একটি কল্প স্কুলের সত্যিকারের সময় ভ্রমণ

ভিয়েতনামের শিল্পী থাও নওয়েন ফ্যান এমন একটি কাল্পনিক স্কুলের কথা বলছেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের শিক্ষাক্রম তৈরি করে এবং তা আবার নিজেরাই বাস্তবায়ন করে
ছবি: সংগৃহীত

না, এটা টাইম মেশিনে ঘুরে বেড়ানোর গল্প নয়, একটা শিল্পকর্ম মাত্র। ঢাকা আর্ট সামিটে প্রদর্শিত ভিয়েতনামের শিল্পী থাও নওয়েন ফ্যানের একটি ডাবল-চ্যানেল সিনক্রোনাইজড ভিডিও ইনস্টলেশন—‘ট্রপিক্যাল সিয়েস্তা।’ শিল্পী এখানে এমন একটি কাল্পনিক স্কুলের কথা বলছেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের শিক্ষাক্রম তৈরি করে এবং তা আবার নিজেরাই বাস্তবায়ন করে।

এসব শিক্ষার্থী যে গ্রামে বাস করে, সেখানে সময় থেমে গেছে অনেক আগে, ১৬৫১ সালে, ধানখেতের অশেষ প্রশান্তিতে। স্বয়ংসম্পূর্ণ সেই গ্রামে আলেজান্ডার দ্য রোডস নামে একটি স্কুল আছে। সেই স্কুলে শুধু শিশুরাই যায়। শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক বা দপ্তরির কাজ করার জন্য সেখানে কোনো বড় মানুষ নেই।

শিশুদের কাছে শুধু একটা বই-ই আছে। আলেজান্ডার দ্য রোডসের ১৬৫১ সালের লেখা ‘টনকিন রাজ্যের ইতিহাস’। শিশুরা কেবল ওই বইয়ের গল্পগুলোই পড়ার সুযোগ পায়। কারণ, অন্য সব বই বা স্মৃতি এমন এক জায়গায় তালা মারা আছে যে তার চাবিটা তো হারিয়ে গেছেই, ওই জায়গায়টাও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

যাহোক, শিশুরা ওই সব গল্পকে নিজেদের মতো করে নানানভাবে নতুন করে সাজায়। তারপর অতীতের সব মিথ, রীতিনীতি বা জীবনযাত্রাকে অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলে। এ অভিনয় আবার প্রচলিত অর্থে মঞ্চস্থ হয় না। এটা হয় ক্লাসরুম বা খোলা প্রান্তরে, ধানখেত কিংবা জলাশয়ে। অভিনয়রীতিটা অনেকটা স্তানিস্লাভস্কিয়—‘অভিজ্ঞতা অর্জনের শিল্প।’

ওই গ্রামে ইটপাথরের একটিই বাড়ি আছে। ওই ভাঙাচোরা স্কুলটি। ভিডিওটির শুরুর দিকে একটা পেইন্টিং থাকে, যেখানে দেখা যায় শিশুরা বেঞ্চের ওপর শুয়ে ঘুমাচ্ছে। তারপর সেই ছবির মানুষগুলোই সত্যিকারের মানুষ হয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। ওদের দেখে মনে হয় স্কুলের বেঞ্চগুলোর ওপর শুয়ে ঘুমানোটা খুবই স্বাভাবিক, নিত্যনৈমিত্তিক একটা বিষয়।

এরপর শিশুরা সেই সময়কার প্রচলিত গল্পগুলোর বাস্তব রূপ দেওয়া শুরু করে। ‘পাপ ও শাস্তি’, ‘জলদেবী’ এ রকম সব গল্প। রোডস তাঁর বইয়ে সপ্তদশ শতকের ভিয়েতনামে কারাবন্দীদের যেভাবে শাস্তি দেওয়া হতো, তার বর্ণনা দিয়েছেন। সেই সময় কারাবন্দীদের কোনো খাবার দেওয়া হতো না। কারাবন্দীদের লাইন করে দাঁড় করানোর পর একটা বড় মইয়ের ফাঁকগুলোতে তাদের মাথা ঢুকিয়ে আটকে দেওয়া হতো। তারপর মইয়ের মধ্যে আটকে থাকা সারিবদ্ধ কয়েদিরা গ্রামবাসীর কাছ থেকে খাবার ভিক্ষা করে আনত। ভিডিওতে দেখা যাবে স্কুলের শিশুরা ওই একইভাবে মইয়ের ফাঁকগুলোতে মাথা ঢুকিয়ে খেতের আল ধরে ভিক্ষা করতে বেরিয়েছে।

ফ্যান অবশ্য মনে করেন, কেবল জানাবোঝাটাই যথেষ্ট নয়। এই ভিডিওতে শিশুরা অতীতকে যে কেবল জানে তা নয়, তারা নিজেদের মতো করে তার পুনর্নির্মাণ করে সেখানে বাস করে। ফলে এটা সময় ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে একধরনের সময় নির্মাণও বটে। আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্যও এ ধরনের সময় ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে একদিকে ইতিহাসবিস্মৃতি ঘটবে, অন্যদিকে তাদের মানুষ হয়ে ওঠার পথটা এখন যেমন, সে রকমই বন্ধুর থেকে যাবে।

রোডস ‘রানির দরজা’ বলে সেই সময় প্রচলিত একটা মিথের বর্ণনা দিয়েছেন। এক চায়নিজ রাজকুমারীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তার বাবা তাকে পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলে। পরে যখন মানুষ ওই রাজকুমারীর লাশটি খুঁজে পায়, তার পাশে স্থানীয় এক গ্রামবাসীর লাশকেও ভেসে থাকতে দেখে। এই দুটি লাশকে একই জায়গায় কবর দেওয়া হয়।

এবং ওই জায়গার নাম হয়ে যায় রানির দরজা। ঘটনাটাও শিশুরা নদীর পাড়ে নিজেদের মতো করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। যে মেয়েটি রানি হয়, সে সুন্দর জামাকাপড় পরে মড়ার অভিনয় করে। তবে একপর্যায়ে তাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখা যায়। আর গ্রাম্য লোকটির ভূমিকায় অভিনয় করা ছেলেটি ছিল নগ্ন, কিন্তু তার মুখ দেখা যায়নি।

ভিডিওটির অনেক জায়গায় প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় শিশুদের ব্যাকুল হয়ে উঠতে দেখা যায়। কখনো কখনো তারা খেতের আলের ওপর চিত হয়ে শুয়ে থাকে। কখনো কখনো তারা ধুলামাটি গায়ে মেখে মেঠো রাস্তায় গড়াতে গড়াতে বহুদূর চলে যায়, কখনোবা উদোম হয়ে অন্ধকার টানেলে পানির ওপর হাঁটতে থাকে।

একজন জাদুকর যেমন বিজ্ঞান ও কুসংস্কার দিয়ে বিনুনি গাঁথে, ফ্যানও এখানে যুক্তি ও ভ্রমের মালা গেঁথেছেন; মিথকে জীবন্ত করে তুলেছেন। রোঁলা বার্থ বলেছিলেন, মিথ হচ্ছে একধরনের কথা, যাকে ইতিহাস যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখে। ফলে প্রতিটি মিথের কিছু বলার থাকে।

আরও পড়ুন

ফ্যানও বাচ্চাদের দিয়ে মিথকে নতুনভাবে জীবন্ত করে আমাদের কিছু বলতে চাইছেন। বলা ভালো, কিছু প্রশ্ন করছেন—আমাদের মিথগুলো যদি হারিয়ে যায় বা আমরা যদি আমাদের মিথগুলোকে আবার নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারি, তাহলে আমরা আমাদের অতীত সম্পর্কে জানব কীভাবে? এবং আমরা যদি সেই সব স্বপ্ন ও ভয় বিস্মৃত হই, তাহলে আমাদের মানবিক গুণাবলি বলে কি আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে?

যাঁরা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা নান্দনিক ও দার্শনিক বিষয়গুলো ছাড়াও আরেকটি কারণে শিল্পকর্মটির প্রতি আকৃষ্ট হবেন। সেটি হচ্ছে শিখন-শেখানো পদ্ধতি। ফ্যান যেটা বিশ্বাস করেন, সেটা হচ্ছে আমরা যদি শিক্ষার্থীদের সত্যিই আমাদের অতীত সম্পর্কে জানাতে চাই, তাহলে তাদের বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে অতীতের ‘কুসংস্কারের’ কথাও বলতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যুক্তির পাশাপাশি যেসব ‘ভ্রম’-এ বিভ্রান্ত হতেন, সেটা জানাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই ‘কুসংস্কার’ বা ‘বিভ্রান্তি’ না বুঝলে, যারা এসব গভীরভাবে বিশ্বাস করত, অতীতের সেই মানুষের বোঝা কঠিন।

ফ্যান অবশ্য মনে করেন, কেবল জানাবোঝাটাই যথেষ্ট নয়। এই ভিডিওতে শিশুরা অতীতকে যে কেবল জানে তা নয়, তারা নিজেদের মতো করে তার পুনর্নির্মাণ করে সেখানে বাস করে। ফলে এটা সময় ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে একধরনের সময় নির্মাণও বটে। আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্যও এ ধরনের সময় ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে একদিকে ইতিহাসবিস্মৃতি ঘটবে, অন্যদিকে তাদের মানুষ হয়ে ওঠার পথটা এখন যেমন, সে রকমই বন্ধুর থেকে যাবে।

  • সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক