ভাইরাল ইমাম ওয়ালিদ মেহসাসকে যে কারণে অভিবাদন জানাতে হয়

নামাজের সময় গায়ে উঠে পড়ার পরও বিড়ালটিকে না তাড়িয়ে তাকে যত্নের সঙ্গে ধরে রেখে শান্তভাবে নামাজ চালিয়ে গেছেন ইমাম ওয়ালিদ মেহসাস
ছবি: সংগৃহীত

ওয়ালিদ মেহসাসের নামাজের ভিডিও বিশ্বজুড়ে বহুজনকে নাড়া দিয়েছে। বিপুল প্রশংসা ও শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন তিনি। আলজেরিয়ার সরকারও তাঁকে বিরল এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংবর্ধনা দিয়েছে। এসবই ঘটল তারাবিহর নামাজ পড়া অবস্থায় একটা বিড়ালের প্রতি তাঁর মহব্বতের কারণে।

যাঁরা সেই ভিডিও দেখেছেন, তাঁরা জানেন, নামাজের সময় গায়ে উঠে পড়ার পরও বিড়ালটিকে না তাড়িয়ে তাকে যত্নের সঙ্গে ধরে রেখে শান্তভাবে নামাজ চালিয়ে গেছেন ইমাম ওয়ালিদ মেহসাস।

ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী মুসলমান ও অমুসলমান—উভয় তরফ থেকে এ নিয়ে বহু প্রশংসাবাক্য লেখা হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত হচ্ছে। এসব আলোচনায় প্রাণীর প্রতি একজন মুসলমানের সহৃদয়তার কথাই কেবল বলা হচ্ছে না—ইসলাম নিয়ে অনেকের ভুল ধারণা ও জিজ্ঞাসারও ইতিবাচক ফয়সালা হচ্ছে। এ রকম আলোচনায় অংশ নিয়ে কেউ কেউ জানতে চেয়েছেন—আলজেরিয়ার এই ইমামের ভিডিওটি কি প্রাণীদের সম্পর্কে মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় অবস্থান প্রকাশ করছে? নাকি এটা একজন ব্যক্তির দয়ার ব্যক্তিগত নজিরমাত্র?  

আরও পড়ুন

কয়েক দিন ধরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে মতামত ও বিতর্ক পড়ছি, আর মনে পড়ছে ঢাকার নূরজাহান রোডে আমার বিড়ালগুলোর কথা। বিড়াল পোষতে গিয়ে আমি প্রথম বুঝতে শিখি ঢাকা কতটা নিষ্ঠুর শহর। বিশেষ করে, মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণ-প্রকৃতির জন্য এ শহর বিপজ্জনক এক জায়গা হয়ে গেছে। এটা হয়তো এই শহরের মূল প্রজাতির নিরাপত্তাহীনতারই আরেক ধরনের প্রকাশ!

ঢাকায় অনেকেই বিড়াল পোষেন এবং সেটা মূলত ঘরে—যাকে আমরা বলি ‘প্রাণী পোষা’। আমি একটা দিয়ে শুরু করেছিলাম—ক্রমে সংখ্যা বাড়ছিল এবং সব কটিকে ‘পোষ্য’ না বানিয়ে ঘরের বাইরে উন্মুক্ত চলাচলে উৎসাহিত করতাম। কেবল সময় মেনে ডাকাডাকি করে খেতে দিতে চেষ্টা করতাম। নির্দিষ্ট সময়ে খাবারের জন্য ওরা আমার জানালার বাইরে এসে দাঁড়াত। আমি বাড়িতে না থাকলে ক্ষুধা নিয়ে ঘুরে বেড়াত। রাতে দুপুরের গাফিলতির জন্য ব্যাপক অভিযোগও করত। কিন্তু মূলত যেটা বলতে চাইছি—বিড়ালগুলোকে আমি কম দিনই অক্ষত পেতাম।

সারা দিনই তাদের কেউ ঢিল ছুড়ত, কেউ গরম পানি ছুড়ে দিত, ধারালো জিনিস দিয়েও অনেকে অযথাই বাড়ি মারত, কপট ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে কেউ কেউ আমার অবর্তমানে মিঁও মিঁও শব্দ শুনে পচা দুর্গন্ধযুক্ত খাবার দিত—তাতে আশপাশটা নোংরাও হতো এবং বিড়ালগুলো সেসব খেয়ে বমি করত।

বিড়ালের প্রতি আদিখ্যেতা নিয়ে নিয়মিত হাসিঠাট্টাও শুনতাম আশপাশ থেকে। ফ্ল্যাট সারির চিপা দিয়েও যাতে বিড়াল চলাচল করতে না পারে, সে জন্য তারের বেড়াও বসাতেন বাড়িওয়ালারা। তুমুল বর্ষা বা প্রচণ্ড গরমে বিড়ালগুলো আশ্রয়ের জন্য খুব কম জায়গাই পায় এই উন্নত শহরে। এটা এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা যে এ রকম এক পরিবেশের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত ওই বিড়ালের সব কটি মারা পড়েছিল।

আরও পড়ুন

জীবিত অবস্থায় তাদের চোখেমুখে সব সময় আতঙ্ক দেখেছি আমি। এ আতঙ্ক বলে দিচ্ছিল, এ শহরে কিংবা এ দেশের অন্যত্র মানুষ যেন প্রজাতি হিসেবে অন্য প্রাণীর সঙ্গে তার সম্পর্কটি আজও ঠিক করে উঠতে পারেনি, যেখানে সেও বাঁচবে, অন্যরাও মরবে না।

আমরা অনেকেই জানি, ‘প্রাণীকল্যাণ আইন’ বলে ২০১৯-এ তৈরি একটা জিনিস আছে এ দেশে। তবে প্রাণীদের নিরাপত্তা আইন দিয়ে কায়েম হওয়ার নয়—সেটা নির্ভর করে মানুষের বিবেকের ওপর। আর ‘কল্যাণে’র দাবি তো অনেক পরের বিষয়, বাংলাদেশের প্রাণীরা ন্যূনতম নিরাপত্তা পাওয়ার জায়গায়ও নেই অনেক ক্ষেত্রে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কুকুরের প্রতি নির্মমতা বিড়াল সমাজের চেয়ে বহু গুণ বেশি এ দেশে। যদিও তুলনামূলকভাবে বিড়ালের চেয়ে কুকুর বেশি ‘অনুগত’ ও ‘উপকারী’। পাউরুটির সঙ্গে বিষ মিশিয়ে গণহারে কুকুর হত্যার একটা সংবাদ গত বছর হয়তো অনেকেই পত্রিকায় দেখেছেন।

কুকুর সম্পর্কে নানান অভিমত আছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে। ফলে তাদের প্রতি আচরণেও নানান তারতম্য আছে। অটোমান মিসরে প্রাণীর প্রতি আচরণ নিয়ে ইতিহাসবিদ এলেন মিখাইলের চমৎকার একটা বই আছে ‘দ্য অ্যানিমেল ইন অটোমান ইজিপ্ট’ (অক্সফোর্ড, ২০১৭)। কুকুর কীভাবে সামাজিক অর্থনীতির বড় অংশীদার ছিল, সেটা তথ্য-উপাত্তসহ বিস্তারিতভাবে লিখেছেন তিনি। প্রাণীদের প্রতি আচরণের এ রকম পরিবর্তন ধারা হয়তো বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের ইতিহাসেও আছে।

দূরদূরান্তের এত সব বিবরণ না বাড়িয়ে অতি কাছের একটা অভিজ্ঞতা না বললেই নয়। ঢাকার কারওয়ান বাজারে বন্ধু জাভেদ হুসেনকে তিনটি কুকুর রাতের বেলায় অফিস থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত কয়েক মিনিটের পথ স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে যে নিয়মিত এগিয়ে দেয়, সেটা একাধিকবার স্বচক্ষে দেখে কেবল ভেবেছি, এসব প্রাণীকে আমরা হয়তো কমই জানি।

ওয়ালিদ মেহসাস হয়তো আমাদের এ নিয়ে আরও ভাবতে উসকে দিলেন। পবিত্র কোরআনে প্রাণীদের মধ্যে যে সৌন্দর্য ও ঔজ্জ্বল্যের কথা বলা হয়েছে (সুরা নাহল; ৬,৮) এবং এসব প্রজাতির পৃথক সত্তার যে স্বীকৃতি রয়েছে (সুরা আন’আম; ৩৮) ওয়ালিদ মেহসাসের আচরণ ছিল তার প্রতি গভীর আনুগত্যময়। এ ইমাম সাহেবকে সুদূর বাংলাদেশ থেকে ধন্যবাদ।

মানুষ ও অন্য প্রাণীরা যদি প্রজাতি হিসেবে পৃথক হয়, তাহলে পরস্পরের সম্পর্ক নিশ্চয়ই একতরফা আধিপত্যধর্মী এবং অত্যাচারময় হওয়ার কথা নয়।

  • আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক