আরাকান আর্মির হাতেই কি রাখাইনের ভবিষ্যৎ

চিন স্টেটের প্যালেটোয়া ও উত্তর আরাকানের ১০টি শহর আরাকান আর্মি দখলে নিয়েছেছবি: ইরাবতী নিউজ

দ্বিতীয়বারের মতো রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে তাতমাদোর (মিয়ানমার সামরিক বাহিনী) বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আরাকান আর্মির হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ৩ সদস্য ও ১৭৯ জন বিজেপি (বর্ডার গার্ড পুলিশ) সদস্য বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করেছেন। এই লেখা যখন লিখছি, তখনো তাঁদের ফেরত পাঠানো হয়নি।

তবে জানা গেছে, পাঠানোর প্রক্রিয়ায় অপর পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে সিত্তে (রাখাইনের রাজধানী) থেকে মাত্র ৬৫ কিলোমিটার উত্তরে এবং বুথিডং ও মন্ডাডো থেকে দক্ষিণের জনপদ রথিডংয়ের পতন হয়েছে। বর্তমানে উত্তর রাখাইনের বাকি বড় দুটি জনপদ বুথিডং ও মন্ডাডো অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। লক্ষণীয় যে বিজেপির যে ১৭৯ সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে আত্মসমর্পণ করেছেন, তাঁদের কর্মস্থল ছিল মন্ডাডো।

আরাকান আর্মি যেকোনো গেরিলাযুদ্ধের নিয়ম বিবেচনায় নিয়েই তাদের ছক তৈরি করেছে। যে কারণে উপরিউক্ত দুই জায়গায় তাতমাদোর অবস্থান শক্ত হওয়ায় ওই এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য তারা ঘিরে রেখেছে বলে জানা যায়।

আরও পড়ুন

এই কৌশলের কারণেই বাংলাদেশে প্রবেশ করা ছাড়া পিছপা বা পশ্চাদপসরণের আর কোনো পথ ছিল না। তবে বুথিডং থেকে পশ্চাদপসরণের পথ শুধু বঙ্গোপসাগর। এককথায় এ পর্যন্ত চিন স্টেটের গুরুত্বপূর্ণ শহর প্যালেটোয়া ও উত্তর আরাকানের রথিডংসহ ১০টি শহর আরাকান আর্মি দখলে নিয়েছে। 

ধারণা করা হচ্ছে, এভাবে এগোতে থাকলে এ বছরের মধ্যেই হয়তো উত্তর-রাখাইন তাতমাদোমুক্ত হতে পারে এবং উত্তর রাখাইন দখল করতে পারলে তা হবে দক্ষিণ রাখাইন দখলের স্প্রিং বোর্ড। আপাতদৃষ্টে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে মন্ডাডো আর বুথিডং দখল হলে আরাকান আর্মি অপ্রতিরোধ্য হয়ে যাবে। আরাকান রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যা বাংলাদেশ, রাখাইন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বৃহত্তর মিয়ানমারের ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কিত।

বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরাকান বা রাখাইন রাজ্যের দুটি পথ হচ্ছে বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মি—দুই পক্ষের জন্যই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সেন্ট মার্টিনের অবস্থানের কারণে উত্তর বঙ্গোপসাগরের অধিকাংশ এলাকাই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে পড়ে। কাজেই ভবিষ্যতে রাখাইন রাজ্যকে অনেকটাই বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে।

তবে আরাকান আর্মি এবং এর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের আগামী দিনের চিন্তাভাবনা কী, তার ওপর বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করবে। এখানে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে, আরাকান আর্মির তৎপরতার লক্ষ্য কি মিয়ানমার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া, নাকি বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন অর্জন করা। এখন পর্যন্ত আরাকান আর্মির ঘোষিত লক্ষ্য আরাকানের স্বায়ত্তশাসন। তাদের লক্ষ্য এই দুটির যা–ই হোক না কেন, আরাকানকে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, আরাকান আর্মি ভবিষ্যতে আরাকানের সব জাতিগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ সহাবস্থানের জায়গা তৈরি করতে পারবে কি না? এটা তাদের অবশ্যই পারা উচিত। কারণ, এটা না করতে পারলে তাদের দীর্ঘদিনের সশস্ত্র সংগ্রাম অর্থহীন হয়ে পড়তে পারে।

আরাকানবাসীকে মনে রাখতে হবে যে হাজার বছর ধরে ‘রোহিঙ্গা’ জনগোষ্ঠী রাখাইনের বাসিন্দা। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সরকার ডিভাইড ও রুলের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করে রেখেছে। রোহিঙ্গা ছাড়াও সেখানে রয়েছে কাজান মুসলমান, চাকমা, হাজং এবং ম্রো জাতি। ভবিষ্যৎ রাখাইনের স্থিতিশীলতা নির্ভর করবে যত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীই হোক না কেন, সবাইকে নিয়ে একটি বহুজাতিক রাজ্য গড়ে তোলার ওপর।

আরও পড়ুন

আরাকান আর্মি, ইউএলএ ও রাখাইনবাসীকে এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হবে যে কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরাকানে যে জাতিগত বিভেদ তৈরি করে রেখেছে, তাতে আরাকানের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং রাজ্যটি তার শক্তি ক্ষয় করেছে। ধারণা করা যায়, আরাকান আর্মি ও ইউএলএ প্রধান জেনারেল ওয়াং ম্রা নাইং যেহেতু নিজে অনেক চড়াই–উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছেন, তাই ভবিষ্যৎ রাখাইন নিয়ে অবশ্যই তাঁর ভাবনা রয়েছে। 

তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যৎ রাখাইন নিয়ে সেখানকার সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের চিন্তাভাবনা আসলে কী? এটা শুধু বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদেরই বিষয় নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও তাদের নেতাদেরও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, এটাই তাদের পূর্বপুরুষের দেশ ও মাটি। নিজেদের শুধু রোহিঙ্গা নয়, একই সঙ্গে আরাকানিও ভাবতে হবে। ভাবতে হবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের সামনে কী কী পথ ও সম্ভাবনা খোলা রয়েছে। 

রোহিঙ্গাদের সামনে খুব বেশি পথ রয়েছে বলে মনে করি না। ইতিহাস নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না, তবে রোহিঙ্গাদের ১৯৪০ ও ১৯৪২ থেকে অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে। ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে। এ সময়ে যখন আরাকানবাসী তাতমাদোর বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তখন অবশ্যই রোহিঙ্গাদের তাদের সহায়ক হতে হবে। শুধু মৌন সমর্থনই নয়, বরং সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিতে হবে। নিজেদের মধ্যের বিবাদ ভুলে আরাকান আর্মির সহায়ক হওয়া ছাড়া তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আরাকানিদের সঙ্গে এই কঠিন সময়ে একাত্ম না হলে রোহিঙ্গারা ‘রাজাকার’ হিসেবে বিবেচিত হবে।

রোহিঙ্গাদের দিয়ে আরাকানে আরেকটি গৃহযুদ্ধ বাধানোর চেষ্টা মিয়ানমার সেনাবাহিনী করবে এবং সেটা তারা করছেও। এ বিষয়ে রোহিঙ্গাদের সতর্ক থাকতে হবে। রোহিঙ্গা নেতাদের এক হয়ে পথ ঠিক করতে হবে এবং আরাকান রাজ্যের স্বায়ত্তশাসন অর্জনে আরাকান আর্মির তথা আরাকানিদের এই সংগ্রামে একাত্ম হতে হবে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে রোহিঙ্গারা জাতি হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।

রোহিঙ্গাদের সামনে অন্য যে পথ খোলা রয়েছে, তা হলো মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা তাতমাদোকে সমর্থন দেওয়া। এমন কোনো অবস্থান হবে আত্মঘাতী। রোহিঙ্গাদের সামনে কঠিন সময় সন্দেহ নেই। রোহিঙ্গাদের দিয়ে আরাকানে আরেকটি গৃহযুদ্ধ বাধানোর চেষ্টা সেনাবাহিনী করবে এবং সেটা তারা করছেও।

এ বিষয়ে রোহিঙ্গাদের সতর্ক থাকতে হবে। রোহিঙ্গা নেতাদের এক হয়ে পথ ঠিক করতে হবে এবং আরাকান রাজ্যের স্বায়ত্তশাসন অর্জনে আরাকান আর্মির তথা আরাকানিদের এই সংগ্রামে একাত্ম হতে হবে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে রোহিঙ্গারা জাতি হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। 

আগেই বলেছি, বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র দেশ, যার সঙ্গে আরাকান বা রাখাইনের অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে। রাখাইনের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য এবং আগামী দিনে রাখাইনের বাংলাদেশকে প্রয়োজন হবেই, যেমন হয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দীতে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহর সময়। ওই সময় স্বাধীন আরাকানের মুদ্রায় বাংলার সুলতানি প্রভাব দেখা যায়, যা এখন রাখাইনের ইতিহাসের অংশ।

অপর দিকে ভবিষ্যৎ রাখাইনের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন কী হবে, তা নিয়ে বাংলাদেশকে এখন থেকেই চিন্তাভাবনা করতে হবে। রাখাইন যদি মিয়ানমারের একটি অধিক স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে পরিণত হবে, তবে এর সঙ্গে কূটনৈতিক যোগসূত্রের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।

মিয়ানমার যেমন চীনের পররাষ্ট্রনীতিতে জানালা হিসেবে বিবেচিত, তেমনি আমি মনে করি, রাখাইন রাজ্যও বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারসহ পূর্বের দরজা হতে পারে। কাজেই রাখাইনের সঙ্গেও বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কী করা উচিত, তা আমাদের কূটনীতিবিদ ও নেতাদের ভাবতে হবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বলা হয় যে প্রতিবেশী বদলানো যায় না, কিন্তু নীতির বদল হয় নানা ভূরাজনৈতিক বিবেচনায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, এ অঞ্চলে এক বিশাল ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ) 

[email protected]