তক দেখভালের দায়িত্বে থাকা মানুষজন কখনো সেগুলো আমলে নেন, আবার কখনো নিজেদের ভুল স্বীকারই করেন না। জবাবদিহি প্রদর্শনের সংস্কৃতির উন্মুক্ত চর্চা না থাকায় দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বারবার ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যান। এবারও তা–ই হচ্ছে।

‘সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বই: হুবহু চুরি আর গুগলের অনুবাদে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে?’ শিরোনামে লেখাটি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট পাঠ্যপুস্তক কমিটির এক সদস্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের ‘অসাবধানতাজনিত’ ত্রুটির বিষয়টি স্বীকার করে নেন। রাতে বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তরে এক আলোচনায় আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আলোচক প্যানেলে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বইটি লেখা ও সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল একবাক্যে ‘নিজেদের গাফলতির’ কথা স্বীকার করে নেন। প্রথম আলোয় প্রকাশিত অভিযোগগুলো নিজের কাঁধে নিয়ে তিনি বলেছেন, একটি নির্দিষ্ট অধ্যায়ের কয়েকটি অংশ ওই (ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিক ডট ওআরজি) সাইট থেকে তোলা হয়েছে। দুই জায়গায় হুবহু তোলা হয়েছে আর দুই জায়গায় আংশিক তোলা হয়েছে। প্লেইজারিজমের একটি সুনিদিষ্ট অর্থ আছে, সেই প্লেইজারিজম শব্দটি যদি আমরা বলতে চাই, তাহলে সেটি প্লেইজারিজমের আওতায় পড়ে। তবে পুরো বই নয়।

আরও পড়ুন

মুহম্মদ জাফর ইকবাল ওই অনুষ্ঠানে আমাদের বলেছেন, ‘যে অংশটি প্লেইজারিজমের মধ্যে পড়েছে, সেগুলো খুবই সাধারণ বিষয়, যেগুলো সাধারণ কথাবার্তা। যিনি বইটির এই অংশ লিখেছেন, তিনি ইচ্ছা করলে নিজেই এটি লিখতে পারতেন। তিনি কেন অংশটি অনুবাদ করে লিখলেন, তা আমি বুঝতে পারছি না। আমরা সব সময় ছেলেমেয়েদের বোঝাই, প্লেইজারিজম খুবই খারাপ জিনিস। আমাদের ডিজিটাল প্রযুক্তির বইয়ে এসব লেখা আছে, এখন যদি আমাদের নিজেদের বইয়ে আবিষ্কার হয়, তাহলে সেটা আমাদের জন্য বিব্রতকর।’  তিনি বলেছেন, এই প্লেইজারিজমের জন্য তাঁরা খুবই লজ্জিত, খুবই বিব্রত। আগামীতে এসব ভুল সংশোধন করবেন বলে তিনি সংকল্পবদ্ধ।

আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নই। আমাদের ভুল হবে, তার জন্য সংশোধনও করা লাগবে। আমি জানি না, পাঠ্যপুস্তক নিয়ে কে কবে এ ধরনের ভুল স্বীকার করেছেন, তবে এই ভুল যে সাধারণ মানের ভুল ছিল না, তা এই পাঠ্যপুস্তকে জড়িত ব্যক্তিরা ভালো করেই জানেন। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল যদিও নিজে ওই অধ্যায় লেখেননি, তবে বইয়ের সম্পাদক হিসেবে এই দায় তিনি এড়িয়ে যেতে পারেননি। সংবাদমাধ্যমে তিনি তা স্বীকারও করেছেন। তাঁর এই অবস্থানকে সাধুবাদ জানাই।

প্রশ্ন হলো, আমরা কেন পাঠ্যপুস্তকের ভুল ধরতে যাব? কেন একজন শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষক ক্লাসে পড়াতে গিয়ে পাঠ্যপুস্তকের ভুলভাল শব্দ, বাক্য কিংবা তথ্য উদ্ধার করবেন? কেন সব সময় তড়িঘড়ি করে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের দায়ভার চাপানো হয়? আমার এই সব প্রশ্নের সদুত্তর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেবেন কি না, আমি জানি না। তবে এই কর্মের জন্য এনসিটিবির কোনো ক্ষতি হয় না। ক্ষতিটা হয় একটি প্রজন্মের, ক্ষতিটা হয় এই দেশের ভবিষ্যতের।

বাংলায় প্লেইজারিজম–চর্চার টুলস আমাদের অপ্রতুল, তাই বলে পাঠ্যপুস্তক লেখার জন্য সেটিরই প্রয়োজন হতে পারে না, তা ঠিক নয়। বরং যাঁদের ওপর পাঠ্যপুস্তক লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁরা যদি সৎ না হন, তাহলে একটি জাতি সেই অসৎ ব্যক্তির দ্বারা সংক্রমিত হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। পাঠ্যপুস্তক লেখা আর সাধারণ গল্প-উপন্যাস লেখা কখনো এক নয়। এখানে নিজেকে ঢেলে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনার পরিশ্রমে লাখো শিক্ষার্থী আলোকিত হবে। আপনার দেওয়া ভাষা, বাক্য অন্যদের হৃদয়ে সংক্রমিত হবে।

