একটি অখ্যাত কবর ও ইরাকের আশ্চর্য অতীতের গল্প

বাগদাদের একটি সেতু পার হচ্ছেন ইরাকের অধিবাসীরা। ১৯৩২ সালের ইরাক।ছবি : এএফপি

বাগদাদের বাব আল শারকি এলাকার পুরোনো অ্যাংলিকান কবরস্থানে এক শতাব্দীর বেশি সময় আগে সমাহিত বিদেশিদের দেহ শুয়ে আছে। রোদে পুড়ে যাওয়া পাথরের ফাঁকে ফাঁকে শুকনা ঝোপঝাড় গজিয়েছে। অনেক সমাধিফলকের লেখাই এখন ক্ষয়ে যাওয়ায় তা পড়া কঠিন হয়ে উঠেছে।

এখানে আসা বেশির ভাগ মানুষ খুঁজে ফেরেন গার্ট্রুড বেলের কবর। তিনি ‘কুইন অব দ্য ডেজার্ট’ নামে পরিচিত। হলিউডে তিনি অমর হয়ে আছেন। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর আধুনিক ইরাক গঠনে তাঁর ভূমিকার জন্য তাঁকে কেউ প্রশংসা করেন, কেউ আবার সমালোচনা করেন।

কিন্তু বেলের কবর থেকে একটু দূরেই রয়েছে আরেকটি পুরোনো সমাধিফলক, যা কৌতূহলী চোখ আকর্ষণ করবেই। সেটি ব্রিটিশ নৌবাহিনীর রিজার্ভ কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার চার্লস হেনরি কাউলির কবর। ১৮৭২ সালে বাগদাদে জন্ম নেওয়া কাউলি ১৯১৬ সালে কুটের কাছে এক যুদ্ধে নিহত হন। ওই যুদ্ধে তাঁকে ভিক্টোরিয়া ক্রস প্রদান করা হয়েছিল।

গার্ট্রুড বেলের মতো পরিচিত নাম না হলেও কাউলির জীবনের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, একসময় ইরাক কীভাবে নদীনির্ভর বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কের কেন্দ্র ছিল। এই নেটওয়ার্ক শুধু বাণিজ্য নয়; বরং গোটা অঞ্চলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই ইতিহাস নতুন করে গুরুত্ব পায় গত সেপ্টেম্বরের একটি বিতর্কিত এবং তথ্যগতভাবে ভুল মন্তব্যের পটভূমিতে।

মন্তব্যটি করেছিলেন মার্কিন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক কর্মী থেকে তুরস্কে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হওয়া টম ব্যারাক। ব্যারাক বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্য বলে কিছু নেই। এখানে আছে শুধু গোত্র আর গ্রাম। তার যুক্তি ছিল, আধুনিক রাষ্ট্রগুলো আসলে ঔপনিবেশিক শক্তির তৈরি করা কৃত্রিম কাঠামো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের বন্দোবস্ত নিয়ে কেউ কেউ বলেন, সাইকস পিকো চুক্তি কৃত্রিম রাষ্ট্র গঠন চাপিয়ে দিয়েছিল, যা পরে অস্থিরতার জন্ম দেয়। কিন্তু সেই সমাজগুলোকে আদিম বা অসভ্য বলা সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং ভুল একটি দাবি। এই দৃষ্টিভঙ্গি যে বিষয়টি উপেক্ষা করে, তা হলো সাইকস পিকো চুক্তির সীমান্তগুলো ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে আঁকা হলেও সেগুলো মরুভূমি থেকে নতুন কোনো সভ্যতা তৈরি করেনি।

ইউরোপীয় মানচিত্রবিদেরা আসার বহু আগেই ইরাকের দীর্ঘ ইতিহাস গড়ে উঠেছিল। সেই ইতিহাস ছিল বহুভাষিক, বাণিজ্যনির্ভর, শিক্ষিত ও ভবিষ্যৎ–মুখী। এই ইতিহাসই এমন সব সংশোধনবাদী ব্যাখ্যার সরাসরি প্রতিবাদ করে। টম ব্যারাকের এ ধরনের ধারণা পশ্চিমে বহু আগেই এডওয়ার্ড সাঈদ ও ওরিয়েন্টালিজম (প্রাচ্যবাদ) বিষয়ে পুরো একাডেমিক ধারার মাধ্যমে খণ্ডিত হয়েছে।

লরেন্স অব অ্যারাবিয়া বা গার্ট্রুড বেলের মতো পরিচিত নাম না হলেও কাউলির জীবন গভীরভাবে দেখলে এমন এক সময়ের জানালা খুলে যায়, যখন দাজলা ও ফোরাত নদী ছিল মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান যোগাযোগপথ। এই নদীগুলোর নিয়ন্ত্রণ মানে ছিল বাজার, কূটনীতি ও ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ।

কাউলির কবর এবং তাঁর প্রতিনিধিত্ব করা হারিয়ে যাওয়া সেই জগৎ আজ আবার একটি সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে। ইরাকের ঐক্য ও বৃহত্তর অঞ্চলের সংহতি সব সময়ই স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেছে। তা তেল, যুদ্ধ বা সাম্রাজ্যের কারণে নয়; বরং মানুষ, ভাবনা ও অর্থনীতিকে যুক্ত করার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ইরাকের নদীগুলোর গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মধ্যপ্রাচ্যের অভিযোজনের ক্ষমতাই বরাবর তার সবচেয়ে বড় শক্তি ও পরিচয়।

ইউফ্রেটিস অ্যান্ড টাইগ্রিস স্টিমশিপ নেভিগেশন কোম্পানির একজন জ্যেষ্ঠ ক্যাপ্টেনের ছেলে এবং আর্মেনীয় পারস্য বংশোদ্ভূত এক নারীর সন্তান হিসেবে কাউলি টাইগ্রিস নদীর তীরে বড় হন। স্টিমশিপের ক্যাপ্টেন, নদীর নাবিক, ব্যবসায়ী ও দোভাষীদের মধ্যে বেড়ে উঠে তিনি খুব ভালোভাবে বুঝেছিলেন যে এই নদীগুলোই ইরাকের অর্থনীতির প্রাণ।

আরবি ভাষা ও আরও কয়েকটি ভাষায় দক্ষ কাউলি সহজেই এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে বিচরণ করতেন। তিনি সীমান্তের চেয়ে বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক প্রাচীন মেসোপটেমিয়া বহুসাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি ছিলেন।

ইরাকের সাংস্কৃতিক জীবনও ইউরোপীয় আলোর অপেক্ষায় ছিল না। রাজা ফয়সাল প্রথম পশ্চিমা ধাঁচের যে টুপি পরতেন এবং যাকে তিনি অগ্রগতির প্রতীক বলে ঘোষণা করেছিলেন, সেই আল সিদারা আসার এক হাজার বছর আগেই আল মুতানাব্বি শাসকদের উত্থান-পতন ও ক্ষমতার প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে মুল্লা আব্বুদ আল কারখি এমন কিছু তীক্ষ্ণ কবিতা লেখেন, যেখানে অটোমান শাসনের ভাঙন ও ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মাঝখানে আটকে পড়া একটি সমাজের উদ্বেগ ফুটে ওঠে। তাঁর কবিতায় পরিচয়, সার্বভৌমত্ব ও আধুনিকতা নিয়ে প্রাথমিক চিন্তার প্রকাশ দেখা যায়।

বাস্তবতা হলো, ইরাকিরা ইতিহাসের নীরব ভুক্তভোগী ছিলেন না। তাঁরা নিজেদের সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সক্রিয়ভাবে বুঝেছেন এবং ব্যাখ্যা করেছেন।

আজ অবশ্য একসময়কার সেই শক্তিশালী নদীগুলো আর আগের মতো প্রবাহিত হয় না। অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিনের ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, উজানের পানি সরিয়ে নেওয়া এবং খরার কারণে নদীগুলোর প্রাণশক্তি কমে গেছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য এখন এসব নদীর গুরুত্বও খুব সামান্য। কারণ, বাণিজ্য অনেক আগেই স্থলপথে সরে গেছে।

তবে যে বিষয়টি একেবারেই কমে যায়নি, তা হলো ইরাকের দীর্ঘ ঐতিহাসিক ঐতিহ্য। কিউনিফর্ম লিপি, গণিত ও আইনের সূচনাকাল থেকে শুরু করে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস প্রমাণ করে যে ইউরোপীয় হস্তক্ষেপের আগেও মধ্যপ্রাচ্যে সুসংগঠিত সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক পরিচয় বিদ্যমান ছিল।

কাউলির কবর এবং তাঁর প্রতিনিধিত্ব করা হারিয়ে যাওয়া সেই জগৎ আজ আবার একটি সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে। ইরাকের ঐক্য ও বৃহত্তর অঞ্চলের সংহতি সব সময়ই স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেছে। তা তেল, যুদ্ধ বা সাম্রাজ্যের কারণে নয়; বরং মানুষ, ভাবনা ও অর্থনীতিকে যুক্ত করার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ইরাকের নদীগুলোর গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মধ্যপ্রাচ্যের অভিযোজনের ক্ষমতাই বরাবর তার সবচেয়ে বড় শক্তি ও পরিচয়।

• তানিয়া গুডসুজিয়ান কানাডীয় সাংবাদিক ও আল–জাজিরা ইংলিশ অনলাইনের সাবেক মতামত সম্পাদক
• ইব্রাহিম আল মারাশি ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি সান মারকোসে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত