তুরস্ক কেন ইসরায়েলের আগ্রাসন রুখে দাঁড়াবে

রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুছবি: রয়টার্স

সিরিয়ার জনগণ তাঁদের সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সফল হওয়ার পর অঞ্চলটির ভূরাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আসাদের বিদায়ের পর সিরিয়ার নতুন প্রশাসন এবং এর মিত্রদের, বিশেষ করে তুরস্কের বিরুদ্ধে ইসরায়েল আগ্রাসী আচরণ শুরু করেছে। ইসরায়েল এরই মধ্যে সিরিয়ার কয়েক শ সামরিক স্থাপনা ও অস্ত্রভান্ডারে হামলা চালিয়েছে। সিরিয়ার নতুন সরকার যাতে সংহত হয়ে দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীলতা অর্জন করতে না পারে, সে উদ্দেশ্য থেকেই ইসরায়েলের এ আচরণ।

বিমান হামলার পাশাপাশি ইসরায়েল দ্রুজ, কুর্দি ও আলাউয়ি সম্প্রদায়কে দিয়ে বিভক্তি তৈরি করার চেষ্টা করছে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নানাভাবে সিরিয়ার নতুন সরকার ও তুরস্কের বিরোধিতা করার চেষ্টা করে চলেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেনদরবার করছেন, যাতে করে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর উপস্থিতি থাকে এবং কুর্দি মিলিশিয়া গোষ্ঠী ওয়াইপিজের প্রতি সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রাখে। এমনকি রাশিয়ার সেনারা যেন সিরিয়ায় তাঁদের ঘাঁটিতে ফিরে আসেন, তা নিয়েও নেতানিয়াহু দেনদরবার করেছেন।

গত মাসেও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যেসব খেলোয়াড় সিরিয়াকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। তা সত্ত্বেও সিরিয়ায় ইসরায়েল উত্তেজনা বাড়িয়ে চলেছে। দামেস্কের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে সম্প্রতি বিমান হামলা চালিয়ে ইসরায়েল সিরিয়ার নেতৃত্বের প্রতি স্পষ্ট হুমকির বার্তা দিয়েছে। 

সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ইসরায়েলের এ হামলার নিন্দা করে। এক বিবৃতিতে আহমেদ আল-শারা আরব দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সিরিয়াকে সমর্থন দেওয়ার আহ্বান জানান। ইসরায়েল ঐতিহ্যগতভাবেই সিরিয়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অস্ত্রে পরিণত করে আসছে। সাম্প্রদায়িক বিবাদ তৈরি করতে বিচ্ছিন্নতাবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উত্সাহ দিয়ে এবং অভ্যন্তরীণ সহিংসতাকে উসকে দিয়ে ইসরায়েল তাদের নিজেদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে চায়।

গত মাসে আজারবাইজানে আঙ্কারা ও তেল আবিবের মধ্যে সংলাপ ব্যর্থ হয়। ইসরায়েলের আক্রমণ প্রতিহতের প্রস্তুতি না নিয়েই তুরস্ক যদি শুধু বিবৃতি দিয়ে সতর্কতা জারি করে, তাহলে দেশটি তার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। ইসরায়েল যদি তার অস্থিতিশীলতা তৈরির কৌশল অব্যাহত রাখে, তাহলে সিরিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়া বিশৃঙ্খলা তুরস্ককেও ভোগাবে।

সিরিয়াকে সমর্থন দেওয়ার জন্য আঙ্কারা আঞ্চলিক নিরাপত্তাবলয় তৈরিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এটা ত্বরান্বিত করা দরকার। এই অঞ্চলের দেশগুলো এরই মধ্যে ব্যাপক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ইসরায়েলের নীতির কারণে সেখানে ব্যাপক জনরোষ তৈরি হয়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে তুরস্কের সম্পর্কটা সচল রাখা দরকার। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের কাছে এরদোয়ানকে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা উচিত।

প্রথমত, ইসরায়েল যদি তার অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা জারি রাখে, তাহলে অন্য আঞ্চলিক খেলোয়াড়েরা সিরিয়ায় ও আশপাশের দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ইসরায়েলের আগ্রাসন মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের অনেকের কাছে ইরানের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেবে। এ পরিস্থিতি দুর্বল প্রতিবেশী দেশগুলোতে দ্রুত সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের প্ররোচনা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারাকে সমানভাবে বিপজ্জনক দুটি বিকল্পের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। প্রথমটি হলো, বাছবিচারহীনভাবে প্রতিশোধের পথ তাঁকে বেছে নিতে হতে পারে, যেটা সম্ভাব্য যুদ্ধের সূত্রপাত করতে পারে। দ্বিতীয়টি হলো, চুপ করে সহ্য করে যাওয়া। এটা তাঁকে দুর্বল ও অক্ষম হিসেবে চিত্রিত করবে। দুটি বিকল্পই উগ্রপন্থীদের উত্থানের উর্বর ভূমি।

তৃতীয়ত, সংখ্যালঘুদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার ইসরায়েলি নীতি অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে। মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন ও সংখ্যালঘুদের নিয়ে তাদের নীতি সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে হতাশা বাড়িয়ে তুলেছে। 

চতুর্থত, ইসরায়েলের অব্যাহত উসকানি শেষ পর্যন্ত অন্য দেশগুলোকে সিরিয়ার সহযোগিতার জন্য টেনে আনবে। প্রতিযোগিতায় দেশগুলোর কেউই লাভবান হবে না; বরং নিজেদের সম্পদও শুধু ধ্বংস হবে। গত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা সেটাই বলছে।

পঞ্চমত, ব্যর্থ রাষ্ট্রকে ঘিরে রাখার কৌশল ইসরায়েলকে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিতে বিপরীত হবে। আফগানিস্তান ও ইরানের অভিজ্ঞতা বলছে, ব্যর্থ রাষ্ট্র চরমপন্থা ও অভিবাসী সংকটের উর্বর ভূমি। সিরিয়া যদি একই পথ অনুসরণ করে, তাহলে ইসরায়েল সহযোগিতা দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনিবার্যভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ফিরে আসতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষেরা যুক্তরাষ্ট্রকে ভীষণ রকম শত্রু ভাবে। এমন বৈরী পরিবেশে যুক্তরাষ্ট্রের ফেরার অর্থ হলো তাদের মূল্যবান সম্পদ হারানো।

আলী বাকির ইবনে খালদুন সেন্টার ফর হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের গবেষণা সহকারী অধ্যাপক

মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত