সুন্দরবনের নতুন হুমকি বনদস্যু নাকি মহাজন

সুন্দরবনে মাছ ধরছেন জেলেরা

সুন্দরবনে অল্প কিছু মানুষের লোভ-লালসা আর অপকর্মের শিকার হচ্ছে বননির্ভরশীল মানুষ ও গোটা বনের জীববৈচিত্র্য। সুন্দরবনের ওপর অত্যাচারের নতুন মাত্রা হিসেবে যোগ হয়েছে বিষ ছিটিয়ে মাছ ধরা।

গত বছরের জুলাই মাসের এক সন্ধ্যায় খুলনার কয়রা উপজেলায় পৌঁছে অটোরিকশায় চড়ে ফিরছিলাম ডাকবাংলোয়। সুন্দরবনে বিষ ছিটিয়ে মাছ ধরার আলাপ উঠতেই অটোরিকশাচালক বললেন, ‘পীর সাহেবদের অনুমতি নিয়ে মুফতি-আউলিয়ারা পানি পড়া দিয়ে মুরিদদের স্বর্গে পাঠায়।’ কৌতূহলী হয়ে জানতে পারলাম, পীর সাহেব মানে বন বিভাগ, মুফতি-আউলিয়া মানে স্থানীয় প্রভাবশালীরা, মুরিদ মানে সাধারণ জেলে, আর পানি পড়া মানে বিষ, যা দিয়ে স্বর্গ, অর্থাৎ সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান এই জেলেরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রভাবশালীদের মধ্যে বড় মাছ ব্যবসায়ী ও স্থানীয় রাজনীতিবিদ যেমন রয়েছেন, তেমনি আছে প্রশাসন ও সংবাদকর্মীদের মতো নানা চক্র। কিন্তু সাধারণ জেলেরা প্রায়ই বিষ দিতে গিয়ে ধরা পড়লেও মদদদাতা চক্রের নাম প্রকাশ করতে চায় না। কারণ, সে চক্রই তাদের আবারও মুক্ত করে নিয়ে আসে।

কয়রায় বন বিভাগের কাশিয়াবাদ স্টেশনে পৌঁছাতে রাত প্রায় সাড়ে ১২টা বেজে যায়। বিষ দেওয়ার ঘটনা স্বচক্ষে দেখতে ঘুটঘুটে অন্ধকারে সেখানকার স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে একটা নৌকায় চড়ে সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া নদীতে চুপিসারে আমরা এগোতে থাকলাম। তখন বনে নিষেধাজ্ঞার সময়। নদীর তীরে কিছু লোককে জাল ফেলতে দেখলাম।

জানলাম, বনের সেই স্থানে নিষেধাজ্ঞা নেই। এর বাইরে আর কিছু দেখলাম না। বুঝলাম, টহল দেওয়ার খবর পেলে বিষ দেওয়া চক্র আগেই পালিয়ে যায়। তাই টহল দেওয়া এলাকায় বিষের উৎপাত কম।

পরদিন কয়রার কাটকাটা থেকে নৌকায় সাতক্ষীরার গাবুরার দিকে রওনা হলাম। মাঝে বন বিভাগের বজবজা ফাঁড়িতে যাত্রাবিরতি দিয়ে এরপর কবোদাক স্টেশন। এই দুই স্থান ও গাবুরায় পৌঁছে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আগে তাঁরা নিষেধাজ্ঞার সময় বনে না গিয়েও আশপাশের নদী থেকে মাছ ধরতে পারতেন। কিন্তু বিষ ছিটিয়ে মাছ ধরা শুরু হওয়ার কারণে খালের ছোট-বড় মাছ ও রেণু-পোনাই শুধু নয়, সাপ-ব্যাঙ, পোকামাকড়—সবই মারা যায়। ফলে নদীতে আর মাছ আসে না। তাই নিষেধাজ্ঞার সময় তাঁদের কোনো আয়রোজগার থাকে না।

এ ছাড়া অবৈধ ঘন জাল দিয়ে মাছ ধরার কারণে পোনা বড় হওয়ার সময় পায় না। বন বিভাগের কর্মীদের চার-পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিলেই এসব অবৈধ ঘন জাল নিয়ে সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি মেলে।

মাছ ধরা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই মহাজনেরা জেলেদের হাতে বিষ তুলে দেন বলে জানান। একজন মহাজন তো প্রস্তাব দিয়েই বসেছেন বনের এলাকা মহাজনদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার। তাহলে অনিশ্চয়তা থাকবে না, বিষ ছিটিয়ে মাছও ধরতে হবে না। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের জীবিকা নষ্ট হোক, বিষে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস হোক, বিষযুক্ত মাছ খেয়ে মানুষের প্রাণ যাক, কিন্তু মহাজনদের মুনাফা ঠিক থাকা চাই!

কয়েকটা ফাঁড়িতে বন বিভাগের কর্মীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, তাঁদের অবস্থাও ভালো নয়। রেশন নেই, বেতনের পরিমাণও কম। আবার অপরাধীকে ধরলেও জামিন পেয়ে যান সহজেই। বনের মধ্যে একটা ফাঁড়িতে তাঁরা তিন-চারজন কর্মী। নেই ভালো প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও। এমন অবস্থায় স্থানীয় অপরাধীরা অতর্কিত হামলা করে কি না, এ নিয়ে তাঁরা শঙ্কায় থাকেন। তাই অপরাধী ধরতে তাঁদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করে।

এ ছাড়া বিষ দিয়ে একবার মাছ ধরেই যাঁরা ৩০–৫০ হাজার টাকা রোজগার করেন, তাঁদের রাজনৈতিক সুবিধা পেতেও সমস্যা হয় না। বন বিভাগের কর্মীরা গত্যন্তর না পেয়ে কম টাকা ঘুষ পেলেই অনুমতি দিয়ে দেন বলে জানান।

তবে এর ফলে সাধারণ মানুষের মনে ধারণা জন্মায় যে বন বিভাগের কর্মীরাই অপরাধীদের ছেড়ে দেন। তাই তাঁরা আর অপরাধীদের ধরিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি নিতে চান না; বরং একজন ঘুষের বিনিময়ে ঘন জালে মাছ শিকার করলে অন্যরাও নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে একই কাজ করেন।

বন বিভাগের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের আস্থার সম্পর্ক না থাকলে বন রক্ষা করা কঠিন। স্থানীয় মানুষ যেহেতু সরকার বা রাষ্ট্র বলতে বন বিভাগকেই বোঝে, তাই রাষ্ট্র-নাগরিক সম্পর্কে একটা অনাস্থার দুষ্টচক্র তৈরি হয়।

স্থানীয় লোকজন জানান, আগে শুধু বনদস্যুদের টাকা দিলেই হতো। নির্দিষ্ট খাতায় নাম লিখিয়ে তারা দু-তিন মাসের জন্য বনে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিত। কিন্তু এখন অনেক ‘দস্যু’ (বন বিভাগ, নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড)। আবার ডাঙায় গেলে থানা-পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ এবং ট্রাফিক পুলিশকেও ঘুষ দিতে হয়। যেহেতু রেণুপোনা পরিবহন নিষিদ্ধ, তাই এই ঘুষ। এটা একটা ভয়ানক পরিস্থিতি, যেখানে নাগরিকেরা রাষ্ট্রের চেয়ে বনদস্যুদের ওপর বেশি আস্থা রাখছেন। রাষ্ট্রব্যবস্থার গলদের কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

আগে বনদস্যুরাই মহাজনদের নিয়ন্ত্রণ করত। ২০১৮ সালে সুন্দরবন বনদস্যুমুক্ত হয়। আর ৫ আগস্টের পর এখন মহাজনেরাই বনদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করেন। মহাজনেরা দ্রুত মুনাফার জন্য বিষ ছিটিয়ে মাছ ধরতে জেলেদের প্ররোচিত করেন।

প্রথম আলোর ২৩ জানুয়ারি প্রকাশিত অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, বনরক্ষীদের সঙ্গে যোগসাজশে বনের অভয়ারণ্যের নিয়ন্ত্রণ নেন মহাজনেরা। তাঁদের দেওয়া টিকিট ছাড়া কোনো জেলে সেখানে যেতে পারেন না। গেলে বনরক্ষী ও বনদস্যু উভয়ই সাধারণ জেলেদের আটক করে। অর্থাৎ মানুষের অধিকার হরণে রাষ্ট্র ও বনদস্যু এককাট্টা হয়েছে।

বিষ দিয়ে ধরা মাছ স্থানীয় মানুষেরা খায় না। আড়ত থেকে এগুলো চলে আসে রাজধানী ঢাকাসহ অন্য বড় শহরে। ঢাকায় দেখা যায় বড় বড় রেস্তোরাঁ, নামীদামি সুপারশপের পাশাপাশি অনলাইনে সুন্দরবনের মাছ বলে ব্র্যান্ডিং ও বিক্রি হয়।

মাছ ধরা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই মহাজনেরা জেলেদের হাতে বিষ তুলে দেন বলে জানান। একজন মহাজন তো প্রস্তাব দিয়েই বসেছেন বনের এলাকা মহাজনদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার। তাহলে অনিশ্চয়তা থাকবে না, বিষ ছিটিয়ে মাছও ধরতে হবে না। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের জীবিকা নষ্ট হোক, বিষে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস হোক, বিষযুক্ত মাছ খেয়ে মানুষের প্রাণ যাক, কিন্তু মহাজনদের মুনাফা ঠিক থাকা চাই!

সুন্দরবনের অসীম প্রাণশক্তি সম্পর্কে অমিতাভ ঘোষ ‘হাংরি টাইড’ উপন্যাসে যা লিখেছেন, তা বাংলা করলে দাঁড়ায় এমন, ‘কিন্তু এখানে, এই ভাটির দেশে রূপান্তরই জীবনের নিয়ম: নদীরা অবিরাম ছুটে চলছে, দ্বীপ জেগে উঠছে, আবার কদিনেই ডুবে যাচ্ছে। অন্যখানে বন পুনরুজ্জীবিত হতে শত শত বছর লাগে, এমনকি লাখ বছরও; কিন্তু বাদাবন ১০-১৫ বছরেই হারিয়ে যাওয়া দ্বীপ পুনরায় দখলে নিতে পারে। এমন কি হতে পারে যে পৃথিবীর ছন্দই এখানে দ্রুতলয়ে ঘটছে, যেন তারা [দ্বীপ] ত্বরিত গতিতে জেগে উঠতে পারে?’

প্রশ্ন হলো, প্রাকৃতিক নিয়মে হওয়া ক্ষত সুন্দরবন নাহয় নিজের প্রাণশক্তির জোরে পুষিয়ে নিল। কিন্তু মুনাফার লোভে চলা বিষের অত্যাচারও তাকে কেন পুষিয়ে নিতে হবে? রাষ্ট্রের কি কোনো দায় নেই?

খলিলউল্লাহ্‌ প্রথম আলোর জলবায়ু প্রকল্প ব্যবস্থাপক

[email protected]