বিশ্ব যেথায় চলেছে এগিয়ে

রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ টিমছবি: সংগৃহীত

২০২৪ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে তুরস্কে গিয়েছিলাম ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দল নিয়ে। ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াড ২০০৪ সাল থেকে আয়োজিত হচ্ছে। বিশ্বের ৮ থেকে ১৯ বছরের প্রায় দেড় হাজার ছেলেমেয়ে তাদের রোবটিক দক্ষতা দেখাতে সেখানে জড়ো হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল বাংলাদেশের ১২ শিক্ষার্থী। তাদের দক্ষতা যাচাই করার জন্য বিচারক ছিলেন ৫১টি দেশের ১৯৭ জন! হাইস্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য এটি রোবটিকসের অন্যতম বড় প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় প্রথম থেকে তৃতীয় স্থান অধিকারী ২৪টি দলের মধ্যে ৭টিই ছিল মালয়েশিয়ার।

৮৭টি দেশের মধ্যে বিশেষভাবে নজর কেড়েছে ফিলিস্তিন ও সৌদি আরব। সৌদি আরবের দলগুলোকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য এসেছিল একদল নারী শিক্ষার্থী। অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে তারা প্রায় পুরোটা সময় অলিম্পিয়াড প্রাঙ্গণকে মাতিয়ে রেখেছিল। কখনো মিছিল করে ঘুরে বেড়িয়েছে কিংবা কখনো নিজেদের দলকে উৎসাহ জুগিয়েছে।

হানাদার ইসরায়েলি বাহিনীর অত্যাচারের পরও ফিলিস্তিন থেকে যোগ দিয়েছে ৯টি দল। দলের সঙ্গে এসেছেন ফিলিস্তিনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হেনা। তিনি জানান, যুদ্ধের মধ্যে প্রায় ৪৫টি দল তাদের জাতীয় পর্যায়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। সেখান থেকে ৯টি দলকে তাঁরা এখানে নিয়ে এসেছেন। ফিলিস্তিন বা সৌদি দল শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হতে পারেনি, কিন্তু তারা মন জিতে নিয়েছে সবার। তাদের উপস্থিতি মনে করিয়ে দিয়েছে, আগামী দিনের জন্য রোবটিকস আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতটা জরুরি। রাষ্ট্রগুলো সেখানেই নজর দিচ্ছে।

গত তিন দশকের বিশ্বপ্রযুক্তি–জগতের দিকে তাকালে একটি বিশেষ বিষয় লক্ষ করা যায়। ইন্টারনেটের বিকাশের পর থেকে প্রতি ১৫ বছরে একটা বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হয়। ১৯৯২ সালে এ ধারার সূচনা করে ইন্টারনেট তথা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। সংযোগের দুর্ভিক্ষের জন্য বিশ্বজুড়ে এর বিকাশ কিছুটা মন্দ মাত্রায় হলেও সেটি আগেকার যেকোনো যোগাযোগমাধ্যমের চেয়ে সহস্র গুণ উন্নত ছিল। যাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে, তারা সবাই ইন্টারনেটে নিজেদের উপস্থিতি প্রমাণ করেছে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। সেই ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে পরবর্তী ১৫ বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা ধরনের যোগাযোগ ও বিপণন মাধ্যম গড়ে উঠেছে। কিন্তু সবকিছুকে নতুন এক মাত্রায় নিয়ে যায় ২০০৭ সালে স্টিভ জবসের হাত দিয়ে যখন স্মার্টফোনের আবির্ভাব হয়। অ্যাপলের কাছে হেরে যাওয়ার ভয়ে গুগল স্যামসাংকে সঙ্গে নিয়ে সেই দৌড়ে হাজির হয়। অচিরেই স্মার্টফোন হয়ে ওঠে ইকুইটাস কিংবা অনেকটা সর্বজনীন। আর হাতের মুঠোর এই ফোন হয়ে ওঠে ইন্টারনেটের দরজা। 

আরব দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব শুধু নয়, আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান—সবাই তাদের নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আরব আমিরাতে গড়ে উঠেছে বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের একজন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক মন্ত্রীও রয়েছে! বিশ্বজুড়ে রোবটিকস, এআই নিয়ে যখন দেশগুলো এগিয়ে যাওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছে, তখন আমরা কী করছি তা কি ভেবে দেখছি? আমরা কি ভাবছি প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একটা করে দিন চলে যাচ্ছে?

একলাফে বিশ্বের কানেকটিভিটি নতুন মাত্রা পেয়ে যায়। আর ইন্টারনেটকে হাতের মুঠোয় আনার জন্য চালু হয়ে যায় মোবাইল অ্যাপ। এখন তো মুঠোফোনে করা যায় না, এমন কাজ বিরল। আর এই স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ওপর ভর করে, স্মার্টফোনের ১৫ বছর পর, প্রবল পরাক্রমের সঙ্গে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে উন্মুক্ত হয় চ্যাটজিপিটি—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পাবলিক হাতিয়ার। তার আগপর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বন্দী ছিল ল্যাবরেটরিতে আর গণিতবিদদের খাতায়।

ইন্টারনেট আর স্মার্টফোনের যে জগৎ, সেটির ওপর ভর করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শনৈঃশনৈঃ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথম ৫ কোটি ব্যবহারকারী পেতে রেডিওর লেগেছে ৩৮ বছর, টিভির ১৩ বছর, কিন্তু ইন্টারনেটের ৪ বছর। আর ফেসবুক সে পথ পাড়ি দিয়েছে ২ বছরে, কিন্তু ইউটিউবের লেগেছে মাত্র ১০ মাস। আর অন্যদিকে একই পথ পাড়ি দিয়েছে চ্যাটজিপিটি মাত্র পাঁচ মাসে। এর কারণ হলো প্রতিটি বিপ্লব তার আগের সব উপকরণই প্রবলভাবে ব্যবহার করে। ইন্টারনেটের প্রসার হয়েছে যখন স্মার্টফোন সহজলভ্য হয়েছে। আর চ্যাটজিপিটি তো স্মার্টফোনের পাশাপাশি ব্রডব্যান্ডের ওপরও সওয়ার হয়েছে।

ইন্টারনেট, স্মার্টফোন কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন আমাদের ক্রমাগত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। সামনের দিনগুলোতে এগুলো আরও বেগবান হয়ে উঠবে। ২০২৪ সালের নোবেল পুরস্কারেও আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতাপ দেখেছি। যে উদ্দেশ্য নিয়ে আলফ্রেড নোবেল গণিতবিদদের তাঁর প্রবর্তিত পুরস্কার থেকে বঞ্চিত রেখেছিলেন, এআই সেটিকে এবার ভেঙে দিয়েছে।

ইন্টারনেট থেকে এআই—সবারই প্রাণভোমরা হলো কম্পিউটার চিপ। এখন তো বলা হচ্ছে পৃথিবীর প্রত্যেক লোকের বিপরীতে গড়ে সাতটি করে চিপ বিদ্যমান। সামনের দিনগুলোতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। আর এর প্রভাবে এমন সব যন্ত্রপাতি বের হবে, যা কিনা পাল্টে দেবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনকেও। আর এসব চিপ দিয়েই তৈরি হচ্ছে রোবট। রোবটিকস আর এআই মিলে নতুন এক সভ্যতার সূচনা হয়ে গেছে এরই মধ্যে। অনেকেই এটিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বলছেন নানা কারণে। মোদ্দাকথা, এমন সব যন্ত্রের আবির্ভাব হবে, যা আমাদের চমকে দেবে সেগুলোর পারফরম্যান্স দিয়ে। তাই বিশ্বব্যাপী উন্নত দেশগুলো শুধু নয়, উন্নত হতে আগ্রহী দেশগুলোও এ কাজে পিছিয়ে পড়তে চায় না।

তুরস্ক থেকে ফেরার পথে সৌদি আরবে গিয়ে দেখেছি এআই নিয়ে তাদের নানা কর্মকাণ্ড। সৌদি সরকার গড়ে তুলেছে রাষ্ট্রীয় এআই সেন্টার। সারা বিশ্ব থেকে খুঁজে নিয়ে আসছে এআই-রোবটিকস বিশেষজ্ঞদের।

২০৩০ সালের মধ্যে নিজের রূপকল্প বাস্তবায়নে এখন তারা উঠেপড়ে লেগেছে। আর সে জন্য সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য। বিশ্বের নানা বিষয়ের অলিম্পিয়াডে নিজেদের সরব উপস্থিতি তারা জোরদার করছে। তারা ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক রসায়ন অলিম্পিয়াড আয়োজন করেছে, ২০২৫ সালে আয়োজন করবে রিজিওনাল রোবট অলিম্পিয়াড আর ২০২৮ সালে তারা করবে গণিত অলিম্পিয়াডের আয়োজন।

শুধু তা–ই নয়, ২০২৪ সালে সৌদি আরবের উদ্যোগে শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক এআই অলিম্পিয়াড। সে অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের চারজন অংশগ্রহণকারীর ২ জন রুপার ও ২ জন ব্রোঞ্জপদক পেয়েছে।

আরব দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব শুধু নয়, আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান—সবাই তাদের নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আরব আমিরাতে গড়ে উঠেছে বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের একজন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক মন্ত্রীও রয়েছে! বিশ্বজুড়ে রোবটিকস, এআই নিয়ে যখন দেশগুলো এগিয়ে যাওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছে, তখন আমরা কী করছি তা কি ভেবে দেখছি? আমরা কি ভাবছি প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একটা করে দিন চলে যাচ্ছে?

মুনির হাসানপ্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়কারী