নয়াপল্টন ইস্যু: জনগণ বলছে, ‘আর তো পারি না!’

যাক বাবা বাঁচা গেছে! পাবলিকের মাথায় এখন আর টাকাপয়সার টেনশন নাই। চালের কেজি কয় টাকা; বাজারে তেল আছে কি না, আগামী মাসে ঘর ভাড়ার টাকা জোগাড় হবে কি না; বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে কি না; যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে এই মসিবতকাল পার করা যাবে কি না—ইত্যাকার প্রাতঃস্মরণীয় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক আলাপ এখন বন্ধ। অর্থনৈতিক আলাপে দুশ্চিন্তা বাড়ে। মাথাব্যথা করে।

প্রায় দুই মাস ধরে পাবলিকের মাথায় এই ব্যথা প্রবলভাবে ছিল। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাংকের টাকা পাচার, ডলারের ঘাটতি ইত্যাদি যখন সবার মাথায় অসহ্য ব্যথা তৈরি করেছিল, তখনই অর্থঘটিত ব্যথা ভোলাতে নতুন ব্যথার উদয় হয়েছে।

তার নাম রাজনীতিঘটিত ব্যথা। এটি অনেকটা ‘বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা’ টাইপের ব্যথা। বিএনপি পল্টনে সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই এই ব্যথার শুরু। ‘বিষে বিষক্ষয়’ কায়দায় পাবলিক এখন রাজনৈতিক ব্যথার চোটে অর্থনৈতিক ব্যথা ভুলে গেছে।

আধুনিক পশু হাসপাতাল যখন গ্রামের মানুষের নাগালের বাইরে ছিল, তখন গ্রামগঞ্জে এঁড়ে গরুকে বলদ বানানোর জন্য ধারালো ছুরি দিয়ে খোজা করা হতো। গ্রাম্য হাজামরা সাধারণত এই কাজটি করতেন।

তাঁদের কাছে লোকাল অ্যানেসথেসিয়া বা ব্যথানাশক তেমন কিছু ছিল না। এঁড়েকে মাটিতে শুইয়ে চার–পাঁচজন লোক চেপে ধরে রাখত। হাজাম ছুরি চালানোর সময় এঁড়ের চোখে মরিচের গুঁড়া ডলে দেওয়া হতো। এতে এঁড়েটার মন থাকবে চোখের ব্যথার দিকে, অস্ত্রোপচারের ব্যথা সে টের পাবে কম—এই অদ্ভুত ধারণা থেকে কাজটা করা হতো। সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম দেখে মনে হচ্ছে, জনগণ সেই দশায় আছে।

তেলের দাম এক ঠেলায় প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানোর পর শাঁই শাঁই করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে গেল। চাল কিনতে গেলে ডাল কেনার টাকা থাকছে না দেখে মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। এরপর এল লোডশেডিং। মানুষ ঘামতে শুরু করল। এরপর খবর বেরোল রিজার্ভে টান পড়েছে; এলসি খোলা যাচ্ছে না। লোকের মাথাব্যথা আরও বাড়ল।

তারপর খবর এল শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকে নয়ছয় করে এস আলম গ্রুপ একাই ৩০ হাজার কোটি টাকা লোন নিয়েছে। একদিকে একের পর এক জনগণের টাকা লুটপাটের খবর, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামের খবর—এই দুই আর্থিক চিন্তা তাদের মাথায় রাগ, ক্ষোভের আগুন ধরিয়ে দিল। তাদের মাথাব্যথায় টনটন করতে লাগল।

শেষমেশ সব দুর্ভোগ জোটে সেই পাবলিকের কপালে। পল্টনে বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেওয়ার অনুমতি না দেওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে পুলিশ বলেছে, সেখানে বিএনপি সমাবেশ করলে মানুষের চলাচলে কষ্ট হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, পুলিশ সেই এলাকা ঘিরে রেখেছে। সেখানে জনগণের চলাচলে যাতে কষ্ট না হয়, সম্ভবত সেই কারণে গোটা এলাকা ঘিরে রাখা হয়েছে এবং সেখানে কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।

