নিয়ত শোকের সঙ্গে বসবাসেও জিইয়ে থাক আশা

বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ড

বঙ্গবাজার পুড়ে ছাই হয়ে গেল। পুড়ল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, জামাকাপড়, জীবন-জীবিকা। পুড়ল ব্যবসায়ীদের হৃদয়। দেশে-বিদেশে হাজারো মানুষ প্রযুক্তির কল্যাণে আগুনের এ দীর্ঘ ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছে।

প্রযুক্তির কল্যাণে শোকে সংযুক্তি বেড়েছে। মানুষ সংযুক্ত হচ্ছে সুখে-দুখে-আনন্দ-উৎসবে। বঙ্গবাজারের আগুনের তাপ পৌঁছে গেছে সিডনি, টরন্টো, নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাভাষীদের কাছে।

এ বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতি হয়তো একদিন পূরণ হয়ে যাবে, কিন্তু মনের গহিনে যে ক্ষত তৈরি হলো, তা থাকবে দীর্ঘদিন। দুর্ঘটনার দগদগে ছবি, ধোঁয়ার কুণ্ডলী, পুড়ে যাওয়া জামাকাপড় আর মানুষের হাহাকারের শেষ ঠিকানা জনস্মৃতি। জনস্মৃতিতে নিয়ত বাজছে বেদনার ঢং ঢং ঘণ্টা।

এ সমাজ এত ঘটনাবহুল হয়ে উঠল, ভাবা যায় না। সমকালীন ইস্যুগুলোর দিকে একটু চোখ রাখলে দেখা যায়, স্যার, রুচির সংকট, সাংবাদিক গ্রেপ্তার, বঙ্গবাজারে আগুন। ইস্যুর অভাব নেই। দম ফেলার জো নেই। জনস্মৃতি আজ নেতির ভান্ডার। ঘটনাপ্রবাহ জনগণকে তাৎক্ষণিকতার মধ্যে বাস করতে বাধ্য করছে। ব্যক্তি তাৎক্ষণিক হয়ে উঠছে। সামনের ও পেছনের থাকছে না তার কোনো স্মৃতিস্মারক।

জনস্মৃতিতে সুখকর কিছু জমছে না। অথচ জনস্মৃতি হলো অনুভবের এক বিশেষ বুনন। মার্ক্সবাদী সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিক রেমন্ড উইলিয়াম যাকে বলেছিলেন স্ট্রাকচার অব ফিলিং, অর্থাৎ অনুভব কাঠামো, যা মানুষের বিবেক ও সম্পর্কবোধের এক বিশেষ নির্মাণ। অনুভব কাঠামো হলো বিনিসুতার মালা। ব্যক্তি ও সমাজজীবনের অদেখা বুনন। এ বুননের ওপর সমাজ টিকে থাকে। সম্পর্ক আর ঘটনাকে ঘিরে তৈরি হয় অনুভব কাঠামো ও জনস্মৃতি। সমকালীন জনস্মৃতির ফ্রেম দুঃখ-কষ্টের ভঙ্গুর রসায়ন। জনস্মৃতি আজ সংযুক্তি নয়, বিভক্তির স্মারক হয়ে উঠেছে।

আগুনে পুড়ছে রাজধানীর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স। নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। গতকাল সকালে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

যা হোক, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে টাকার হিসাবে শোক মাপতে বসি। টাকার প্রসঙ্গটি আসে দ্রুতগতিতে। টাকার পরিমাণ আর সংখ্যার ভেতর জীবনের বিপর্যয় খুঁজি। দিন শেষে সবকিছু হয়ে ওঠে পরিসংখ্যাননির্ভর। দুর্ঘটনার হিসাব কষতে টাকামুখী মানুষের এ এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি।

এতে করে শোকের পরিধি অধরা থেকে যায়। শোকের আয়ু কমিয়ে ফেলা হয়। তুরস্কের কবি নাজিম হেকমত যেমনটি বলেছেন, বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর। বঙ্গবাজারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে না। এ শোকের আয়ু হয়তো হবে এক সপ্তাহ বা বড়জোর এক মাস। আরেকটি ইস্যু আসবে। খোলা হবে শোকের খাতা। এরপর পূরণ হতে থাকবে শূন্য ঘরগুলো। কেবল পরিসংখ্যানের ভেতর সত্য থাকে না। সত্য থাকে না কোনো একক মাত্রায়। মানসিক বিপর্যয়ের কোনো পরিসংখ্যানগত হিসাব হয় না।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে একজন ব্যবসায়ীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার ১৫ কোটি টাকার ব্যবসা ছিল। ৪০ জন কর্মচারী ছিল। ঘটনার দিন ক্যাশবাক্সে নগদ ১৫ লাখ টাকা ছিল। আগুনে সব পুড়ে গেছে। তিনি মুহূর্তেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন।

এ নিঃস্বকরণ কেবল আর্থিক ব্যাপার নয়, মানবিক মর্যাদার বিষয়ও বটে। এ ব্যবসাকে ঘিরে তাঁর যে সামাজিক মর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধ তৈরি ছিল, তা হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি এখন পদে পদে বাধা পাবেন। ছোট হবেন। ব্যক্তিমর্যাদা হারাবেন। তাঁর ভেতর হীনম্মন্যতাবোধ তৈরি হবে। তাঁর মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। এত কিছুর তো আর অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কেবল আর্থিক নয় মানবিক ও মর্যাদাগত যে ক্ষতি হলো, তা অপরিমাপযোগ্য।

চোখের সামনে ঘটা এ ভয়াবহতা তাঁদের মনে যে ট্রমা তৈরি করল, তা কীভাবে দূর হবে? জানি, ব্যবসায়ীদের এ শোকগাথা নিজেদের প্রচেষ্টায় কাটিয়ে উঠতে হবে। এখানে শোক ব্যবস্থাপনায় নেই কোনো উন্নত বিকল্প। অথচ জনগণকে নিয়ত বাস করতে হচ্ছে শোকের সঙ্গে।

বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়াতে শুরু করেছে। এটাই মানুষের ধর্ম। আইজেন শোপেনহাওয়ার বলেছিলেন, কম্প্যাশন ইজ দ্য বেসিস অব মরালিটি, অর্থাৎ সহমর্মিতা নৈতিকতার ভিত্তি। মানুষের ভেতর সহমর্মিতার বোধ না থাকলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।

যেকোনো সংকটে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর অদম্য স্পৃহা এ দেশের মানুষের দেখিয়েছে বারবার। মানুষের এ পরার্থবোধ এত স্নিগ্ধ, ভাবা যায় না। মানুষকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই মানুষকে পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ, এ জীবন সমাজচালিত কিন্তু রাষ্ট্রশাসিত। যেকোনো বিপর্যয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ থাকে, তৎপরতা থাকে, কিন্তু তা মানুষের উদ্যোগের চেয়ে বড়, এমনটি বলা যাবে না।

পাবলো নেরুদা তাঁর আ বায়োগ্রাফি অব পয়েট-এ বলেছেন, ব্যক্তি একসঙ্গে অনেকগুলো জীবন যাপন করে। এটি ব্যক্তির যাপিত জীবনের এক বিশেষ দিক। ব্যক্তিজীবন সামষ্টিক জীবনের অংশ। বাড়িতে পোষা বিড়াল, বারান্দায় ফুলের গাছ, রাস্তায় দিয়ে হেঁটে চলা ভিখারির আহাজারি বা প্রতিবেশীর মৃত্যু, কিংবা কারও প্রতি অনায্য আচরণ—প্রতিটির সঙ্গে রয়েছে ব্যক্তির বিশেষ সংযুক্তি। এ বহুমাত্রিকতা নিয়ে তাঁর জীবনের ক্যানভাস।

প্রাণ-প্রকৃতি-মানুষের যৌথ সুখ-দুঃখবোধ ব্যক্তিকে তাড়িত করে। অন্যের দুঃখে সে কষ্ট পায়, সুখে আনন্দ পায়। সেই অর্থে কোনো সুখ যেমন একক কারও নয়, তেমন কোনো দুঃখও একক কারও নয়। বঙ্গবাজারের দুঃখ কেবল ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নয়, এটি সংবেদনশীল প্রতিটি মানুষের দুঃখ।

নানা সংকটে দেখা গেছে, এ দেশের সাধারণ মানুষের রয়েছে অন্যকে আপন করা অদম্য শক্তি। ক্ষিতিমোহন সেন সম্ভবত ভারতের সংস্কৃতি বা চিন্ময় বঙ্গ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, অনার্যরা সহজেই অন্যদের আপন করতে পেরেছে। এ শক্তি অনার্য সংস্কৃতির এক মৌলিক দিক। আর্যরা বাইরে থেকে এসেছিল, তাদের ছিল গৌরবর্ণ আর উঁচু নাক। আর্যরা অনার্যদের অচ্ছুত জ্ঞান করেছিল, উপেক্ষা করেছিল, অবহেলা করেছিল।

আর্যরা কথা তুলেছিল অনার্যদের গায়ের রং ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ে। অনার্যদের পানির কাছাকাছি বসবাস ও মাছ খাওয়া নিয়েও তারা কথা তুলতে ভোলেনি। আর্যরা ছিল মাংসাশী, তাদের ছিল নগরপ্রীতি।
আর্যরা যে বিভক্তি রেখা টানতে চেয়েছিল, অনার্যরা তাকে গ্রাহ্য করেনি। তাদের মন ছিল সমন্বয়বাদী, আপনের ঘ্রাণে ভরপুর। বাঙালি অনার্যদের উত্তরসূরি, তাদের হৃদয়ে রয়েছে বিশেষ সক্রিয়তা। এ অন্তর্বাসী সত্তাকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন—
“মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে
একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-পরে-
প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।।”

আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে বঙ্গবাজার মার্কেট
ছবি: প্রথম আলো

অন্তর-সম্পদই মানুষকে মহৎ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যত্র বলেছেন, এ দেশে প্রাণের নামে, মানবতার নামে ডাক দিলে সাড়া পাওয়া যায়। বঙ্গবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে অন্তর-সম্পদ নিয়ে সবাইকে দাঁড়াতে হবে।

যেকোনো দুর্ঘটনারোধে রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব রয়েছে। প্রতিটি মানুষের জীবনের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা লাভের অধিকার রয়েছে। রয়েছে জীবিকার নিশ্চয়তা। মানবাধিকারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এসব স্বীকৃত। কিন্তু এ রাষ্ট্রে জীবন এত সস্তা হলো, ভাবা যায় না। নিরাপদ জীবিকাও দুরাশামাত্র।

একটি দুর্ঘটনা যখন বারবার ঘটে, তখন তাকে দুর্ঘটনা বলা যায় না। মানবাধিকার ভাষ্যে (ডিসকোর্সে) একে বলা হয় পদ্ধতিগত সহিংসতা (সিস্টেমেটিক ভায়লেন্স)। আগুনকেন্দ্রিক দুর্ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। এটাকে কী কেবল দুর্ঘটনা বলা যাবে? যেহেতু এটি প্রায়ই ঘটছে, সুতরাং এর পেছনে রয়েছে বিশেষ রাজনীতি, বিশেষ অর্থনীতি। দুর্ঘটনার কারণ ও নেক্সাসগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। এটা ভালোভাবে দেখতে না পারলে ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী যাকে বলছেন ‘বর্তমান সর্বস্ব’, অর্থাৎ বর্তমানে ভেতর ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাবে।

কথা হলো, পরিস্থিতি যতই ভয়াবহ হোক, আশাটুকু জিইয়ে রাখতে হবে। জার্মান কবি গ্যেটে বলেছেন, আশাবাদী মনোভাব হতাশার চেয়ে কল্যাণকর। আসুন, বঙ্গবাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াই। পরার্থবোধের সারথি হই।

  • খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগ-বিশেষজ্ঞ