হাওর ও জলাভূমির উন্নয়ন ও আমাদের ভালো থাকা

হাওর এলাকার প্রতি জেলা উপজেলার সঙ্গে গ্রাম বন্দরের সঙ্গে নৌ চ্যানেল বানানো যেতে পারেছবি : প্রথম আলো

জলাভূমি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হয়। ২০২৫ সালের বিশ্ব জলাভূমি দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘জলাভূমি ও মানবকল্যাণ’। ১৯০০ সাল থেকে বিশ্ব প্রায় ৬৪ থেকে ৭১ শতাংশ জলাভূমি হারিয়েছে। যদিও আমাদের দেশে এখনো জলাভূমির পরিমাণ ৪৩ শতাংশ। কিন্তু সেই পরিমাণ দ্রুত কমছে। শুধু ঢাকা শহরের ৬৯ শতাংশ জলাভূমির বিলুপ্তি ঘটেছে।

জলাভূমির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের পুরো বাস্তুতন্ত্র। আমাদের দেশের জলাভূমির অন্যতম উৎস হলো বাংলাদেশের সাতটি হাওর–অধ্যুষিত জেলা।

জেলাগুলো হলো সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এই হাওরাঞ্চলে দেশের মোট বোরো ধানের ১৮ শতাংশ, মাছের ২০ শতাংশ ও গবাদি পশুর ২২ শতাংশ উৎপাদিত হয়। বর্তমানে হাওরে পর্যটনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। শুধু এক টাঙ্গুয়ার হাওরেই চলাচল করছে প্রায় দুই শ হাউস বোট।

এ বছর ২ ফেব্রুয়ারি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নে কালনী নদীর পূর্ব পাড়ে উদ্‌যাপিত হচ্ছে দিনব্যাপী হাওর উৎসব। এ উৎসবে অংশগ্রহণকারী থাকবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, বিভিন্ন পেশাজীবী, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকসহ সরকারি ও বেসরকারি অংশীজন। এ দিবসে আমাদের চ্যালেঞ্জ হবে পলি ব্যবস্থাপনা, জলাভূমি দূষণমুক্ত রাখা ও এর সুরক্ষা। আমাদের ভালো থাকা জলাভূমির অস্তিত্বের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল।

১৯৪৭ সালের রেফারেন্ডামে সিলেট পাকিস্তানে থাকবে, নাকি ভারতের অংশ হবে, তার প্রচারণার জন্য ৫০০ জন ছাত্র সিলেট সফর করেন। হাওর অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা পৃথক একটা দপ্তরের কথা চিন্তা করেন। এরই ফলে ১৯৭৪ সালে ‘হাওর উন্নয়ন বোর্ড’ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে ১৯৭৭ সালে গঠিত হয় হাওর উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু নানা কারণে এ দপ্তর ঢিমেতালে চলতে থাকে। এরপর নানা চড়াই–উতরাই পার হয়ে ২০১৬ সালে জলাভূমিকে সংযুক্ত করে বাংলাদেশ ‘হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর’ গঠন করা হয়। উত্তর–পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলাসহ সারা দেশের জলাভূমি নদ–নদী–খাল–বিল নিয়ে এই অধিদপ্তরের কাজ। সমুদ্র ভাগের যে এলাকা ছয় মিটার গভীর, সেটাও এর আওতাভুক্ত।

সুন্দরবন এলাকা ইতিমধ্যেই বিশ্ববাসীর মন কেড়েছে। এখানে পরিদর্শন সহায়ক ও ইকোসিস্টেম উন্নত করার জন্য বিশেষ প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। টাঙ্গুয়ার হাওর ও হাকালুকি হাওর প্রকৃতিকে করেছে অপরূপ। জলাভূমিগুলো কোনটা কোনটার চেয়ে সুন্দর আর সম্পদশালী, তা বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে থাকতে হয়।

জলাভূমি এলাকার মানুষের জীবনমান এবং পরিবেশ আর বাস্তুতন্ত্র আরও উন্নত করার প্রয়াসে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ হা্ওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর। জলাভূমির গুরুত্ব বিবেচনা করে ‘হাওর ও জলাভূমির সুরক্ষা উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা’ আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছে এই অধিদপ্তর।

হাওর অঞ্চলের মানুষ প্রান্তিকতার কারণে অবহেলিত। তাদের প্রয়োজনগুলো মোটামুটিভাবে এ রকম—

হাওরের তলদেশ রক্ষণাবেক্ষণ: বাংলাদেশের জলাভূমির মারাত্মক সমস্যা এখন দাঁড়িয়েছে সেডিমেন্ট। উজানের পাহাড় থেকে পানি নেমে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে পলি। বছরে এক বিলিয়ন টন পলি আসায় হাওর, জলাভূমি ও নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এটা প্রতিহত করার সক্ষমতা আমাদের নেই, তবে ব্যবস্থাপনা করার সুযোগ আছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ মাটি কেটে হাওরের নাব্যতা সারা বছরের জন্য বাড়ানো যায়। জলাভূমির নাব্যতা বাড়াতে পারলে সারা বছর মাছ চাষ করে ছয় থেকে সাত গুণ বেশি আয় করা সম্ভব হবে। ফলে জিডিপি বাড়বে।

মাছের জোগান বাড়ানো, বাইক্কা বিল মডেল: আমাদের দেশে ৩৭৩টি হাওর, ১০০০ নদ–নদী, লক্ষাধিক খাল–বিলে ১০০ কোটি মাছ ছাড়া যায় আবার প্রাকৃতিক মাছগুলোকে বাইক্কা বিলের মতো সংরক্ষণ করা যায়। বাইক্কা বিলে ৩০ থেকে ৪০ কেজি সাইজের মাছ এখন সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এতে যে পরিমাণ মাছ চাষ করা সম্ভব, তাতে আমাদের মাছের উৎপাদন অনেক বেশি হবে। পুষ্টির চাহিদা মিটবে এবং মিঠাপানির মাছ রপ্তানিও করা যাবে। উন্মুক্ত জলাভূমিতে মাছ ছাড়ার প্রবণতা ফিরিয়ে আনতে হবে।

বৃক্ষরোপণ, রাতারগুল মডেল: হাওর ও জলাশয়ে ১০০ কোটি করচগাছ লাগানো যেতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে রাতারগুল পর্যটন এলাকার ন্যায় সব হাওর রাতারগুল হতে পারে। গাছের গোড়ায় মাছ আশ্রয় নিবে এবং গাছের ওপর পাখি আশ্রয় নিতে পারবে। গাছগুলোর শিকড় বাঁধ কিংবা মাটির ক্ষয় থেকে রক্ষা করে। কার্বন অ্যামিশন ড্রামাটিক্যালি কমে আসবে। দেশি প্রজাতি হিজল–তমালগাছও লাগানো যেতে পারে।

পর্যটনে সম্ভাবনা তৈরি: হাওর ও জলাভূমিতে বেড়ানোর ব্যবস্থা করা যায়। মানুষ যেখানে দুই ঘণ্টার বেশি থাকে, সেখানে বাথরুম থাকতে হবে। যেখানে তিন ঘণ্টার বেশি থাকার প্রয়োজন হবে, সেখানে রেস্তোরাঁ থাকতে হবে। কমিউনিটি বেজড পর্যটন পরিচালনা করা যেতে পারে। রেমাক্রি বা সাজেক মডেলে বাড়িতে ভাড়া সিস্টেমে পর্যটক রাখা যেতে পারে। একই সঙ্গে পর্যটকদের খাবার সরবরাহও করা যায়। ফলে স্থানীয় লোকজন অর্থ উপার্জন করতে পারেন আবার পর্যটনে তাঁদের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ—দুটিই বাড়বে।

আমার গ্রাম হবে আমার শহর: হাওরের মানুষের জীবনমান বাড়ানোর জন্য হাওরের গ্রামগুলোকে প্রটেকশন ওয়াল দিতে হবে সুইডেন মডেলে। গাছ লাগানো থাকবে বাগানের মতো, সোলার সিস্টেম থাকবে পুরো এলাকায়। লোকজন যেন আইটি সাপোর্ট ও ওয়াই–ফাই ব্যবহার করতে পারেন। স্যানিটেশন থাকবে পুরো পরিবারের মতো। খাবার পানি সবার জন্য সহজলভ্য করতে হবে। বর্ষার দিনে চলাচলে ওয়াকওয়ে তৈরি করা প্রয়োজন। সাইলো–গোডাউন তৈরি করা অতীব জরুরি। মাছের রিজার্ভের জন্য স্টোরেজ নির্মাণ করা যেতে পারে।

যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন: ৩৭৩ হাওরের ৩৭টি উপজেলা প্রপারকে কানেকটেড করে ১০০ কিলোমিটার উড়ালসড়ক নির্মাণ করলে লোকজনের চলাচল বাড়বে, অন্যদিকে পর্যটনের বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। অলওয়েদার রোড যেটা বানানো হয়েছে, তাতে পানির প্রবাহ কিংবা সেডিমেন্ট ও জলজ প্রাণীর চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। ধরে নেওয়া যায়, আগামী দিনে এখানকার চরিত্র বদলে যাবে। যেমনটা ঘটেছে চলন বিল এলাকায়। সেখানে ব্রিটিশ আমলে যে রেললাইন তৈরি করা হয়েছে, তাতে চলন বিলের গতিপ্রকৃতি বদলে গেছে। এতে পর্যাপ্ত ব্রিজ রাখা হয়নি। ফলে পানির প্রবাহ কমেছে, পলির প্রবাহ কমেছে, জলজ প্রাণী চলাচল কমেছে। ছোট আকারের হলেও সাবমার্সিবল রোড একই সমস্যা তৈরি করছে—এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

পরিবেশ উন্নয়ন: জলাভূমি এলাকায় কয়েক কোটি গাছ লাগালে পরিবেশের উন্নয়ন ঘটবে। প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বসবাসের উপযোগী হলে সেখানকার বাজেট ও উন্নয়ন—উভয়েরই উন্নয়ন ঘটবে। পর্যটনকে সহনশীল করতে পারলে মানুষের মনোজাগতিক উন্নয়ন ও অর্থ আয় বাড়বে। মাছ ও পাখির অভয়ারণ্য তৈরি করলে পরিবেশকে আরও উন্নত করা সম্ভব।

নৌ চ্যানেল তৈরি: হাওর এলাকার প্রতি জেলা উপজেলার সঙ্গে গ্রাম বন্দরের সঙ্গে নৌ চ্যানেল বানানো যেতে পারে। সাবমার্সিবল রোড বানানো ক্ষতিকর। তাই মালদ্বীপ বা ইউরোপের মতো নৌ চ্যানেল কম খরচে ব্যবহার উপযোগী হতে পারে। স্পিডবোট বা নৌকার রুট হাওর ছাড়াও কাপ্তাই লেকে রাঙামাটি থেকে ১০ উপজেলায় নৌ চ্যানেল তৈরি করা যেতে পারে। আড়িয়ল বিলেও এই সুযোগ আছে।

কর্মসংস্থান: নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ, হাঁস পালন প্রশিক্ষণ, শুঁটকি মাছ প্রস্তুতকরণ, পুরুষদের জন্য ইলেকট্রিশিয়ান, ড্রাইভিং, ভাষা শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। নার্সিং, ডে–কেয়ার সেন্টার পরিচালনাসহ নানাবিধ প্রশিক্ষণ প্রদান করে বিদেশের জন্য প্রস্তুত করা যেতে পারে। এ ছাড়া এলাকাভিত্তিক অন্যান্য প্রশিক্ষণ দিয়ে যুবকদেরকে বিদেশে প্রেরণ করা যেতে পারে।

দিনাজপুরের আশুরার বিল, নাটোরের চলন বিল, যশোরের ভবদহ বিল, টুঙ্গিপাড়ার বর্ণি বাঁওড়, মুন্সিগঞ্জের আরিয়ল বিল, পার্বত্য এলাকার কাপ্তাই লেক, বগা লেক, চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা, বিশেষ করে সীতাকুণ্ড ও মীরসরাই এলাকায় একই ধরনের প্রকল্প নেওয়া যায়। একইভাবে কক্সবাজার ও কুয়াকাটা বিচ ইত্যাদিতে পর্যটন সহায়ক প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। সুন্দরবন এলাকা ইতিমধ্যেই বিশ্ববাসীর মন কেড়েছে। এখানে পরিদর্শন সহায়ক ও ইকোসিস্টেম উন্নত করার জন্য বিশেষ প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। টাঙ্গুয়ার হাওর ও হাকালুকি হাওর প্রকৃতিকে করেছে অপরূপ। জলাভূমিগুলো কোনটা কোনটার চেয়ে সুন্দর আর সম্পদশালী, তা বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে থাকতে হয়।

মো. আখতারুজ্জামান, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর