ভারত-বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় সাংবিধানিক আদালত, যৌথ সম্মেলন ও আত্মসমীক্ষা

‘যৌথ আত্মসমীক্ষণের প্রয়াস হিসেবে অনুষ্ঠিত হলো ‘সাউথ এশিয়ান কনস্টিটিউশনাল কোর্টস ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি: লেসন ফ্রম বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন।’

ধ্রুপদি দ্বন্দ্বমুখরতার এক অভ্রান্ত ভৌগোলিক ক্ষেত্র আমাদের এই উপমহাদেশ। নানা অনির্ণেয় বিষয়ে অনিশ্চয়তার এক উর্বরভূমি যেন এই অঞ্চল। একমাত্র নিশ্চয়াত্মক ব্যাপার এই যে আমরা এই অঞ্চলের অধিবাসীরা নানা বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হই, আনন্দিত হই। অর্থাৎ বিষয়বৈচিত্র্য সত্ত্বেও আমাদের আবেগ ও অভিপ্রায় অভিন্ন; প্রায় অভিন্ন আইন, আদালত ও বিচারব্যবস্থা।

যৌথ আত্মসমীক্ষণের প্রয়াস হিসেবে অনুষ্ঠিত হলো ‘সাউথ এশিয়ান কনস্টিটিউশনাল কোর্টস ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি: লেসন ফ্রম বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনটি ছিল উভয় দেশের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের এক আন্তরিক ক্ষেত্র।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই অঞ্চলের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্বের নানা প্রান্তের মতো এই অংশেও তীব্রভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বৈশ্বিক ঘরানার পুঁজিবাদী সংস্কৃতি। আদিকাল থেকে এ অঞ্চলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও অসাম্প্রদায়িক সামাজিক মূল্যবোধ। তা এখন অনেকটাই বিলীয়মান। যে কারণে ‘হিন্দুত্ব একটি সাংস্কৃতিক বাস্তবতা’—এমন কঠোর মন্তব্য করেছেন ভারতের উচ্চ আদালত।

১৯৪৭ সালে একই ঔপনিবেশিক জঠর থেকে জন্ম নেয় দুটি দেশ। ভারত ভাগের চব্বিশ বছর পর বেআইনি বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। সে কারণেই কি না, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা প্রেক্ষাপটে প্রায় একই বর্গভুক্ত বাংলাদেশ ও ভারত। আইন-আদালতের সমস্যাও প্রায় একই ধরনের, যে কারণে উত্তরণ প্রকরণ কৌশলও কাছাকাছি।

আমাদের দেশেও ধর্মীয় চরমপন্থার অনুশীলন মাঝখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এখন স্তিমিত মনে হলেও আত্মপ্রসাদের সুযোগ নেই। নানা অস্বস্তি-অসহিষ্ণুতা কোনো না কোনোভাবে থেকেই যায়। চলমান অসহিষ্ণু ঘটনাবলি এই পরিবর্তনশীলতারই একটি বহিঃপ্রকাশ।

বিচারব্যবস্থা-সংক্রান্ত আলোচনার শুরু হয় বিচারক অপ্রতুলতা দিয়ে। আসলে বিচারক বা আদালতের সংখ্যা বাড়ানোর আলোচনার সঙ্গে বিচারব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দক্ষতা বাড়ানোর আলোচনাও সমান জরুরি। কেবল বিচারকের সংখ্যা দিয়ে দেশের বিচারব্যবস্থার উৎকর্ষ বা সীমাবদ্ধতার মীমাংসায় আসা যথাযথ নয়। বিবেচনায় রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ইতিহাস, যার মধ্যে দিয়ে বিবর্তিত হয় সে দেশের আইন। ভারতীয় অঞ্চলের আইনব্যবস্থার জটিলতাগুলো বুঝতে ব্রিটিশ আমলের ঔপনিবেশিক আইন বা তারও আগেকার হিন্দু ও মুসলিম আইনগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

১৯৪৭ সালে একই ঔপনিবেশিক জঠর থেকে জন্ম নেয় দুটি দেশ। ভারত ভাগের চব্বিশ বছর পর বেআইনি বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। সে কারণেই কি না, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা প্রেক্ষাপটে প্রায় একই বর্গভুক্ত বাংলাদেশ ও ভারত। আইন-আদালতের সমস্যাও প্রায় একই ধরনের, যে কারণে উত্তরণ প্রকরণ কৌশলও কাছাকাছি।

ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বিচার বিভাগের শীর্ষ দায়িত্বে থেকেও যথেষ্ট জনপ্রিয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর আইন-দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায় প্রায়ই। দুই দিনের সম্মেলনে তাঁর প্রতিটি বক্তব্য ছিল প্রজ্ঞাদীপ্ত।

অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের কাব্য ও সাহিত্য সুষমামিশ্রিত উপস্থাপন সম্মেলনের ভিন্নমাত্রার স্মারক। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে দেশ দুটি স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পঁচাত্তর ও পঞ্চাশ বছর পার করেছে। স্বাভাবিকভাবে অর্জনের উদ্‌যাপন আর অপ্রাপ্তির আত্মসমীক্ষা প্রয়োজন। ক্ষেত্রবিশেষ এই প্রক্রিয়া যৌথভাবে করলে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়।

