ভারতে গান্ধীর নাম ছেঁটে রাম নাম, মোদির নতুন চাল

ভারতের পার্লামেন্ট চত্বরে ভিবি জি র‍্যাম জি বিলের বিরুদ্ধে বিরোধী সংসদ সদস্যদের প্রতিবাদছবি: এএনআই

এগারো বছর ধরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প থেকে বেছে বেছে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীর নাম বাদ দেওয়া হচ্ছিল। এবার নরেন্দ্র মোদির সরকারের কোপে কাটা গেল জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর নাম। টানা কুড়ি বছর ধরে যে প্রকল্প গ্রামীণ ভারতের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষদের অন্নের সংস্থান করে এসেছে, সেই ‘মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিম’, আসমুদ্রহিমাচলে যা ‘মনরেগা’ নামে পরিচিত, তা বাতিল করে দেওয়া হলো। সংসদের উভয় কক্ষে রাতারাতি পাস করানো হলো এক নতুন বিল, যেখানে গান্ধীকে সরিয়ে কৌশলে ঢোকানো হয়েছে রামের নাম।

কৌশল, কেননা নতুন এই বিলের পোশাকি নাম ‘বিকশিত ভারত: গ্যারান্টি ফর রোজগার অ্যান্ড আজীবিকা মিশন (গ্রামীণ) বিল ২০২৫’ এমনভাবে করা, যাতে ইংরেজি ও হিন্দি আদ্যক্ষরগুলো পাশাপাশি দাঁড় করালে হয় ‘ভিবি: জি রাম জি’। ‘অ্যাক্রোনিম’ এমনভাবে তৈরি, যাতে গান্ধীর পরিবর্তে ‘রাম বন্দনা’ প্রাধান্য পায়। রাম–বিরোধীদের ‘রাবণ’ আখ্যা দেওয়া সহজ। অনুমান করা যায়, হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারের জেরে ‘জি রাম জি’ অচিরেই ‘জয় রামজি’ হয়ে যাবে।

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে ‘মহাত্মা’ আখ্যা দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর জন্যই গোটা বিশ্ব তাঁকে ‘মহাত্মা গান্ধী’ বলে চেনে। মহাত্মা গান্ধীকে এভাবে ছেঁটে ফেলার মধ্য দিয়ে মোদি সরকার রবীন্দ্রনাথকেও অসম্মানিত করলেন।

 গান্ধীজি কোনোকালেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) চোখের মণি ছিলেন না। বরং তাঁর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ছিলেন সংঘ–ঘনিষ্ঠ। গান্ধী হত্যায় সংঘের হাত ও অনুমোদন ছিল। এই অভিযোগে ১৯৪৮ সালে সংঘ নিষিদ্ধ হয়েছিল। জনসংঘ, পরবর্তী সময়ে বিজেপিও কখনো গান্ধীকে মাথায় তোলেনি। চিরকাল সমালোচনাই করেছে।

মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গান্ধীকে ব্যবহার করছেন কৌশল হিসেবে। পৃথিবীর শতাধিক দেশে যাঁর মূর্তি রয়েছে, শান্তির বাণী প্রচারের জন্য যাঁর কদর, তাঁকে অস্বীকার করা বোকামি হতো। এখন মোদি এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে কেন্দ্রীয় প্রকল্প থেকে গান্ধীজিকে ছেঁটে ফেলতে তিনি দুবার ভাবেননি। কোনো দল বা রাজ্যের সঙ্গে পরামর্শ না করে, কাকপক্ষীকে জানতে না দিয়েই সংসদে ‘জি রাম জি’ পাস করালেন। তিনি জানেন, বিরোধীরা দু–চার দিনের বেশি হইচই করতে পারবে না। তাঁরও লক্ষ্য পূর্ণ হবে।

কুড়ি বছর ধরে মনরেগা গ্রামীণ দরিদ্রদের বছরে এক শ দিন কাজের নিশ্চয়তা দিয়েছে। নতুন আইন কাজ দেবে বলছে ১২৫ দিন। মনরেগার মজুরির টাকা ১০০ শতাংশ দিত কেন্দ্রীয় সরকার, ‘জি রাম জি’তে কেন্দ্র দেবে ৬০ শতাংশ, রাজ্যকে দিতে হবে ৪০ শতাংশ। ১০০ শতাংশ টাকা পাবে শুধু বিধানসভা না থাকা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলো। আর সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং হিমালয়সংলগ্ন জম্মু-কাশ্মীর, উত্তরাখন্ড ও হিমাচল প্রদেশকে দেওয়া হবে ৯০ শতাংশ।

মনরেগা কখনো মোদির পছন্দের প্রকল্প ছিল না। বরং ক্ষমতায় এসে ২০০৫ সালে মনমোহন সিংয়ের চালু করা ওই প্রকল্প বাতিল করবেন ভেবেছিলেন। তিনি মনে করতেন, ওতে গ্রামীণ সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে না। অর্থের অপচয় হচ্ছে। পরে মন বদলান। কেন বদলালেন, সে কথা ২০১৫ সালে সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় জানিয়েও ছিলেন। কংগ্রেসিদের কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘আমার রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি বলছে মনরেগা বন্ধ করা উচিত হবে না। কেননা, এই প্রকল্প কংগ্রেসের ব্যর্থতার জীবন্ত স্মারক। স্বাধীনতার ৬০ বছর পরেও আপনারা মানুষকে দিয়ে গর্ত খোঁড়াচ্ছেন।’

কিন্তু মোদি যে ভুল করেছিলেন, তা বুঝতে দেরি হয়নি। পরের বছরেই, ২০১৬ সালে নোট বাতিলের মতো হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে কাজ হারানো গ্রামে ফেরা শ্রমিকদের একমুঠো খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ওই মনরেগা। ২০১৯ সালে নির্বাচনের সময় বিরোধীরা যখন মোদিকে প্রশ্ন করত, প্রতিশ্রুতিমতো বছরে ২ কোটি চাকরি কোথায়, তখন তাঁকে বাঁচিয়েছিল মনরেগাই। শ্রম মন্ত্রণালয় বছরে ২৩৫ কোটি শ্রম দিবস তৈরির হিসাব দাখিল করেছিল।

কোভিডের সময়েও মনরেগা হয়ে উঠেছিল মুশকিল আসান। তবু মোদি ওই প্রকল্প বাতিল করে ‘জি রাম জি’ আনলেন তিনটি কারণে। এক, কংগ্রেসের আইন বাতিল করে নিজের আইন প্রণয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা। দুই. কেন্দ্রের প্রতি রাজ্যগুলোর নির্ভরতা বাড়িয়ে তাদের কেন্দ্রমুখাপেক্ষী করে তোলা। তিন. কেন্দ্রের আর্থিক বোঝা কমানো।

এগারো বছর ধরে যে যে প্রকল্পের জন্য মোদি কৃতিত্ব দাবি করেন, সেগুলোর অধিকাংশই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমলে তৈরি। নতুন বোতলে পুরোনো মদ পরিবেশনের মতো তিনি শুধু মোড়ক ও নাম বদলেছেন। এবং প্রচারের জোরে বোঝাতে চেয়েছেন, ৬০ বছরে কংগ্রেস দেশটাকে রসাতলে পাঠিয়েছে। তিনি উদ্ধারকর্তা হিসেবে আবির্ভূত। উদাহরণ অঢেল। যেমন ২০০৯ সালে মনমোহন সিং সরকারের প্রকল্প ‘নির্মল ভারত অভিযান’ হয়েছে মোদির ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’।

২০০৫ সালের ‘জিরো ব্যালান্স অ্যাকাউন্ট’–এর নাম পাল্টে করেছেন ‘জন ধন প্রকল্প’। মনমোহন সিং ২০০৬ সালে চালু করেছিলেন ‘ন্যাশনাল ই-গভর্ন্যান্স প্ল্যান’। মোদি তারই নাম বদলে করেছেন ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’। ‘স্বাবলম্বন যোজনা’র নাম দিয়েছেন ‘অটল পেনশন যোজনা’। ‘জওহরলাল নেহরু আরবান রিনিউয়াল মিশন’ নাম বদলে করেছেন ‘অটল মিশন ফর রেজল্যুশন অ্যান্ড আরবান ট্রান্সফরমেশন’, যার লক্ষ্য স্মার্ট সিটি তৈরি।

গ্রামের দরিদ্রদের জন্য পাকা বাড়ি তৈরির প্রকল্প ‘ইন্দিরা আবাস যোজনা’ চালু করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, ১৯৮৫ সালে। মনমোহন সিং শহুরে দরিদ্রদের জন্য ২০১১ সালে চালু করেন ‘রাজীব আবাস যোজনা’। মোদি দুটিরই নাম পাল্টে করেছেন ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’। ‘রাজীব গান্ধী গ্রামীণ বিদ্যুতিকরণ যোজনা’র নাম দিয়েছেন ‘দীনদয়াল উপাধ্যায় গ্রাম জ্যোতি যোজনা’।

২০১১ সালে মনমোহন সিং চালু করেছিলেন ‘ন্যাশনাল ম্যানুফ্যাকচারিং পলিসি’। মোদি তারই নাম দিয়েছেন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’। ওই বছরেই কংগ্রেস সরকার চালু করেছিল ‘ন্যাশনাল অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক’, যাতে গ্রামে গ্রামে ব্রডব্যান্ড সংযোগ পৌঁছে দেওয়া যায়। মোদি সেটারই নাম দিয়েছেন ‘ভারত নেট’। ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন মিশন’–এর নাম দিয়েছেন ‘স্কিল ইন্ডিয়া’। মনমোহনের ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস’ কর্মসূচিই মোদির ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ প্রকল্প। মনরেগা ছিল কংগ্রেসের জনপ্রিয়তম প্রকল্প। এবার সেটারও দখল নিলেন তিনি।

কুড়ি বছর ধরে মনরেগা গ্রামীণ দরিদ্রদের বছরে এক শ দিন কাজের নিশ্চয়তা দিয়েছে। নতুন আইন কাজ দেবে বলছে ১২৫ দিন। মনরেগার মজুরির টাকা ১০০ শতাংশ দিত কেন্দ্রীয় সরকার, ‘জি রাম জি’তে কেন্দ্র দেবে ৬০ শতাংশ, রাজ্যকে দিতে হবে ৪০ শতাংশ। ১০০ শতাংশ টাকা পাবে শুধু বিধানসভা না থাকা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলো। আর সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং হিমালয়সংলগ্ন জম্মু-কাশ্মীর, উত্তরাখন্ড ও হিমাচল প্রদেশকে দেওয়া হবে ৯০ শতাংশ।

এতকাল মনরেগার চরিত্র ছিল চাহিদানির্ভর। রাজ্যের চাহিদা অনুযায়ী কাজ হতো। কেন্দ্র টাকা দিত। নতুন আইনে কোন রাজ্যের কোন জেলায় কী ধরনের কাজ করানো হবে, তা ঠিক করে দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্য নয়। এর মধ্য দিয়ে কেন্দ্রের ওপর রাজ্যগুলোর নির্ভরতা বাড়িয়ে দেওয়া হলো।

রাজস্বের অভাবে দেশের অধিকাংশ রাজ্যই ধুঁকছে। ৪০ শতাংশ বাড়তি বোঝা চাপানোর অর্থ প্রকল্পটির আঁতুড়েই মৃত্যু। মোদি এটাই চাইছিলেন। ১০০ দিনের কাজের জন্য বরাদ্দ ২০২১ সালে ছিল ১ লাখ ১১ হাজার কোটি রুপি। তা কমিয়ে ৮৫ হাজার করেছেন। রাজ্যের বকেয়া ৯ হাজার কোটি রুপি। নতুন আইন কাজ দেবে ১২৫ দিন, বরাদ্দ ওই ৮৫ হাজার কোটি!

কুড়ি বছর ধরে গ্রামীণ দরিদ্রদের কাছে যা ছিল অক্সিজেনতুল্য, তার অপমৃত্যুর ধাক্কা সামলানো কঠিন। সম্মিলিত বিরোধিতা মোদিকে কৃষি আইন প্রত্যাহারে বাধ্য করেছিল। গ্রামীণ দরিদ্রদের অভিসম্পাত সওয়া কিন্তু সহজ নয়।

  • সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি

    মতামত লেখকের নিজস্ব