নায়ক আসছেন। নায়ক এলেন। নায়ক সবার মন জয় করলেন। এরপর নায়ক হলেন ভিলেন। তারপর তিনি বিদায় নিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে এটাই বলা যায় বাংলাদেশের গল্প।
আমরা আমাদের অতীত সম্পর্কে মতামত দিতে পারি। কিন্তু আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাই।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন নায়ক। তিনি বিশ্বের নায়ক। আমার মতো অনেকেই ছোটবেলা থেকে তাঁকে অনুসরণ করে আসছেন। এখন তাঁকে তাঁরা আরও অনুসরণ করবেন।
কারণ, তাঁর কাজ সমগ্র দেশের ভালোমন্দের ওপর প্রভাব ফেলবে। এমনকি সেসব কাজ আমাদের খাবারের খরচের ওপর পর্যন্ত প্রভাব ফেলবে।
সেই নিরিখে মনে করি, অন্তত সাতটি ক্ষেত্রে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল হতেই হবে।
জনগণের আস্থা অর্জন:
আমরা আমাদের নৈতিক ভিত্তি হারিয়েছি এবং আমরা অনেক মিথ্যা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কথা শুনেছি। ব্রিটিশরা আমাদের বিভক্ত করে শাসন করেছে।
আমরা এখনো ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, আর্থিক এবং আরও অনেক দিক থেকে বিভক্ত।
আমাদের দেশের সংস্কারের জন্য নতুন সরকারকে সাধারণ মানুষের স্বার্থের ওপর আস্থা আনতে হবে। বাংলাদেশ গড়তে হবে কোনো ব্যক্তিকে সমর্থন না করে।
আমরা একজন নেতাকে অনুসরণের বা একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত হওয়ার জাতি নই। এ বিষয়টি নতুন সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে এবং এ ধারণাকে কাজের মধ্য দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
সরকারকে জনগণকে বিশ্বাস করাতে হবে যে এটি জনগণের জন্য সরকার, ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের কিছু নয়।
এটি খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয় এবং এর জন্য একটি সরকারের ন্যূনতম দুই থেকে পাঁচ বছর সময় প্রয়োজন।
শিক্ষার সংস্কার:
আমাদের ১৭ কোটি জনসংখ্যার ১০ শতাংশও যদি মেধাবী হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশ পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে সুইজারল্যান্ডের কাছাকাছি যেতে পারে।
সবাইকে উচ্চশিক্ষিত হতে হবে, তা নয়। এ বিষয়ে আমরা চীনকে অনুসরণ করতে পারি এবং প্রতিটি বাড়িকে একটি ‘কারখানা’ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।
তা করতে হলে আমাদের এমন শিক্ষার প্রয়োজন, যা এই রূপান্তর ঘটাতে পারে।
সৃজনশীল ব্যতিক্রমী ছাত্ররা এ দেশে জন্মগ্রহণ করে, তাদের বিশ্বাস করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে যে তারা এটি করতে পারবে। এর জন্য একটি রূপান্তরমূলক শিক্ষাব্যবস্থা দরকার হবে।
আইন, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সংস্কার:
আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের সঙ্গে আমাদের বিচারব্যবস্থাও ব্যর্থ হয়েছে। আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সমাজে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আমাদের কাঠামোগত সংস্কার দরকার আইনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার জন্য।
আমাদের আইনি ব্যবস্থাকে শ্রেণিবদ্ধ করতে হবে। আমাদের একটি আইন ম্যানুয়াল তৈরি করতে হবে, যা বলবে—আপনি যদি এটি করেন তাহলে তার জন্য এই পরিণতি ভোগ করতে হবে।
এ ছাড়া একটি সময়সীমার মধ্যে ন্যায়বিচার করা দরকার, যাতে লোকেরা বিশ্বাস করে যে একটি ভুল বা অপরাধমূলক কাজের পরিণতি কী হতে পারে।
চিকিৎসা খাতের চিকিৎসা দরকার:
এ বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বড় উদাহরণ, যা গড়ে তুলেছেন প্রয়াত জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
চিকিৎসায় সংস্কার করতে গেলে কাউকে তাঁর মতো দৃষ্টিভঙ্গি বদল করে নতুনত্বের অনুসরণ করতে হবে এবং সুশৃঙ্খলভাবে কাজটি করতে হবে।
আমাদের চিকিৎসক আছে, আমাদের লোক আছে, আমাদের রোগ আছে। এখন শুধু এমন একটি সরকার দরকার, যারা পুরো বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে সমন্বয় করতে পারবে।
এনবিআর ও আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কার:
জটিল ট্যাক্স, ভ্যাট ও শুল্ক আইনের কারণে আইনি ব্যবস্থা অনুসরণ করে বাংলাদেশে সৎভাবে ব্যবসা করে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।
আমাদের ট্যাক্স, ভ্যাট ও শুল্ক আইন একেকজন কর্মকর্তার একেক রকম উপলব্ধির একেক রকম প্রয়োগের ওপর ভিত্তি করে চলে আসছে।
করদাতা ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরা এই কর্মকর্তাদের একেক ধরনের ‘উপলব্ধি’র কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। ফলে তাঁদের বেশির ভাগকেই কর্মকর্তাদের উপলব্ধিকে নিজের ‘অনুকূলে’ আনতে গিয়ে পয়সা গুনতে হয়।
এই নতুন প্রজন্মের মানুষ কর দিতে পছন্দ করলেও জটিল পদ্ধতির কারণে তাঁরা কর দিতে ব্যর্থ হন এবং ব্যবসা বিকাশে অসুবিধার সম্মুখীন হন।
সব করের জন্য একটি সহজ ম্যানুয়াল বাধ্যতামূলক, যা আন্তর্জাতিক মানের সমতুল্য। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার জন্য একটি বিশেষ সুবিধাজনক নীতির প্রয়োজন, যা এই মুহূর্তে অনুপস্থিত।
এ দেশের মানুষ স্মার্ট এবং তারা জানে কীভাবে তাদের রাস্তা খুঁজে বের করতে হয়। সরকারকে তাদের কেবল কাঠামোগত সহায়তা দিতে হবে। বাকিটা জনগণই করতে পারবে।
বাংলাদেশে ব্যবসা বিকাশের জন্য এনবিআরের অব্যবস্থাপনা ও ঘুষখোর কর্মকর্তারা যে একটি বিরাট অন্তরায় ও হুমকি, সে কথা সরকারকে উপলব্ধিতে আনতে হবে।
অর্থ হলো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রক্ত এবং সঠিক আর্থিক ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা ব্যবসার জন্য বিশুদ্ধ রক্ত পেতে পারি, যা আমাদের অর্থনীতির বিকাশ করতে পারে।
আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, আমাদের পর্যাপ্ত জমি নেই। আমি এটি বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জমি আছে। একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করি। বাংলাদেশের একটি টমেটোগাছ সর্বোচ্চ তিন কেজি টমেটো উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের একটি টমেটোগাছ ৫০ কেজির বেশি টমেটো উৎপাদন করতে পারে। অবিশ্বাস্য, তাই না? কিন্তু এটাই সত্য।
কৃষি ও লজিস্টিক সংস্কার:
আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, আমাদের পর্যাপ্ত জমি নেই। আমি এটি বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জমি আছে। একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করি।
বাংলাদেশের একটি টমেটোগাছ সর্বোচ্চ তিন কেজি টমেটো উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের একটি টমেটোগাছ ৫০ কেজির বেশি টমেটো উৎপাদন করতে পারে। অবিশ্বাস্য, তাই না? কিন্তু এটাই সত্য।
এই উদাহরণের মাধ্যমে আপনি ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন, আমাদের কৃষি সংস্কারের মাধ্যমে আমরা আমাদের জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার কমাতে পারি এবং আমাদের যা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি উৎপাদন করতে পারি।
এবার লজিস্টিক সুবিধার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। এ ছাড়া আমি যখন ফ্রান্স হয়ে বেলজিয়াম থেকে যুক্তরাজ্যে যাচ্ছিলাম, তখন বাসে আমার পাঁচ ঘণ্টা লেগেছিল।
ব্যক্তিগত গাড়িতে ভ্রমণ করলে আরও কম সময় লাগবে। চমৎকার লজিস্টিক সিস্টেমের বিকাশের মাধ্যমে, আমরা তাজা, নিরাপদ এবং সেরা খাবার নিশ্চিত করতে পারি, যা আমাদের দেশের মানুষ প্রতিদিন চেয়ে থাকে।
এতে খাদ্যেরও অপচয় কমবে।
রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার:
আমাদের একসঙ্গে বসে বলতে হবে, আমরা সবাই বাংলাদেশি।
আমাদের ভিন্নমত থাকতে পারে, কিন্তু আমরা বাংলাদেশি। এটি এমন একটি দেশ, যেখানে মানুষ দুটি জিনিস দ্বারা শাসন করতে পারে—ভয় ও লোভ।
আমরা যে বাংলাদেশ চাই, তা উন্নয়নের জন্য আমাদের রাজনীতিবিদদের এ দুটি শব্দ ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে হবে।
মহিবুল ইসলাম ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের শিক্ষক