ঠিক এই রকম সময় মরিচের গুঁড়ার মতো পাবলিকের চোখে পড়ল ‘পল্টন ইস্যু’। বিএনপি বলল, ‘পল্টনে সমাবেশ করব।’ আওয়ামী লীগ, ‘কাভি নেহি’। অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে বিএনপি বিরাট বিরাট সমাবেশ করার পর আওয়ামী লীগও পাল্টা সমাবেশ করল। পাল্টাপাল্টি স্লোগানের জলোচ্ছ্বাসে পাবলিকের অভাবজনিত চিন্তার আগুন ফ্যাৎ করে নিভে গেল। ‘১০ তারিখের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে’—বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের দিক থেকে এই ধরনের রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরপূর্ণ ঘোষণা আসার পর দলের কর্মীরা উজ্জীবিত হলেন। তাঁরা স্লোগানে স্লোগানে বিভাগীয় সমাবেশের জায়গাগুলো প্রকম্পিত করলেন।

আওয়ামী লীগও পাল্টা সমাবেশ ও মিছিল বের করে নিজেদের সরব উপস্থিতি ঘোষণা করল। দুই পক্ষ মারমুখী কথাবার্তা শুরু করল। বিএনপি বলল, সমাবেশ ১০ তারিখে পল্টনেই হবে। ডিএমপি বলল, সেখানে সমাবেশের অনুমতি তারা দেবে না। সব মিলিয়ে চারদিকে কেমন একটা ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ ভাব আসছিল।

এই অবস্থায় দুদিন আগে পল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে যা ঘটে গেল, তারপর অন্তত আগামী কয়েক দিন সাধারণ মানুষের চালের দাম, ডালের দামসংক্রান্ত মাথাব্যথা থাকার কথা না। সেখানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। তাতে একজন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন বহু লোক। এসব ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার চারপাশে পুলিশের তল্লাশিচৌকি বসানো হয়েছে। সব মিলিয়ে রাজনীতির উত্তাপে সারা দেশ গরম হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

এখন মানুষের আর্থিক টানাপোড়েনের কষ্টের আলাপ উধাও হয়ে গেছে। তঁারা এখন চায়ের দোকানে বসে আগের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে কেনা চায়ে চুমুক দিতে দিতে ১০ ডিসেম্বর নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনায় ডুবে যাচ্ছেন। তঁারা একটি উদ্বেগ থেকে বাঁচতে আরেকটি বড় উদ্বেগকে বরণ করে নিচ্ছেন।

সম্ভবত আর্থিক ব্যথার চেয়ে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক ব্যথাকে তুলনামূলকভাবে কম যন্ত্রণাদায়ক মনে করে। মানুষ ব্যক্তিগত আর্থিক অনটনের যন্ত্রণার কথা অন্যের কাছে স্বচ্ছন্দে বলতে পারে না বা বলতে চায় না। ব্যক্তির সেই স্বভাবধর্ম গোষ্ঠীর সামগ্রিক চিন্তাচেতনায়ও প্রভাব ফেলে। এ কারণে দেশের আর্থিক সংকট জনগণের আলোচনায় ততটা প্রাধান্য পায় না, যতটা পায় রাজনৈতিক সংকট।

আগামীকাল ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ কোথায় কীভাবে হবে বা আদৌ হবে কি না, তা এই লেখা যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত ঠিক হয়নি। এই নিয়ে মানুষের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা আছে। সেই উত্তেজনা তার ব্যক্তিগত অভাবের কথাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। অতি সুখের কথা, সবাই সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ থেকে বাঁচাতে চান। তাদের দুঃখ ভোলাতে চান।

কিন্তু শেষমেশ সব দুর্ভোগ জোটে সেই পাবলিকের কপালে। পল্টনে বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেওয়ার অনুমতি না দেওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে পুলিশ বলেছে, সেখানে বিএনপি সমাবেশ করলে মানুষের চলাচলে কষ্ট হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, পুলিশ সেই এলাকা ঘিরে রেখেছে। সেখানে জনগণের চলাচলে যাতে কষ্ট না হয়, সম্ভবত সেই কারণে গোটা এলাকা ঘিরে রাখা হয়েছে এবং সেখানে কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।

বিএনপি বলছে, তারা জনগণের জন্য রাজপথে নেমেছে। সরকার বলছে, তারা জনগণের স্বার্থেই কোনো ‘বিশৃঙ্খলাকারীকে’ রাজপথ দখল করতে দেবে না। মাঝখান থেকে জনগণ বলছে, ‘আর তো পারি না!’

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

[email protected]