আমি ঠিক জানি না, এ ধরনের গুরুতর অপরাধে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ঠিক কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন, তবে এসব ভুল নতুন কিছু নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে। তবে আমরা দৃশ্যমান শাস্তি দেখতে পাইনি। যদিও ওই আলোচনায় প্যানেলে থাকা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক দাবি করেছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের বেলায় তাঁরা শাস্তি দিয়ে থাকেন। তবে সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে তাঁরা কী ধরনের শাস্তি দিয়েছেন কিংবা আদৌ দিয়েছেন কি না, তা জানা যায় না।

প্রশ্ন হলো, আমরা কেন পাঠ্যপুস্তকের ভুল ধরতে যাব? কেন একজন শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষক ক্লাসে পড়াতে গিয়ে পাঠ্যপুস্তকের ভুলভাল শব্দ, বাক্য কিংবা তথ্য উদ্ধার করবেন? কেন সব সময় তড়িঘড়ি করে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের দায়ভার চাপানো হয়?
আমার এই সব প্রশ্নের সদুত্তর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেবেন কি না, আমি জানি না। তবে এই কর্মের জন্য এনসিটিবির কোনো ক্ষতি হয় না। ক্ষতিটা হয় একটি প্রজন্মের, ক্ষতিটা হয় এই দেশের ভবিষ্যতের। একটি জাতির পিলারকে নড়বড়ে করতে আমাদের ওই সব কর্মকর্তাদের খেয়ালখুশিই যথেষ্ট নিয়ামক হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে প্রভাব পড়ে।

পরিকল্পনা ছাড়াই শিক্ষানীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া এবং আবার লেজেগোবরে পাঠ্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের এই অস্তির সিদ্ধান্তের কারণে আমরা গত পঞ্চাশ বছরে শিক্ষার জন্য একটি উপযুক্ত কাঠামো করতে পারিনি, যা সত্যিই লজ্জার। পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করার যৌক্তিক কারণ হিসেবে যদি আমরা বিশ্বায়নে বিজ্ঞানের পরিবর্তনকে সামনে আনতে চাই, তাহলে বলতে হবে এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। গত ত্রিশ বা চল্লিশ বছরে আমরা পাঠ্যপুস্তকের মূল তথ্যের কোনো হেরফের হতে দেখিনি। যেটি হয়েছে, তা হলো, যে আলোচ্য বিষয়  একাদশ শ্রেণিতে ছিল, সেটি নবম শ্রেণিতে আনা হয়েছে, যে বিষয় নবম শ্রেণিতে ছিল, সেটি সপ্তম শ্রেণিতে আনা হয়েছে। কয়েক দশক আগেও আমরা পরমাণু ও অণুর সংজ্ঞা যেটি পড়ে এসেছি, সেটি বিজ্ঞানীরা এখনো পরিবর্তন করেননি, কিংবা আইনস্টাইনের সূত্রেরও কোনো হেরফের হয়নি, জলবায়ুর সংজ্ঞা কিংবা গতিবেগেরও সমীকরণের কোনো রদবদল হয়নি।

আরও পড়ুন

আপনি যদি মনে করেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা নতুন নতুন প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের পরিবর্তনের কথা পাঠ্যবইয়ে জানবে, তাহলে বলে রাখি, এই পরিবর্তন বার্ষিক গড়ে ০.০০১ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়। কারণ, বিজ্ঞানের যেসব পরিবর্তন আমরা সায়েন্টিফিক জার্নালে নিয়ে আসি, সেগুলো একজন শিক্ষার্থীকে জানানোর যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে তাদের মৌলিক জ্ঞানচর্চায় ব্যস্ত রাখা বেশি সমীচীন হবে।

এরপরও আমাদের পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তনের ওপর থাকতে হয় কিংবা ভবিষ্যতে হবে। আমরা এখনো স্থিতিশীল পাঠ্যক্রম পরিচালনার পথে থাকতে পারিনি। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, পাঠ্যপুস্তক একটি জাতির ধ্যানধারণাকে পাল্টে দিতে পারে। আমাদের মানসিক বিকাশে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ যতটা দায়ী, তার চেয়ে তাদের হৃদয় ও মগজে দেওয়া পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান বেশি কাজে দেয়। আর সেই আলোকে হয়তো এবার নতুন পাঠ্যক্রম আসছে, নিঃসন্দেহে সেটি ভালো দিক। তবে এভাবে পুরো কার্যক্রমটাকে বিতর্কিত করার জন্য সামান্য কিছু বাক্য যে দায়ী হতে পারে, তা আমাদের মানতে হবে।
আগামী দিনে অন্যান্য শ্রেণির নতুন পাঠ্যক্রমে পাঠ্যপুস্তক আসবে, আমরা নতুন পাঠ্যপুস্তকে অন্তত এ ধরনের ভুল দেখতে পাব না। হুটহাট করে পুস্তক প্রকাশের চেয়ে মানসম্পন্ন লেখা বই আমাদের বেশি জরুরি। আপনাদের এই নতুন ক্রম আরও দুই বছর দেরি হোক, সময় নিন, যাতে করে চৌর্যবৃত্তি আমাদের চোখে না আসে। আমরা যেন বিব্রত বোধ না করি।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]