শুক্রবার ইরানি নিরাপত্তা বাহিনী নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত নার্গিস মোহাম্মদিকে চুল ধরে টেনে একটি গাড়িতে তুলে নেয়। তাঁর অপরাধ কী? উত্তর-পূর্ব ইরানের শহর মাশহাদে সম্প্রতি রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মৃত এক মানবাধিকার আইনজীবীর স্মরণসভায় অংশ নেওয়া। প্রত্যক্ষদর্শীরা বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার দৃশ্য বর্ণনা করেছেন—টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ, পালাতে গিয়ে শোকাহত মানুষের মারধর।
গত দুই দশকের বড় অংশ যাঁর কাটেছে তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে যাতায়াতের মধ্যে, সেই মোহাম্মদিকে অন্তত আরও ৯ অধিকারকর্মীর সঙ্গে আটক করা হয়। তিনি এক বছর ধরে চিকিৎসার কারণে কারাগার থেকে সাময়িক মুক্তিতে ছিলেন এবং ধারাবাহিকভাবে ইরানি জনগণের অধিকতর স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের পক্ষে কথা বলছিলেন। টাইমে সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে নার্গিস মোহাম্মদি লিখেছিলেন, ‘সহিংসতা বাইরে থেকে আরোপিত হোক বা ভেতর থেকে, কোনোটাই সমাধান নয়।’
নার্গিস মোহাম্মদি একমাত্র লক্ষ্যবস্তু নন। ডিসেম্বরের শুরুতে তেহরানের একটি আদালত প্রখ্যাত ইরানি চলচ্চিত্রকার জাফর পানাহিকে তাঁর অনুপস্থিতিতে এক বছরের কারাদণ্ড, দুই বছরের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘প্রচারমূলক কর্মকাণ্ডে’ জড়িত থাকার অভিযোগে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সদস্যপদে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
দণ্ডাদেশের খবর ছড়িয়ে পড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘স্বর্ণপাম’জয়ী পানাহি গথাম অ্যাওয়ার্ডসে তাঁর চলচ্চিত্র ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট’-এর জন্য সেরা পরিচালক, সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য এবং সেরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের পুরস্কার জেতেন। দুবার গ্রেপ্তার ও চলচ্চিত্র নির্মাণে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়া পানাহি তাঁর সর্বশেষ ছবির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস প্রচারণা শেষ করে ইরানে ফেরার পরিকল্পনা করছেন।
তেহরানে আতঙ্ক
জুনে ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধের পর থেকে ইরানি কর্তৃপক্ষ হাজার হাজার মানুষকে, যাঁদের তারা গুপ্তচর সন্দেহ করেছে, গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে বহু অধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও সাধারণ নাগরিক রয়েছেন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, তেহরান এক হাজারের বেশি মানুষকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। ইন্টারনেট বন্ধ রাখা এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
শক্তিশালী বলে নয়, বরং আতঙ্কিত বলেই ইরানের নিরাপত্তাযন্ত্র অতিরিক্ত চাপে কাজ করছে। ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধটি ইরানের তথাকথিত ‘প্রতিরোধ অক্ষ’-এর শক্তি প্রদর্শনের কথা ছিল। বাস্তবে ইসরায়েলের নিখুঁত হামলায় বিপ্লবী গার্ডের শীর্ষ কমান্ডাররা নিহত হন, পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর তেহরানের বহুল প্রচারিত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যে মূলত ব্যয়বহুল প্রদর্শনী, তা উন্মোচিত হয়।
হিজবুল্লাহ থেকে হামাস—ইরানের আঞ্চলিক প্রক্সিগুলো কার্যত গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। কয়েক দশকে নির্মিত প্রতিরোধের কাঠামো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ইরানের অর্থনীতি, রাজনীতি ও পরিবেশের অবস্থাও সমানভাবে ভয়াবহ। মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৪০ শতাংশে ঘোরাফেরা করছে। মাংস হয়ে উঠেছে বিলাসপণ্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ১ বছরে ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পানিসংকট। অন্তত অর্ধশতকে ইরান সবচেয়ে ভয়াবহ খরার মুখে। রাজধানী তেহরানের আশপাশের জলাধারগুলোর ধারণক্ষমতা ১০ শতাংশের নিচে। প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সম্প্রতি সতর্ক করেছেন, বৃষ্টি না এলে তেহরান খালি করে দিতে হতে পারে। গত সপ্তাহে কিছু বৃষ্টি হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
দমনের এক নির্মম ইতিহাস
এই সবকিছুর ওপর ভর করে রয়েছে উত্তরাধিকার প্রশ্ন। ১৯৮৯ সাল থেকে ইরান শাসনকারী সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এখন ৮৬ বছর বয়সী। তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে বহু বছর ধরেই জল্পনা রয়েছে। ২০১৪ সালে তিনি প্রোস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়েছিলেন। ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের পর যখন তিনি লক্ষ্যবস্তু ছিলেন, তাঁকে জনসমক্ষে খুব কমই দেখা দিয়েছেন। কথিত রয়েছে, ধর্মীয় নেতাদের একটি কমিটি উত্তরসূরি খোঁজার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে। সম্ভাব্য নামের তালিকায় ঘুরছে খামেনির ছেলে মোজতবা এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নাতি হাসান খোমেনির নাম।
শাসনব্যবস্থাটি সেই রূপান্তরের আগেই মরিয়া হয়ে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়। ক্ষমতার মসৃণ হস্তান্তরের জন্য প্রয়োজন একটি নিশ্চুপ জনগোষ্ঠী; ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা সমাজ নয়। ৪৬ বছরের ইতিহাসে ইরান মাত্র একবার উত্তরাধিকার বদল সামলাতে পেরেছে; তা–ও তুলনামূলকভাবে অনেক কম উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে। খামেনির আশপাশের লোকজন জানে, অন্তর্বর্তী সময়টাই হবে সর্বোচ্চ ঝুঁকির মুহূর্ত।
প্রশ্ন হলো, এভাবে আর কত দিন চলতে পারে। ভয়ভিত্তিক শাসন বিস্ময়করভাবে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে—উত্তর কোরিয়ার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। কিন্তু ইরান উত্তর কোরিয়া নয়। এর জনগোষ্ঠী শিক্ষিত, নগরায়িত এবং শাসনব্যবস্থার সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত। বারবার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তরুণেরা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, তাঁরা ধর্মতান্ত্রিক শাসন প্রত্যাখ্যান করে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে দেখা যায়, দেশটি যখনই নিজেকে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে মনে করেছে, তখনই ইচ্ছাকৃতভাবে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও অধিকারকর্মীদের নিশানা করেছে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর অস্থির সময়ে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এর মধ্যে শাহবিরোধী আন্দোলনে শুরুতে সমর্থন দেওয়া বামপন্থী গোষ্ঠীর সদস্যরাও ছিলেন।
১৯৮৮ সালের জুলাইয়ে ইরান-ইরাক যুদ্ধের যুদ্ধবিরতির পর ইরাক থেকে পরিচালিত সশস্ত্র বিরোধী সংগঠন মুজাহিদিন-ই-খালক (এমইকে) ইসলামি প্রজাতন্ত্র উৎখাতের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। এমইকের ওই অনুপ্রবেশের পরপরই হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দীকে হত্যা করা হয় এবং গোপন গণকবরে দাফন করা হয়।
২০০৯ সালের সবুজ আন্দোলনের বিক্ষোভ দমন করতেও আবার ব্যাপক দমন-পীড়নের আশ্রয় নেওয়া হয়। নির্বাচনী জালিয়াতির বিরুদ্ধে লাখো মানুষ রাস্তায় নামলে সরকার লাঠি, গুলি ও কণ্ঠরোধের মাধ্যমে জবাব দেয়। চলচ্চিত্রকার, লেখক ও শিক্ষাবিদদের গ্রেপ্তার, জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, কিছু ক্ষেত্রে হত্যা পর্যন্ত করা হয়।
২০২২ সালের ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ আন্দোলনের পর দমন আরও তীব্র হয়, যার সূত্রপাত হয়েছিল নীতি পুলিশের হেফাজতে তরুণ কুর্দি নারী মাসা আমিনির মৃত্যুকে ঘিরে। বিক্ষোভকারীদের রাস্তায় গুলি করা হয়। বিশিষ্ট অধিকারকর্মীদের দীর্ঘ কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর শাসনব্যবস্থা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষদের টার্গেট করে—র্যাপার তুমাজ সালেহিকে মৃত্যুদণ্ড (পরে সাজা কমানো হয়) দেওয়া হয়, চলচ্চিত্রকারদের কাজ করতে নিষেধ করা হয় আর অভিনেত্রীদের হিজাব ছাড়া জনসমক্ষে হাজির হওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
আমরা এই নির্মম ঐতিহ্যেরই সর্বশেষ পুনরাবৃত্তি দেখছি; তবে এমন এক তীব্রতায়, যা ইঙ্গিত দেয় যে শাসনব্যবস্থা বর্তমান হুমকিকে অস্তিত্বগত বলে মনে করছে। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও মোহাম্মদির গ্রেপ্তার ও পানাহির দণ্ডাদেশ কূটনৈতিক মূল্য বহন করে।
আসন্ন সংকট
প্রশ্ন হলো, এভাবে আর কত দিন চলতে পারে। ভয়ভিত্তিক শাসন বিস্ময়করভাবে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে—উত্তর কোরিয়ার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। কিন্তু ইরান উত্তর কোরিয়া নয়। এর জনগোষ্ঠী শিক্ষিত, নগরায়িত এবং শাসনব্যবস্থার সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত। বারবার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তরুণেরা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, তাঁরা ধর্মতান্ত্রিক শাসন প্রত্যাখ্যান করে। ২০২২ সালের বিক্ষোভ দমন করা হলেও সেই আন্দোলনের জ্বালানি ক্ষয় হয়নি।
ববি ঘোষ টাইম সাময়িকীর সাবেক বিদেশ সংবাদদাতা ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক; ভূরাজনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক
টাইম থেকে নেওয়া। সংক্ষেপিত আকারে অনুবাদ।