বিশ্লেষণ
নির্বাচনী কৌশলই নির্ধারণ করবে এনসিপির ভবিষ্যৎ
এনসিপির সম্ভাব্য নির্বাচনী কৌশল ও ভবিষ্যৎ নিয়ে লিখেছেন এস কে তৌফিক হক, সৈয়দা লাসনা কবীর ও মোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একাংশ উপলব্ধি করতে থাকে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি নতুন বিকল্প শক্তির প্রয়োজন রয়েছে।
পুরোনো পদ্ধতির রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন, গণমুখী, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রয়োজনীয়তা তখন প্রবল হয়ে ওঠে। এ ভাবনা থেকেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের একাংশ ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) গঠন করে।
এটা সত্য যে এই দলের শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন সেই তরুণেরাই, যাঁরা জুলাইয়ের আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন। ফলে গণ–অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী জনগণের অনেক প্রত্যাশা ও স্বপ্ন এই দলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
সেই স্বপ্নকে সফল করতে হলে এনসিপিকে শুধু শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করলেই হবে না, তাদের প্রয়োজন হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, ধৈর্য ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে হলে এনসিপিকে দীর্ঘ মেয়াদে একটি পরিণত ও সুসংগঠিত বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এনসিপির জনসমর্থন: সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ
২০২৫ সালের মে-জুন সময়কালে সানেম নামে গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে এনসিপির জনপ্রিয়তা তুলনামূলক বেশি, বিশেষত তরুণ ও শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে।
জরিপে পুরুষ তরুণদের মধ্যে এনসিপির প্রতি সমর্থন ছিল ১৪ দশমিক ৪৪% এবং তরুণ নারীদের মধ্যে ১৭ দশমিক ৪৭%, যা ইঙ্গিত করে যে নারী ও যুবসমাজে তাদের প্রভাব বাড়ছে। তবে এই সমর্থন এখনো মূলত ইচ্ছা বা সম্ভাবনার পর্যায়ে রয়েছে। নির্বাচনী প্রচার, প্রার্থী বাছাই ও রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে এই পরিসংখ্যান পরিবর্তিত হতে পারে। যেহেতু এনসিপি একটি নবীন দল, সেহেতু তাদের এই আগাম সমর্থন কতটা ভোটব্যাংকে রূপান্তরিত হবে, তা আগামী নির্বাচনেই স্পষ্ট হবে।
নবীন দল হিসেবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সাফল্যের শীর্ষে ওঠার ক্ষেত্রে এনিসিপির জন্য উদাহরণ হতে পারে ভারতের ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) অথবা পাকিস্তানের ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। ভারতে বিজেপি ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, ১৯৮২ সালের নির্বাচনে মাত্র দুটি সিট পেয়েছিল। তবে মাত্র ১৪ বছর পর ১৯৯৬ সালে তারা প্রথমবার ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয়।
অন্যদিকে পাকিস্তানে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ২০০২ সালের নির্বাচনে একটি মাত্র আসন লাভ করেছিল। তবে পরবর্তী ১৬ বছরে তারা পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে এবং বর্তমানে জনপ্রিয় ভোটের হিসাবে পাকিস্তানের সবচেয়ে বৃহৎ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, বিজেপির ক্ষেত্রে কট্টর ধর্মীয় আদর্শ ও পিটিআইয়ের ক্ষেত্রে ইমরান খানের ক্যারিশম্যাটিক লিডারশিপ ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ ক্ষেত্রে এই দুটি বিষয়ের বাইরে গিয়ে এনসিপিকে নতুন কোনো কার্যকরী কৌশল খুঁজে বের করতে হবে, যা তাদের বৃহৎ দল হতে সহায়তা করবে।
এনসিপির চারটি নির্বাচনী কৌশল
একটি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আদলে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল ভবিষ্যতে কত দিন টিকে থাকবে, কতটা প্রভাব ফেলবে কিংবা রাষ্ট্র গঠনে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করে তাদের নির্বাচনী কৌশলের ওপর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় মানুষ সাধারণত সেই দলকে সমর্থন করে, যার বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বা যে দল ক্ষমতার আশপাশে যেতে সক্ষম। কোনো দল যদি বারবার নির্বাচনে ব্যর্থ হয় বা দৃশ্যমান ফলাফল আনতে না পারে, তাহলে তার প্রতি জনগণের আগ্রহ ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।
এই পটভূমিতে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনার দিকে তাকালে এনসিপির সামনে এক বড় চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়ায় তারা তাদের বিদ্যমান তরুণ ও সচেতন সমর্থক গোষ্ঠীকে কীভাবে কার্যকরভাবে কাজে লাগাবে। একটি নতুন দল হিসেবে এনসিপির একটি উঠতি ‘সাপোর্ট বেজ’ থাকলেও সেটিকে ভোটে রূপান্তর করা এবং নির্বাচনী মাঠে তা পরিণত ফলাফলে রূপ দেওয়াটা সহজ বিষয় নয়। এ ক্ষেত্রে তাদের সম্ভাব্য চারটি কৌশল থাকতে পারে:
১. নির্বাচন বয়কট:
