যে মনঃকষ্ট নিয়ে ভোটযুদ্ধে নৌকা–লাঙল

কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর এমন ভাব করল যে তারা এমন একটি নির্বাচন দেশবাসীকে উপহার দেবে, যা কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তারা দুই বছর ধরে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করল। আগের নির্বাচন কমিশনে সিইসি কে এম নূরুল হুদা একাই কথা বলতেন এবং ইসি মাহবুব তালুকদার নোট অব ডিসেন্ট দিতেন। হাবিবুল আউয়াল কমিশনের সবাই কমবেশি কথা বলেন। কিন্তু এত কথা, এত বিবৃতি, এত আলোচনার ফলাফলটা কী হলো?

সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ নির্বাচন কমিশন সংবিধানের বাইরে যেতে পারে না বলে তাঁরা আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা চালালেন। তাই নির্বাচন কমিশন আগামী ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করল, তাতে দেশের রাজনৈতিক শক্তির একাংশ যোগ দিল, আরেক অংশ বর্জনের আহ্বান জানাল। এ রকম পরিস্থিতি অতীতে একবারই তৈরি হয়েছিল—২০১৪ সালে। এর আগে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে সব বিরোধী দল এককাট্টা হয়ে বর্জনের ডাক দেওয়ায় সেই নির্বাচন একদলীয় নির্বাচনে রূপ নেয় এবং বিএনপি সরকারকে দেড় মাসের মাথায় সংসদ ভেঙে দিতে হয়।

২০০৬-০৭ সালেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মহাজোট আন্দোলনের ডাক দিলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নির্দলীয় সরকার নির্বাচনটিই করতে পারল না। ২০১৪ সালের নির্বাচনে নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মাত্র ১২টি অংশ নেয়। সেই নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায়।

এ নির্বাচনে যদি কেউ খুশি হয়ে থাকেন, তাঁরা হলেন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে নেই, সেহেতু আগের নির্বাচনে প্রচণ্ডভাবে সমালোচিত এসব কর্মকর্তাকে নিরপেক্ষতার পরীক্ষা দিতে হবে না। বিএনপি ভোটে না আসায় তাঁরা নিজেদের শতভাগ নিরপেক্ষ বলে দাবি করতে পারবেন।

এর সঙ্গে এবারের দৃশ্যপট মিলিয়ে দেখা যাক। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৯টি। বর্জন করছে বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ ১৫টি দল। যারা বর্জন করেছে, স্বাভাবিকভাবেই তারা এই নির্বাচনে অখুশি হবে। তারা সেই অখুশির কথা দেশবাসীকে সশরীর জানাতে না পারলেও প্রায় প্রতি রাতে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো কি নির্বাচন নিয়ে খুশি আছে? দুই সপ্তাহে ধরে রাজনৈতিক মহলে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। কার সঙ্গে কার আসন ভাগাভাগি হবে? আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্যান্য দলের, যাদের মধ্যে আদর্শিক জোটের শরিক ১৪ দলের নেতারা আছেন, মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি আছে। আছে নতুন মিত্র তৃণমূল বিএনপি, বিএমএফ, বিএসপি ইত্যাদি দল। কিন্তু রোববার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আসন ভাগাভাগি কিংবা সমঝোতায় কেউ খুশি নয়। ১৪ দলের নেতারা প্রকাশ্যে তাঁদের অখুশির কথা জানিয়েছেন।

এক নেতা বলেছেন, প্রয়োজনে সমাদর, আর প্রয়োজন ফুরালে অবহেলা করা ঠিক নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ‘সঠিক’ ও ‘ন্যায়’ জিনিসটি অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ১৪ দলের শরিকরা পেয়েছিল ১২টি আসন। এবার মাত্র ৭টি আসন। এই অন্যায় মানতে ১৪ দলের কষ্ট হচ্ছে, যদিও জোট থেকে তাদের বেরিয়ে আসার উপায় নেই।

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে রাজনৈতিক সমীকরণটি আরও জটিল। রওশন এরশাদসহ জাতীয় পার্টির যেসব নেতা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধতে অতি উৎসাহী ছিলেন, তাঁরা নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে ছিটকে পড়েছেন। রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশের সঙ্গে আসন সমঝোতা না করতে অনুরোধ করেছেন। তাঁর দাবি, ষড়যন্ত্র করে তাঁদের নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যদিও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেছেন, তাঁরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রওশনের সম্মতির অপেক্ষায় ছিলেন। কার কথা ঠিক?

দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন যতই বিরোধিতা করুন না কেন, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির অবস্থা হলো দুজনে দুজনার। কেউ কাউকে ত্যাগ করতে পারবে না। জাতীয় পার্টি সঙ্গে না থাকলে আওয়ামী লীগ বিএনপিহীন নির্বাচনকে ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা দিতে পারবে না। আর আওয়ামী লীগের সহযোগিতা না পেলে জাতীয় পার্টি যত বেশি আসনেই মনোনয়নপত্র জমা দিক না কেন দলীয় প্রার্থীদের জিতিয়ে আনা অসম্ভব হবে। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির বন্ধনটি বলতে গেলে প্রায় চিরস্থায়ী রূপ নিয়েছে। ১

৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি ও জাসদের (রব) সহায়তায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ২০০৮ সাল থেকে দুই দল মহাজোটের শরিক হয়ে নির্বাচন করে। কখনো জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দল হয়, কখনো একই সঙ্গে বিরোধী দল ও মন্ত্রিসভার শরিক হয়। এটা সম্ভবত সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশেই সম্ভব।

আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টির মধ্যে যে-সংখ্যক আসনে সমঝোতা হোক না কেন, পথের কাঁটা স্বতন্ত্র প্রার্থী থেকেই যাবে। এ কারণে জাতীয় পার্টি খুশি হতে পারছে না। উদ্বেগে আছে ১৪ দলের শরিক ও কথিত কিংস পার্টির নেতারাও। এমনকি আওয়ামী লীগের যেসব প্রার্থীর হাতে নৌকা থেকে যাবে, তাঁরাও অখুশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারণে। একটি পত্রিকা লিখেছে, ডজনেরও বেশি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ঝুঁকিতে আছেন। বর্তমান সংসদের ৭১ জন সংসদ সদস্য এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। তাঁদেরও বেশির ভাগ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়ছেন।

ফলে এ নির্বাচনে কে খুশি, সেটা বলা মুশকিল। নৌকা প্রতীকধারী আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা অখুশি স্বতন্ত্র প্রার্থীর কারণে। জাতীয় পার্টির নেতারা অখুশি আরও বেশি আসনে সমঝোতা না হওয়ায় এবং স্বতন্ত্রের ঝুঁকি থেকে যাওয়ায়। আর কিংস পার্টির অবস্থা হলো না ঘরকা, না ঘাটকা। জাকের পার্টি ও বাংলাদেশ কংগ্রেস ইতিমধ্যে নির্বাচন থেকে তাদের প্রার্থিতা সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ কংগ্রেস সব প্রার্থীর প্রত্যাহারের কথা বললেও জাকের পার্টি প্রতীকী প্রার্থী রেখে দিচ্ছে। এত দিন আমরা প্রতীকী অনশন বা প্রতীকী ধর্মঘটের কথা শুনে এসেছি। এবার প্রতীকী প্রার্থিতার কথাও শুনলাম।

তবে এ নির্বাচনে যদি কেউ খুশি হয়ে থাকেন, তাঁরা হলেন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে নেই, সেহেতু আগের নির্বাচনে প্রচণ্ডভাবে সমালোচিত এসব কর্মকর্তাকে নিরপেক্ষতার পরীক্ষা দিতে হবে না। বিএনপি ভোটে না আসায় তাঁরা নিজেদের শতভাগ নিরপেক্ষ বলে দাবি করতে পারবেন।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]