ভারত কীভাবে চীনা ‘ড্রাগন’ ও মার্কিন ‘ইগল’কে  সামলাবে

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদিছবি : রয়টার্স

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক তিয়ানজিন সফর ছিল সাত বছর পর তাঁর প্রথম চীন সফর/। তিনি সেখানে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনে অংশ নেন। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মোদির উপস্থিতি একধরনের বহুরৈখিক সংহতির ছবি তুলে ধরে। এই ছবি দেখে মনে হতে পারে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনকে অস্বস্তিতে ফেলতে পরিকল্পিতভাবে সব সাজানো হয়েছিল।

কিন্তু এই রাজনৈতিক প্রদর্শনীর আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও জটিল বাস্তবতা। আর সেই বাস্তবতাকে ভারতের অত্যন্ত সতর্কতা ও সুস্পষ্ট কৌশলের সঙ্গে মোকাবিলা করা জরুরি।

আসলে মোদির এই সফর ছিল একধরনের কূটনৈতিক পুনর্মিলনের ইঙ্গিতবাহী বার্তা। প্রায় এক ঘণ্টার সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈঠকে মোদি ও সি দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান যোগাযোগ পুনরায় চালু করতে এবং হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী দেবতা শিবের তীর্থস্থান কৈলাস–মানস সরোবরে যাত্রা আবারও চালু করতে একমত হন।

দুই নেতা হাত মেলালেন। ছবি তুললেন। মনে হলো, ভারত-চীন সম্পর্ক নতুন এক শান্তিপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করছে।

তবে আশাবাদী হওয়ার মতো কারণ খুব বেশি নেই। ১৯৫০-এর দশক থেকেই ভারত বারবার চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই শেষ হয়েছে হতাশা কিংবা প্রতারণায়।

১৯৬২ সালের যুদ্ধ (যখন চীনা বাহিনী হিমালয় সীমান্তে একযোগে আক্রমণ চালায়) দুই দেশের প্রাথমিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দেয়।

পরে ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উদ্যোগে সম্পর্ক কিছুটা স্থিতিশীল হয়। কিন্তু গত এক দশকে ভারত-চীন সম্পর্ক আবারও উত্তেজনায় ভরে উঠেছে। ২০১৩ সালের দেপসাং, ২০১৪ সালের চুমার, ২০১৭ সালের দোকলাম এবং ২০২০ সালের গালওয়ানের সংঘর্ষ—সবই দেখিয়েছে, সীমান্তে শান্তি এখনো অধরাই। এসব সংঘর্ষে দুই দেশের সেনারা নিহতও হয়েছেন।

আজও হিমালয়ের বরাবর যে সীমান্তরেখা ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ (এলএসি) নামে পরিচিত, তা নিয়ে বিরোধ রয়ে গেছে। চীন সীমান্ত অঞ্চলে দ্রুতগতিতে অবকাঠামো নির্মাণ চালিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে চীনের পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক—বিশেষ করে ‘চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর’ প্রকল্প, সামরিক সহায়তা ও কূটনৈতিক সমর্থন—ভারতের কৌশলগত দুর্বলতাকে আরও প্রকট করে তুলছে।
সবচেয়ে যত্নসহকারে সাজানো সৌহার্দ্যের পরিবেশও যে বাস্তবতাকে আড়াল করতে পারবে না, তা হলো ভারত-চীন সম্পর্কের জটিল সমস্যাগুলো এখনো গভীর ও কঠিন। এই সমস্যাগুলোর সমাধান সহজ নয়।

চীনের সঙ্গে উত্তেজনা এড়ানোর মানে যেন মিথ্যা বন্ধুত্বের ভ্রমে জড়িয়ে পড়া না হয়। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আলোচনা করার অর্থ যেন না হয় এমন কোনো বিরোধ সৃষ্টি করা, যা পারস্পরিক সহযোগিতার কাঠামোগত ক্ষেত্রগুলোয় বিঘ্ন ঘটায়।

ভারত-চীন সম্পর্কের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য। চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যঘাটতি বর্তমানে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়, চীনা পণ্যের ওপর ভারত ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম ও ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান থেকে শুরু করে বিরল খনিজ পদার্থ—সবক্ষেত্রেই ভারত চীনের ওপর আমদানিনির্ভর।

অন্যদিকে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি ও সেবা প্রদানকারীরা চীনা বাজারে প্রবেশ করতে হিমশিম খাচ্ছে; অথচ চীনা কোম্পানিগুলো ভারতের সরবরাহব্যবস্থায় আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনার জন্য ভারত বারবার চীনের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছে, তা এখন পর্যন্ত খুব একটা ফল দেয়নি।

কোনো সম্মেলনই ভারত-চীন সম্পর্কের কাঠামোগত সমস্যাগুলো ঢেকে রাখতে পারে না। এসসিও সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যখন বললেন ‘ড্রাগন ও হাতি একসঙ্গে হাঁটুক’, তখন মোদি সীমান্তে শান্তি ও ন্যায্য বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর আবারও জোর দিলেন। পাশাপাশি তিনি ভারতের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিরোধিতা দৃঢ়ভাবে পুনর্ব্যক্ত করলেন।

এ প্রকল্পের সবচেয়ে বড় অংশ হলো এমন একটি মহাসড়ক, যা পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে গেছে, আর সেই ভূখণ্ড ভারত নিজস্ব বলে দাবি করে। একই সঙ্গে মোদি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও ভারতের অটল অবস্থানের কথা তুলে ধরেন।

দ্বিপক্ষীয় এসব মতবিরোধ ছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কেও দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। চীন এখন বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। এসসিও সম্মেলনে সি চিন পিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অর্থনীতি ও অবকাঠামো খাতে এমন কিছু উদ্যোগের কথা বলেন, যা পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরতা কমাবে। বর্তমানে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া রাশিয়ার জন্য এটি একধরনের ভূরাজনৈতিক লাইফলাইন। কিন্তু ভারতের দৃষ্টিতে এসসিও কেবল আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি মঞ্চ, যেখানে ভারত তার কৌশলগত স্বাধীনতা প্রদর্শন করে।

নরেন্দ্র মোদি ও সি চিন পিং
ছবি : এএফপি

ভারত মোটেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক পরিত্যাগ করতে চায় না।
ভারতের কূটনৈতিক মহল মাঝেমধ্যে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের সম্ভাবনাকে অতিমূল্যায়ন করেছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের স্থায়িত্বকে বারবার অবমূল্যায়ন করেছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র চীনের মতো নয়। অর্থাৎ তারা ভারতের ভূখণ্ড দখল করে রাখে না, পাকিস্তানকে যুদ্ধের সময় গোয়েন্দা বা সামরিক সহায়তা দেয় না, কিংবা এশিয়ার সীমান্ত পুনর্নির্ধারণের চেষ্টা করে না। বরং গত দুই দশকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে এক কৌশলগত অংশীদারি গড়ে তুলেছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগ এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা।

যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সঙ্গে কোয়াডে ভারত অংশ নিয়ে দেখিয়েছে, তারা যৌথভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে (যেখানে চীন প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে) এক স্থিতিশীল শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

কোয়াড জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও (যেমন এর পরবর্তী সম্মেলন ভারতে হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়) এই জোটের কৌশলগত গুরুত্ব অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

তবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিক্ষা খাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের এক প্রধান অংশীদার। সেমিকন্ডাক্টর থেকে শুরু করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের জন্য বিনিয়োগের অন্যতম উৎস। যুক্তরাষ্ট্রই ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য। সেখানে ভারত বছরে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত অর্জন করে।

তবে এই সম্পর্ক সম্পূর্ণ নিখুঁত নয়। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা ভারতকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে একই শ্রেণিতে ফেলেছে। তারা ভারতকে ‘ব্যাড অ্যাক্টর’ বা ‘বিশ্ববাণিজ্যের খারাপ খেলোয়াড়’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তা ছাড়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। তবু এই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যবিরোধ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য এবং বর্তমানে এমন আলোচনাই চলছে।

তবে শেষ পর্যন্ত ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতার যুক্তি লেনদেনভিত্তিক নয়, বরং কাঠামোগত। সাম্প্রতিক শীতলতার পরও উভয় দেশ বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা সুরক্ষিত রাখা এবং চীনের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা রোধে অভিন্ন স্বার্থে একত্র রয়েছে।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী মোদির সাম্প্রতিক চীন সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আরও অবনতি ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় ছিল বটে, কিন্তু প্রকৃত উষ্ণতা ফিরিয়ে আনা এখনো দুরূহ।

রাজনৈতিক সদিচ্ছা যতই থাকুক না কেন, ভৌগোলিক অবস্থান, আদর্শগত পার্থক্য ও শক্তির অসামঞ্জস্য—এসব বিষয় কূটনীতির জোরে সহজে মুছে ফেলা যায় না।
এই সম্পর্কগুলো পরিচালনার সময় ভারতের নেতাদের মনে রাখতে হবে, ‘কৌশলগত স্বাধীনতা’ মানে এক মেরু থেকে আরেক মেরুতে দোল খাওয়া নয়, বরং এমন এক অবস্থান তৈরি করা, যেখানে ভারত কোনো পরাশক্তির ছায়াতলে না গিয়ে নিজের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।

চীনের সঙ্গে উত্তেজনা এড়ানোর মানে যেন মিথ্যা বন্ধুত্বের ভ্রমে জড়িয়ে পড়া না হয়। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আলোচনা করার অর্থ যেন না হয় এমন কোনো বিরোধ সৃষ্টি করা, যা পারস্পরিক সহযোগিতার কাঠামোগত ক্ষেত্রগুলোয় বিঘ্ন ঘটায়।

সম্মেলনের চাকচিক্য নয়, বরং কৌশলগত স্বার্থের বাস্তবতাকে ভিত্তি ধরে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত। চীন নামক ‘ড্রাগন’ হাত মেলাতে পারে, কিন্তু তার নখ এখনো দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইগল’ হয়তো আজ কিছুটা অস্থির, কিন্তু তার পাখা এখনো ওড়ার শক্তি দেয়। উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় শুধু ভারসাম্য নয়, প্রয়োজন দূরদর্শিতার।

  • স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
    শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমানে দেশটির লোকসভার কংগ্রেসদলীয় এমপি।