রংপুরে হাতপাখার ঝাপটায় জামানত হারাতে হলো নৌকাকে!  

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণে ছিল ভোটারদের বিপুল উপস্থিতি। ভোট শুরুর আগে থেকেই দেখা যায় মানুষের দীর্ঘসারি। রংপুর নগরের আলমনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে তোলা। ২৭ ডিসেম্বর।
ছবি: মঈনুল ইসলাম

রংপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নৌকা ভাসাতে পারবে, দলের অন্ধ সমর্থক ছাড়া এ কথা কেউ ভাবেননি। কিন্তু নৌকার পরাজয় যে এতটা করুণ ও বিষাদগ্রস্ত হবে, তা–ও অনেকের কল্পনার বাইরে ছিল। দ্বিতীয়বারের মতো রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান।

গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত সোয়া ১২টায় ২২৯টির কেন্দ্রের সব কটির ফলাফল ঘোষণা করা হলে দেখা যায়, লাঙ্গল প্রতীকের এই প্রার্থী পেয়েছেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী (হাতপাখা প্রতীক) আমিরুজ্জামান।

তিনি পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) লতিফুর রহমান ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা (ডালিয়া) ২২ হাজার ৩০৬ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন।

এর অর্থ, আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসেননি, এমনকি জামানত হারিয়েছেন। লাঙ্গল প্রতীকধারী জাতীয় পার্টির প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা প্রার্থীর। এই নির্বাচনে তৃতীয় অবস্থানে আছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী।

যদিও প্রচারকালে আওয়ামী লীগের নেতারা নৌকা উন্নয়নের প্রতীক বলে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সচেষ্ট ছিলেন। ফলাফলে দেখা গেল, লাঙ্গলের সঙ্গে লড়াই করবে কি, হাতপাখার ঝাপটায় কুপোকাত নৌকা।

আওয়ামী লীগের অতিবিজ্ঞ নেতারা বিরোধী দলের নিরীহ কর্মসূচিতেও ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত দেখেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ৩০ ডিসেম্বর বিএনপির গণমিছিল কর্মসূচি চক্রান্তেরই অংশ। বিরোধী দলকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতে দিলে সরকারের বিরুদ্ধে কেউ চক্রান্ত করতে পারে না। বরং বিরোধী দলকে কথা বলতে না দিলে দেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। এবং সেই সুযোগে চক্রান্তকারীরা অঘটন ঘটায়।

ভুল মনোনয়নই আওয়ামী লীগের ভরাডুরির একমাত্র কারণ নয়। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের ওপর ক্ষমতাসীন দল যে চাপ সৃষ্টি করে আসছে, রংপুরের মানুষ তা ভালোভাবে নেননি। তাঁরা মনে করেছেন, সরকারি দল তাদের প্রয়োজনে জাতীয় পার্টিকে কাছে টেনে নেয়, আবার যখন প্রয়োজন থাকে না দূরে ঠেলে দিতেও দ্বিধা করে না।

আওয়ামী লীগের যে নেতারা কথায় কথায় বিরোধী দলের মধ্যে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র খোঁজেন, তাঁরা কি একবার রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখবেন? কেন এই ভরাডুবি? রংপুরের নাগরিক সমাজের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এই ফলাফলের পেছনে লাঙ্গল ও হাতপাখা প্রার্থীর কৃতিত্ব তেমন নেই; যতটা মানুষের ক্ষোভ আছে নৌকার প্রতি। অথচ, ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমদ ভালো ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন।

রংপুরে বিএনপি সব সময়ই দুর্বল ছিল। সেখানে স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো নৌকা ও  লাঙ্গলের মধ্যে। যেটিতে লাঙ্গল জিতত, নৌকা দ্বিতীয় হতো। যেটিতে নৌকা জিতত সেটাতে লঙ্গল দ্বিতীয় হতো।এবারে আরও দুই ধাপ পিছিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধারেকাছেও নেই।

কেন এমনটি হলো? মঙ্গলবার ভোট চলাকালেই প্রথম আলোর রংপুর প্রতিনিধি আরিফুল হকের সঙ্গে কথা হয়। ভোট পরিস্থিতি কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গতবারের মতো এবারও লাঙ্গলের জয়জয়কার।’

তাই বলে আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবে না? রংপুরের নেতা-কর্মীদের মতে, আওয়ামী লীগের মনোনয়নই ভুল ছিল। হোসনে আরা লুৎফা একসময় রংপুরে আইনপেশায় যুক্ত থাকলেও গত সংসদে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে ঢাকায় থাকেন। দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁর সংযোগ কম। মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

তাঁদের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রায় ৩৪ হাজার ভোট পেয়েছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অনেক সময় ভাবেন, তাঁরা যাকে মনোনয়ন দেবেন, জনগণ তাঁকেই ভোট দেবে। মানুষ এখন দলের প্রতীকের চেয়ে এলাকার মানুষের সঙ্গে প্রার্থীর যোগাযোগকে গুরুত্ব দেয়; তিনি যে দলেরই হোন না কেন?

তবে ভুল মনোনয়নই আওয়ামী লীগের ভরাডুরির একমাত্র কারণ নয়। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের ওপর ক্ষমতাসীন দল যে চাপ সৃষ্টি করে আসছে, রংপুরের মানুষ তা ভালোভাবে নেননি। তাঁরা মনে করেছেন, সরকারি দল তাদের প্রয়োজনে জাতীয় পার্টিকে কাছে টেনে নেয়, আবার যখন প্রয়োজন থাকে না দূরে ঠেলে দিতেও দ্বিধা করে না।

আরও পড়ুন

তাঁরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ একটানা যে ১৪ বছর ক্ষমতায় আছে, তার পেছনে জাতীয় পার্টির ‘অবদানই’ বেশি। আমাদের দ্বিকেন্দ্রিক জাতীয় রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি যেদিকে থাকে, সেদিকেই পাল্লা ভারী হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা যে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকেও ব্রাকেটবন্দী করে নিজেদের গণতন্ত্রের একমাত্র সিপাহশালার হিসেবে জাহির করেন, তা–ও তার সমর্থকেরা ভালোভাবে নেননি।

এর আগে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকা জয়কে সরকারের প্রভূত সাফল্য বলে দাবি করেছিল। কিন্তু বিএনপির দুই বিদ্রোহী প্রার্থীর সম্মিলিত ভোট হিসাব করলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অনেক কম ভোট পেয়েছেন। নির্বাচন তো কৌশলের খেলা। যে কৌশলেই হোক, আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। কিন্তু রংপুরে এমন নৌকাডুবি হলো কেন?

তাহলে কি গত ছয় মাসে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অরও কমে গেছে? কোনো দলের জনপ্রিয়তা মাপার যন্ত্র হলো নির্বাচন। কিন্তু বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হওয়াটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনো দল নির্বাচনে না এলে আমাদের কী করার আছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা হলো সবচেয়ে ঠুনকো যুক্তি। অবশ্যই করার আছে।

যে পরিস্থিতিতে এখন বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে চলেছে, তার চেয়ে অনেক অনুকূল পরিবেশেও আওয়ামী লীগ অতীতে নির্বাচনী লড়াই থেকে বাইরে থেকেছে। উদাহরণ হিসেবে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথা বলা যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভূমিধস বিজয়ের পর ২০০২ সালে ঢাকা সিটির যে নির্বাচন হয়, তাতে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থীই দেয়নি। সেই সময়ে আওয়ামী লীগের কৌশল যদি ন্যায্য হয়ে থাকে, এখন বিএনপির ভোট বর্জন অন্যায্য হবে কেন?

নির্বাচন কমিশন যে ইভিএমে ভোট করার মতো দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে, রংপুর সিটি নির্বাচনে সেটি আবারও প্রমাণিত হলো। প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়: নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দিতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে ভোটারদের। এর আগে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ভোগান্তি হলেও মঙ্গলবার রংপুরে তা সব ‘রেকর্ড’ ছাড়িয়ে যায়। ইভিএমে জটিলতার কারণে নির্ধারিত সময়ের সাড়ে তিন ঘণ্টা পর রাত আটটা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলে।

ভোটার উপস্থিতি বেশি হওয়ায় এবং অনেকের আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোট গ্রহণে ধীরগতি হয়েছে বলে জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল বিকেলে ভোট গ্রহণের নির্দিষ্ট সময় (বিকেল সাড়ে ৪টা) শেষে রাজধানীতে নির্বাচন ভবনে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, রংপুর সিটি নির্বাচন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ হয়েছে।

ভোটার উপস্থিতি ব্যাপক ছিল। রংপুর সিটি করপোরেশনের ২০১৭ সালের নির্বাচনে মাত্র একটি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট নেওয়া হয়েছিল। আর এবার ২২৯টি কেন্দ্রের ১ হাজার ৩৪৯টি বুথের সব কটিতেই ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হয়।

ইভিএম ত্রুটি নিয়ে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন যে মন্তব্য করেছেন, সেটি কেবল অসৌজন্যমূলক নয়, অমার্জনীয়ও। তিনি বলেছেন, ‘ইভিএমকে বিতর্কিত করতে জাপা প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান ভোট দিতে না পারার “সিনক্রিয়েট” করেছেন।’ মোস্তাফিজার রহমান সকাল ৯টার দিকে নগরের আলমনগর কলেজ রোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রে ভোট দিতে যান। ভোট কক্ষে প্রায় ১৫ মিনিট অবস্থান করেও ভোট দিতে না পেরে বাইরে চলে যান।

সাংবাদিকদের সামনে ইভিএম নিয়ে হতাশা ও অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখি ইভিএম হ্যাং হয়েছে। আমি ১৫ মিনিটের মতো অপেক্ষা করেও ভোট দিতে পারিনি। এই যদি ইভিএমের অবস্থা হয়, তাহলে মানুষ ভোট দেবে কীভাবে?’

এই নির্বাচনী কর্মকর্তা এ কথা বলার দুঃসাহস দেখালেন কীভাবে? তার খুঁটির জোর যত থাকুক না কেন, একজন জনপ্রতিনিধি সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলতে পারেন না।

নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে প্রার্থী বা ভোটারদের ওপর দায় চাপাবেন, এটা মেনে নেওয়া যায় না। রংপুর সিটি নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে যা ঘটেছে, এরপর নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে ইভিএম মাথা থেকে ঝেরে ফেলা।

আওয়ামী লীগ নেতারা কথায় কথায় বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অভিযোগ আনেন। যদি সত্যি সত্যি কেউ চক্রান্ত করে থাকেন, তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্যই সরকার ব্যবস্থা নেবে।

কিন্তু যে ঘটনা ঘটেনি, কিংবা মামলার বাদীও কিছু জানেন না, সেই মামলায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীর হাতে কড়া ও পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে ঘোরালে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি না হয়ে পারে না। রংপুর সিটি নির্বাচনে সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলেও অনেকে মনে করেন।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি

    ইমেইল: [email protected]