এলিস স্প্রিং, ফার্স্ট নেশনস আর সম্ভাবনার গল্প

ফার্স্ট নেশনস অস্ট্রেলিয়া রাইটার্স নেটওয়ার্কের (ফুওন) আমন্ত্রণে আমরা অস্ট্রেলিয়ার এলিস স্প্রিং গিয়েছিলাম ১৭ আগস্ট। আইইউবির সহকারী অধ্যাপক বরেন্দ্রলাল ত্রিপুরা ও আমি। বরেন ত্রিপুরা ভাষার কবি ও সাহিত্যিক।

তিন দিনের সম্মেলন ১৮ থেকে ২০ আগস্ট। প্রথম দিন কবিতা পাঠের আসর বসেছিল এলিস স্প্রিংয়ের একটি হলরুমে। অতি সাধারণ মঞ্চ। চারপাশে বসে, দাঁড়িয়ে, কফি শপে হেলান দিয়ে, এমনকি মেঝেতে বসে কবিতা শুনেছেন অনেক শ্রোতা, যাঁরা অনেকে বয়সে তরুণ, মাঝবয়সী এবং অনেকে বৃদ্ধ, যাঁদের ওরা বলে এলডারস। প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। কারও বই বেরিয়েছে, কেউ বই প্রকাশের অপেক্ষায়, আবার কেউ সাহিত্য বা কবিতার জন্য পুরস্কার পেয়েছেন—এমন সব মানুষ। এসব মানুষের ভিড়ে বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত আমরা দুজন তাঁদের ভাষায় ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেলিগেটস’। 

অস্ট্রেলিয়ায় তরুণ কবির দল প্রেম, বিচ্ছেদ, বেদনা, আনন্দ, দ্রোহ, চিৎকার আবার আবেগজড়ানো কবিতা আবৃত্তি করেছেন। 

অন্যদিকে, বয়স্ক লেখকেরা কিছুটা কোমল সুরে আবৃত্তি করছেন। এসব কবিতার বেশির ভাগ ইংরেজিতে। অতি অল্প অ্যাবরিজিনাল পিপল বা ফার্স্ট নেশনস ভাষায়। ফার্স্ট নেশনস ভাষার কবিতা হারিয়ে যাওয়ার কারণ হলো, ৬০ হাজার বছর আগের এই প্রাচীন জাতি ইতিহাসের নানা পথপরিক্রমায় ভূমিসহ অনেক কিছু হারিয়েছে।

২.

শুরুতে কয়েকটি আবৃত্তি শুনে আমি ভেবেছিলাম, তাঁদের কবিতাজুড়ে বোধ হয় শুধুই যন্ত্রণা, ভূমি, আত্মপরিচয় ও সংস্কৃতি হারানোর দুঃখ আর হাহাকার ফুটে উঠবে। কিন্তু না। আমি শুনলাম, তাঁরা আবৃত্তি করছেন, ‘মাই কান্ট্রি সিংস সং।’ তাঁরা আশা ও স্বপ্নের কথা বলেন। আমাদের জন্য কবিতার একটি বই দেওয়া হলো। বইয়ের নাম কুরাকা। বইয়ে ‘কান্ট্রি’ শিরোনামে একটি কবিতা দেখলাম। কবি ব্রেন্ডা গিফোর্ড। ছোট্ট কবিতা। তিনি লিখেছেন, ‘দেশ আমার কাছে সংগীতের মতো, তাই আসুন সবাই মিলে গান গাই।’

৩. 

কবিতা পাঠের আয়োজন পরিচালনা করেছেন ফুওনের চেয়ারপারসন হেনরি ইভেট হল্ট। অতি সহজ–সরল ও প্রাণবন্ত সঞ্চালনা। মঞ্চের পাশে ব্যানারে লেখা, ‘ইউ আর নট জাস্ট রিলেটেড টু পিপল, ইউ আর রিলেটেড টু দ্য কান্ট্রি। অ্যান্ড ইউ লুক আফটার দ্যাট কান্ট্রি দ্যাট ইউ আর রিলেটেড টু জাস্ট অ্যাজ ইউ লুক আফটার দ্য পিপল।’ উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে ড. এম কে টার্নারের কথা থেকে। আমি এই কথাগুলোর বাংলা অনুবাদ করলাম না; হয়তো এর ভেতরের আবেগ ও অনুভূতি সঠিকভাবে বোঝাতে পারব না বলে।

আমরা যে ফার্স্ট নেশনস অস্ট্রেলিয়া লেখক সম্মেলনে এসেছি, এখানে অংশগ্রহণকারীদের বেশির ভাগ সাদা মানুষ। তাঁরা তৃতীয় থেকে পঞ্চম প্রজন্মের অ্যাবরিজিনাল পিপল। তাঁরা মেধাবী ও নানা দিকে প্রতিষ্ঠিত। কেউ এসেছেন মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি থেকে, কেউ সিডনির ইউনিভার্সিটি থেকে, কেউ অ্যাডিলেড বা ব্রিসবেন থেকে। কেউ ফিল্ম তৈরি বা মিডিয়া, কেউ প্রকাশনা ও অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।

ব্রিসবেন থেকে এসেছেন একটি মেয়ে। তিনি উপন্যাস লিখছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস বেরোবে আগামী বছর। তিনি খুব রোমাঞ্চিত। তাঁর নাম আঞ্জি ফে মার্টিন। তিনি আমাকে বলেছেন, ১৪ বছর সরকারি চাকরি করে এখন লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছেন। তাঁর স্বামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাবরিজিনাল বা ফার্স্ট নেশনদের গল্প, বিশেষ করে জীবনী গল্প এখন প্রকাশনাজগতে জনপ্রিয় ও দামি। এই অনুষ্ঠানে এসে আমার মনে হলো, একটি উন্নত দেশে উন্নত সংস্কৃতির মধ্য থেকে সাহিত্য ও কাব্য রচনা আর সৃজনশীল কাজ কত গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দদায়ক। 

৪.

সব মিলিয়ে চার দিন ছিলাম এলিস স্প্রিংয়ে ফার্স্ট নেশনস মানুষের সঙ্গে। তাঁদের কথা বলার ধরন ও সংগ্রাম, পিনপতন নীরবে অন্যের কথা শোনার সংস্কৃতি, হাস্যরসের সময় স্বতঃস্ফূর্ত মেতে ওঠা আর নীরব শ্রোতা হয়ে যাওয়া, অন্যের মতামতকে সম্মান জানানো ও প্রশংসা করা, অন্যকে সাহায্য করার মানসিকতা, কবি ও লেখকদের উন্নত চিন্তা ও মূল্যবোধ—সব মিলিয়ে অন্য রকম ভালো লাগা ও শিক্ষা কাজ করেছে আমার মধ্যে। শত বছরের অবিচার ও বঞ্চনার মধ্যেও সম্ভাবনার দিগন্তরেখা উন্মোচিত হচ্ছে অ্যাবরিজিনালদের জন্য।

২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড পার্লামেন্টে সমগ্র জাতির পক্ষে ‘অতীতের ভুল আচরণের জন্য’ অ্যাবরিজিনাল পিপলদের কাছে ক্ষমা চান। ফার্স্ট নেশনদের উন্নয়নের জন্যও রাখা হয়েছে বিশেষ বরাদ্দ আর নতুন পরিকল্পনা। লেখাটি শেষ করা যাক কুয়ান্টাস ফ্লাইটের ঘটনা দিয়ে। সিডনি থেকে ১৭ আগস্ট যাত্রা করি এলিস স্প্রিংয়ের উদ্দেশে। ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিটের ফ্লাইট। দুপুরে যখন ল্যান্ড করবে ফ্লাইট, তখন পাইলট যে ঘোষণা দিলেন, তা এ রকম, ‘সম্মানিত যাত্রীরা, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে অবতরণ করব এলিস স্প্রিংয়ের ভূমিতে, যা এখানের আরুন্ডা আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমি।’ পরে আমি জেনেছি, অস্ট্রেলিয়ায় বড় কোনো অনুষ্ঠানের শুরুতে তা সরকারি বা বেসরকারি যা–ই হোক, ফার্স্ট নেশনস পিপলদের পূর্বপুরুষের অবদান ও ঐতিহ্যকে সম্মান জানানো হয়। চার দিন পর যখন এলিস স্প্রিং থেকে ডারউইনের ফ্লাইট ধরি, তখনো ল্যান্ডিংয়ের সময় পাইলট ঘোষণা দিয়েছেন, আমরা ল্যান্ড করছি লারাকিয়া ফার্স্ট নেশনদের ঐতিহ্যগত ভূমিতে। 

এই স্বীকৃতি যতই আনুষ্ঠানিক হোক, ক্ষুদ্র হোক, এতে শত বছরের বঞ্চনা ও নিপীড়নের যে ক্ষত সমাজ বয়ে বেড়ায়, তাদের জন্য কোনো অংশেই সামান্য নয়। এভাবেই জগতে–সমাজে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যায়। 

সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী 

[email protected]