বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ ৭৯ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং প্রতিবছর প্রায় ৪২ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন। গবেষণা বলছে, এখনো দেশে যক্ষ্মাবিষয়ক অনেক স্টিগমা ও কুসংস্কার চালু আছে। এসবের মধ্যে ভয়ানক বিষয় হলো, কারও যক্ষ্মা হলে সে তথ্য গোপন করে এবং নীরবে সে অন্য মানুষকে সংক্রমিত করে। নীরবেই যক্ষ্মার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে হাজারও প্রাণ। এসব মৃত্যুর কারণে ঝরে পড়ছে অনেক শিশু ও তরুণ।
নতুন বাংলাদেশের সন্ধিক্ষণে সেই নীরব ঘাতক যক্ষ্মার বিরুদ্ধে সরব আন্দোলন হিসেবে আয়োজন করা হয় স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড। সদ্য সমাপ্ত বর্ষে অনুষ্ঠিত এই অলিম্পিয়াডে সহস্রাধিক শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। শুরুতে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১২টি জেলায় আঞ্চলিক স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড এবং সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে কুইজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। পরে আঞ্চলিক ও অনলাইন পর্বের বিজয়ী ৫৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য আয়োজন করা হয় ‘জাতীয় স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড-২০২৪’।
সরব আয়োজন
যক্ষ্মা বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য খাতে সংকট তৈরি করেছে। সেই প্রেক্ষিতে সবাইকে সচেতন করতে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) পরিচালনায় প্রথম আলো যক্ষ্মারোগের বিস্তার রোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইউএসএআইডির সহায়তায় প্রচারণার উদ্যোগ নেয়।
প্রচারণা উদ্যোগের অংশ হিসেবে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের যক্ষ্মা বিষয়ে সচেতন করার জন্য দেশে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় এই স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড। অলিম্পিয়াডে উদ্বোধনী আয়োজনের পরেই শুরু হয় কুইজ। কুইজ পর্বে যক্ষ্মা ও স্বাস্থ্য সচেতনতাবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১২ শতাংশ অর্থাৎ বছরে ৩০ হাজারের মতো শিশু যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হওয়ার কথা, যেখানে শনাক্ত হচ্ছে মাত্র ১০ হাজার। অলিম্পিয়াড আয়োজনের মাধ্যমে শিশু-কিশোরেরা যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করে। সমাজে যক্ষ্মা প্রতিরোধের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি ও অন্যদের উৎসাহিত করার অঙ্গীকার করতে উদ্বুদ্ধ হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীর বড় একটা অংশ ঝরে পড়ে যক্ষ্মার প্রভাবে।
দেয়ালিকা আর উৎসব আয়োজন
স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিশু-কিশোরেরা যক্ষ্মা রোগ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ও সচেতনতা অর্জন করে। এই অলিম্পিয়াডে বিভিন্ন শিক্ষামূলক ও সৃজনশীল কার্যক্রমের মধ্যে দেয়ালিকা প্রদর্শন ছিল অন্যতম। দেয়ালিকাগুলোতে যক্ষ্মার কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধপদ্ধতি এবং চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত ও তথ্যবহুল উপস্থাপনা প্রদর্শন করে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা। ‘যেকোনো রোগ মানেই তো ভয়, সচেতনতা ছাড়া সেই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগ নেই। যক্ষ্মা কিংবা যেকোনো সংক্রামক রোগকেই আমরা হারিয়ে দিতে পারি’, যক্ষ্মা কীভাবে ছড়ায়, কীভাবে যক্ষ্মা সামাজিকভাবে ট্যাবু তৈরি করে, তা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে ভিন্নমাত্রিক একটি দেয়ালিকার উপস্থাপনা দেয় নওগাঁর চকরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘গোলাপ’ দল।
শিক্ষার্থীরা দেয়ালিকার মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যক্ষ্মার প্রভাব ও চিকিৎসার নানা বিষয় সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়। বগুড়ার আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা কয়েক সপ্তাহ পরিশ্রম করে একটি দেয়ালিকা তৈরি করে। এ দেয়ালিকাগুলো দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছে শিক্ষার্থীরা যক্ষ্মার কারণ ও প্রতিকারের গভীরে যেতে সক্ষম হয়েছে।