প্রথম অপশন হিসেবে তারা নির্বাচন বয়কটের পথ বেছে নিতে পারে, বিশেষ করে যদি তাদের ঘোষিত রাজনৈতিক লক্ষ্য, যেমন নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন বা ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশ, বাস্তবায়িত না হয়। এনসিপি যেহেতু দাবি করেছে যে বিদ্যমান সংবিধানই স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে এবং শেখ হাসিনার মতো নেতাদের হাতে নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করতে সহায়তা করেছে, সেহেতু যদি এই সংবিধানের কাঠামোতেই তারা নির্বাচনে অংশ নেয় বা মৌন থাকে, তাহলে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যেতে পারে।
এ ছাড়া এনসিপির একটি বড় দাবি ছিল আওয়ামী লীগের বিচার, বিশেষ করে অতীতে সংঘটিত দমন-পীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় নিরপেক্ষভাবে নিরূপণ করা। আওয়ামী লীগের বিচারের বাস্তবায়ন যদি থেমে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার পুনরুদ্ধারে পুরোনো রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ফিরে আসার আশঙ্কা থেকেই যায়। এসব বাস্তবতা মিলিয়ে যদি এনসিপি দেখতে পায় যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া তাদের কোনো রাজনৈতিক দাবি বাস্তবায়নে সহায়ক নয়, তাহলে তারা নির্বাচন বয়কটের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সেটা হলে তাতে অবাক হওয়ারও কিছু থাকবে না।
২. বিএনপির সঙ্গে জোট:
এনসিপির জন্য দ্বিতীয় সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে একটি নির্বাচনী জোট বা নির্বাচনী সমঝোতায় উপনীত হওয়া। এই পথ অবলম্বনের মধ্য দিয়ে এনসিপি দ্রুতই ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে এবং এতে তাদের তরুণ ভোটারদের মধ্যে একধরনের তাৎক্ষণিক আশাবাদ জন্ম নিতে পারে। সমর্থকেরা হয়তো ধরে নেবেন, তাঁদের সমর্থিত দল ক্ষমতার অংশ হতে চলেছে এবং অনেকেই সেটিকে রাজনৈতিক বাস্তববুদ্ধির অংশ হিসেবে গ্রহণ করবেন।
এই কৌশলের একটি বড় অন্তর্নিহিত ঝুঁকিও রয়েছে। এনসিপি শুরু থেকেই নিজেকে একটি ‘নতুন রাজনীতির’ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে, যেখানে পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বাইরে গিয়ে একটি ‘নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা’ ও ‘সেকেন্ড রিপাবলিকের’ দাবি তারা তুলে ধরেছে। সেই পটভূমিতে যদি তারা অতীতের ক্ষমতাসীন বা পুরোনো প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে যাত্রা শুরু করে, তাহলে জনগণের একটি বড় অংশের চোখে এনসিপির ‘নতুনত্ব ও রাজনৈতিক সততা’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান ঝাপসা হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে, অতীতে অনেক ছোট দল বৃহৎ রাজনৈতিক জোটে অংশগ্রহণ করে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। বড় দলের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তারা শেষ পর্যন্ত নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি ও রাজনৈতিক স্বকীয়তা হারিয়েছে। শুধু নির্বাচনের সময়ই নয়, আন্দোলন, দমন-পীড়নের সময় কিংবা কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর্যায়েও তারা বড় দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেনি। এ কারণে জোটে গেলেও তারা নেতৃত্ব দিতে পারেনি, বরং ধীরে ধীরে ছোট দল হিসেবেই ক্ষয়ে গেছে।
৩. ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোট:
এনসিপির সামনে আরেকটি সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটি কৌশলগত জোট গঠন করা। বাংলাদেশে ইসলামি ধারার রাজনৈতিক শক্তিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই একটি স্থায়ী ভোটব্যাংক ধরে রেখেছে, বিশেষত গ্রাম ও মফস্সলকেন্দ্রিক এলাকাগুলোয়। যদি এনসিপি তাদের নিজস্ব সম্ভাব্য ভোটারভিত্তিকে এ ধারার সঙ্গে একত্র করতে সক্ষম হয়, তাহলে সম্মিলিতভাবে তারা দেশের রাজনৈতিক অঙ্কে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ভোটের ঘরে পৌঁছে যেতে পারে, যা একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ খুলে দিতে পারে।
এ ধরনের জোট গঠনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ লাভ হতে পারে এনসিপির জন্য বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সম্ভাবনা। যদি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠনে সফল হয়, তাহলে এনসিপি-ইসলামি জোট জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। বিরোধী দল হিসেবে থাকা মানে শুধু ক্ষমতার কাঠামোর অংশ হওয়া নয়, বরং একটি শক্তিশালী সংগঠন ও রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হাতে পাওয়া। এটি তাদের আন্দোলন, কর্মী বাহিনী গঠন ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অবস্থান তৈরির ক্ষেত্রেও বড় সুযোগ করে দিতে পারে।
তবে এই কৌশলের একটি বড় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ঝুঁকিও রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে, বিশেষত ভারতের মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহলে এনসিপিকে অনেক সময়ই ডানপন্থী বা ইসলাম অভিমুখী শক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা দেখা গেছে। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানকে অনেক সময় ‘মৌলবাদের উত্থান’ বলেও চিত্রায়িত করা হয়েছে। যদি এনসিপি সরাসরি ইসলামি জোটের সঙ্গে মৈত্রী করে, তাহলে ভারত ও আওয়ামী লীগ এসব বক্তব্য আরও বেশি জোরালোভাবে প্রচার করার চেষ্টা করতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া, রাজনীতিতে প্রভাবশালী অবস্থান নিশ্চিত করা এবং মাঠপর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলার দিক থেকে এই কৌশল এনসিপির জন্য একধরনের বাস্তববাদী ও সম্ভাবনাময় রোডম্যাপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
শেষ পর্যন্ত এনসিপি যে নির্বাচনী কৌশলই গ্রহণ করুক না কেন, প্রতিটি কৌশলেরই কিছু নির্দিষ্ট সুবিধা ও অসুবিধা থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা যেন এমন একটি কৌশল বেছে নেয়, যা তাদের দীর্ঘ মেয়াদে একটি টেকসই ও আদর্শিক রাজনৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। যদি তারা শুধু তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক লাভের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে তাদের আদর্শিক ভিত্তি ও ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।
৪. এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ:
এনসিপির জন্য চতুর্থ সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। এটি একটি সাহসী সিদ্ধান্ত হবে। কারণ, বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি নবীন দলের পক্ষে এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া অত্যন্ত কঠিন। যদিও এনসিপির সম্ভাব্য ভোট সম্পর্কে বিভিন্ন জরিপে বিভিন্ন রকম ফলাফল এসেছে। তবে বাস্তবতার কঠিন চিত্র হলো, এই ভোট দিয়েও তারা সংসদে একটি আসন নিশ্চিত করতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, যদি না তাদের নির্দিষ্ট কিছু ‘পকেট সিট’ অথবা উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু হয়।
বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত এনসিপি সে ধরনের কোনো নির্বাচনী ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারেনি, যেখানে তারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কিছু আসনে বিজয়ের আশা করতে পারে। ফলে এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে ফলাফল খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। আর যদি নির্বাচনী ফলাফল হতাশাজনক হয়, তাহলে দলটির নেতা–কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে মনোবল ভেঙে পড়তে পারে, এমনকি তরুণ ভোটারদের একটি অংশ হয়তো দল থেকে মুখ ফিরিয়েও নিতে পারে।
তবে এর উল্টো দিকেও কিছু উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে। যদি এনসিপি এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়, তাহলে দেশের প্রতিটি এলাকায় একটি শক্ত অবস্থান গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি হবে। স্থানীয় পর্যায়ে নেতা–কর্মী তৈরি হবে, নির্বাচনী অভিজ্ঞতা বাড়বে এবং দলটি মাঠপর্যায়ে একটি সক্রিয় কাঠামো গড়ে তুলতে পারবে। এতে করে হয়তো প্রথম নির্বাচনে তারা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসনে জয়ী হতে না পারলেও ভবিষ্যতের স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে তাদের জন্য এটি একটি শক্ত ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
এ ছাড়া এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে এনসিপি নিজেদের আদর্শিক অবস্থান এবং স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারবে, তাদের ‘নতুন রাজনীতি’র প্রতিশ্রুতি ক্ষুণ্ন হবে না; বরং আরও শক্তিশালী বার্তা যাবে যে তারা কাউকে অনুসরণ নয়, নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন নজির খুব কমই আছে যে কোনো নতুন দল এককভাবে নির্বাচনে গিয়ে বড় সফলতা পেয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক পরিপক্বতা অর্জনের জন্য এই কৌশল একটি বাস্তবভিত্তিক ও গঠনমূলক পদক্ষেপ হতে পারে।
তবে শেষ পর্যন্ত এনসিপি যে নির্বাচনী কৌশলই গ্রহণ করুক না কেন, প্রতিটি কৌশলেরই কিছু নির্দিষ্ট সুবিধা ও অসুবিধা থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা যেন এমন একটি কৌশল বেছে নেয়, যা তাদের দীর্ঘ মেয়াদে একটি টেকসই ও আদর্শিক রাজনৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। যদি তারা শুধু তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক লাভের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে তাদের আদর্শিক ভিত্তি ও ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।
তাই এনসিপির উচিত হবে এমন একটি নির্বাচনী কৌশল গ্রহণ করা, যা একদিকে নির্বাচনে বাস্তবসম্মত সাফল্যের সম্ভাবনা তৈরি করবে, আর অন্যদিকে তাদের মূল রাজনৈতিক দর্শন ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ থাকবে। এই দুইয়ের ভারসাম্য বজায় রাখাই হবে তাদের সাফল্য অর্জনের সবচেয়ে কার্যকর রোডম্যাপ।
এস কে তৌফিক হক অধ্যাপক ও পরিচালক, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
সৈয়দা লাসনা কবীর অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল গবেষণা সহযোগী, এসআইপিজি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
*মতামত লেখকদের নিজস্ব