‘জুডিশিয়ারি অ্যান্ড ইটস রোল ইন আপহোল্ডিং কনস্টিটিউশনালিজম’ শীর্ষক সেশনে দুই দেশের সাংবিধানিক আদালত, বিচারব্যবস্থা নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা হয়। ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, এত বেশিসংখ্যক মানুষের জন্য বাংলাদেশের মতো ইউনিটারি জুডিশিয়াল সিস্টেম পুরো পৃথিবীতেই বিরল। এটা বাংলাদেশের দারুণ এক অর্জন।

উত্তরে বিচারপতি দীপংকর দত্ত পরিবর্তনশীল বাস্তবতা ও বিচারিক মননের বৈচিত্র্যকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। বিচারপতি নাইমা হায়দারের প্রবন্ধ উপস্থাপন আর সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সঞ্চালনায় দারুণ এক সেশন ছিল।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি দীপংকর দত্তকে বাংলাদেশের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা আক্ষেপ নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, একটা সময় কেশবানন্দ ভারতীর মতো মামলার রায় দেওয়া ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় আদালত এখন অযোধ্যা বিষয়ে রায় দেন। কেন এই বৈপরীত্য?

কূটনৈতিক সম্পর্কচর্চার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার বেশ ধারাবাহিক ভারতের সঙ্গে। এই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে বাংলাদেশের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও সামর্থ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট এবং ভারতের ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমির মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

সমঝোতা স্মারকের পর সে বছরের ২৯ জুলাই এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশে উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। ভারতের প্রত্যেকটা রাজ্যে একটি জুডিশিয়ারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট আছে উচ্চ আদালতের বিচারকদের ট্রেনিংয়ের জন্য। ভোপালে তাঁদের জাতীয় জুডিশিয়ারি একাডেমি আছে। সেখানে আমাদের পনেরো-ষোলোশ বিচারকের ট্রেনিংয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছি।’

এরপর প্রথমবারের মতো ওই বছরের ১০ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যান বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা। পর্যায়ক্রমে ইতিমধ্যে অনেক বিচারক প্রশিক্ষণ নেন। সদ্য শেষ হওয়া সম্মেলনে ভারতের প্রধান বিচারপতিও আশাপ্রকাশ করেন, তাঁর দেশের বিচারকদের বাংলাদেশের বিচারিক অভিজ্ঞতা নিতে এখানে আসার ব্যবস্থা হবে।

২০১৮ সালে প্রথম আলোয় এক নিবন্ধে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ লেখেন, ‘রাজনৈতিক অপরাধ দমনে ভারতের একটি উদ্যোগ আমাদের চোখ খুলে দিতে পারে। ভারতের রাজনীতিতে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধিতে নাগরিক উদ্বেগ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় রাষ্ট্র ও সরকার অনেকগুলো বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে।’

সম্প্রতি দেশটির সরকারের এক সিদ্ধান্তে অর্থ মন্ত্রণালয় রাজনীতিবিদদের এই বিপুলসংখ্যক মামলা দ্রুত (আগামী জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে) নিষ্পত্তির জন্য ১৫টি বিশেষ আদালত গঠনের জন্য ৮ কোটি রুপির একটি বিশেষ বরাদ্দ অনুমোদন দিয়েছে। এই অর্থে নবগঠিত দুটি আদালত ১৮৪ জন লোকসভা সদস্যের মামলার শুনানি করবেন।

বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তেলেঙ্গানায় একটি করে বিশেষ কোর্ট যথাক্রমে বিধানসভা সদস্যদের ১৪১, ১০৭, ৮৭ এবং ৬৭টি মামলার শুনানি করবে। তা ছাড়া অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ুতেও একটি করে আদালত গঠিত হবে।” সূত্র প্রথম আলো। একই রকম পদক্ষেপ আমাদের দেশেও নেওয়া যায় কি না, ভেবে দেখা যায়।

দেশ বিভাগের পর যে টানাপোড়েন, তা মিটমাটের জন্য উপনিবেশ শাসকেরা সব ক্ষেত্রে সফল ছিলেন বলা যাবে না। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এখনো অমীমাংসিত নানা ইস্যুতে। তবে ভারত-বাংলাদেশ কিছু অস্বস্তি নিয়েও সাংস্কৃতিকভাবে এখনো যেকোনো বিষয়ে ঐকমত্যকেই প্রাধান্য দেয়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা বিষয়ে বৈচিত্র্যময়তাকে বাঁচিয়ে রেখে এখনো একসঙ্গে লক্ষ্যাভিমুখী।

সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক বৈপরীত্য সত্ত্বেও দেশ দুটি এখনো পারস্পরিকতাকে প্রাধান্য দেয়। এই যৌথতা, এই পারস্পরিকতা দেশ দুটির অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের নিয়ামক। আমাদের সম্মিলিত স্মৃতিসঞ্জাত অভিজ্ঞতা বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান আর যৌথ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াস অভিন্ন আঞ্চলিক লক্ষ্য অর্জনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগ। এমন যৌথ সম্মেলন আমাদের সক্ষমতার স্মারক।

  • এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