আমাদের সব অলিম্পিয়াডের মতো এখানেও ছিল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশিষ্ট চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিকদের নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব। এতে শিক্ষার্থীদের অদ্ভুত আর সৃজনশীল নানা ধরনের প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হন সবাই। সেখানে যক্ষ্মার পাশাপাশি অন্যান্য রোগ ও স্বাস্থ্য সচেতনতাও উঠে আছে। দেশে এখন নানা বিষয়ের অলিম্পিয়াড হয়। তার প্রায় সব কটিতেই শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের মান দেখে বোঝা যায় তাদের মধ্যে জানার আগ্রহ কতটা প্রবল।
সুস্বাস্থ্য ও নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়
জাতীয় স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াডের প্রধান অতিথি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘নাগরিকেরা সুস্থ না হলে জাতি সুস্থ হবে না। এ জন্য শৈশব থেকেই স্বাস্থ্যবিষয়ক জ্ঞানার্জন জরুরি। সমাজকে পরিবর্তনের জন্য সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। এসব কারণে এই স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড খুবই গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন। ইতিমধ্যে তোমরা দেশ গড়ার সংগ্রামে অংশ নিয়েছ। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছে, সেখানে সবার অংশগ্রহণ জরুরি।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এ জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, বায়ুকে নির্মল রাখা, পরিবেশদূষণমুক্ত রাখতে পলিথিন-প্লাস্টিক বর্জন, এমন অনেক কিছুর অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। নতুন প্রজন্ম এখন অনেক কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকে। তারাই দেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেবে।
আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, যক্ষ্মা সংক্রামক রোগ। কফ-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। যত্রতত্র থুতু, কফ কাশি ফেলা যাবে না। এসব শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও প্রোগ্রাম অন ইমার্জিং ইনফেকশন্স বিভাগের প্রধান সায়েরা বানু বলেন, দেশে কোভিডের চেয়েও যক্ষ্মায় অনেক বেশি মৃত্যু নিরাময়যোগ্য এই রোগের কারণে। শিক্ষার্থীরা এই আয়োজন থেকে যক্ষ্মা সম্পর্কে যে জ্ঞান লাভ করেছে, তা তারা নিজেদের এলাকায় ছড়িয়ে দিলে জনসচেতনতা বাড়বে।
স্বাস্থ্যদূত হিসেবে দিনবদলের ডাক
স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াডের কুইজ ও সচেতনতা কার্যক্রমের কারণে শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্য ও যক্ষ্মা সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ পেয়েছে। অনেক ভুল ধারণা ভেঙেছে। বগুড়ার বিয়াম মডেল স্কুল ও কলেজের নিশাত তাসনিম বলে, ‘স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের মাধ্যম আমি ও আমার বন্ধুরা যক্ষ্মা কেন হয়, কীভাবে ছড়ায়, কোথায় চিকিৎসা নেওয়া যায়, সেই সম্পর্কে জেনেছি। কুইজ-দেয়ালিকার মাধ্যমে যক্ষ্মা কীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে, সেই সম্পর্কে শিখেছি।’
নিশাতের মতো অসংখ্য শিক্ষার্থীর সামনে স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড নতুন করে জানার সুযোগ স্বাস্থ্যবিষয়ক অনেক তথ্য। এসব তথ্য নিজেদের ব্যক্তিজীবন ও কমিউনিটির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নতুন এক বাংলাদেশের প্রত্যয় নিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
আমাদের দেশে টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) অধীনে শিশুদের যক্ষ্মা থেকে সুরক্ষার জন্য বিসিজি টিকা দেওয়া হয়। গবেষণা বলছে, একটা সময় এই টিকার কার্যকারিতা থাকে না। ফলে টিকা দেওয়ার পরও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। অন্য যেসব দেশ যক্ষ্মার ঝুঁকিতে আছে, সেসব দেশে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলমান। এসব কার্যক্রমে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের পরিচিত ব্যক্তিত্ব, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, জনপ্রতিনিধি সমন্বিত ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে থাকেন।
কিন্তু আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। এসব উদ্যোগের পাশাপাশি যক্ষ্মাসহ সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ে এসব সচেতনতামূলক তথ্য গুরুত্ব দিয়ে যুক্ত করা জরুরি। নীরব ঘাতক যক্ষ্মাকে সরবে মোকাবিলার প্রত্যয়ে শতাধিক যক্ষ্মাসচেতন শিক্ষার্থী এখন নতুন বাংলাদেশে জোরালো ভূমিকা রাখার প্রত্যাশা থাকছে আমাদের।
মুনির হাসান প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক