মদিনা মুনাওয়ারা দর্শনের অসীম ফজিলত

ইসলামের প্রচার-প্রসার ও ইসলামি শক্তির ভরকেন্দ্র এবং ইসলামের বিজয়ের উৎসস্থল হলো মদিনা মুনাওয়ারা। রাসুলে আকরাম (সা.) জন্মভূমি মক্কা মুকাররমা থেকে হিজরত করে মদিনায় যাওয়ার আট বছর পর মক্কা বিজয় হলেও তিনি আর স্থায়ীভাবে মক্কায় অবস্থান করেননি। তিনি আবার মদিনায় ফিরে যান, সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হন। তাই ইসলামের ইতিহাসে এবং মুসলমানদের কাছে মদিনার মর্যাদা, মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি।

‘মদিনা’ মানে মহানগর, ‘তয়্যবা’ বা ‘তয়বা’ অর্থ পবিত্র বা উত্তম। ‘মদিনা তয়্যবা’ অর্থ পবিত্র নগর, যা ‘মদিনাতুর রাসুল’ বা ‘রাসুল নগর’; ‘মদিনাতুন নবী’ অর্থাৎ ‘নবীর শহর’, সংক্ষেপে ‘মদিনা’ নামে সর্বাধিক পরিচিত। এটি পরবর্তীকালে ‘মদিনা মুনাওয়ারা’ তথা ‘আলোক শহর’ বা আলোকিত নগর হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মদিনায় যাওয়া ও নবীজি (সা.)-এর রওজা শরিফ জিয়ারত করা হজের বিশেষ একটি ওয়াজিব।

তৎকালীন মদিনাবাসী বিভিন্ন গোত্রের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে ছিল। সেই সংঘাত নিরসনে সব ধর্ম ও গোত্রের লোকের স্বতঃস্ফূর্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে নবুয়তের ১৩তম বছরে প্রিয় নবী (সা.) আল্লাহর নির্দেশে মদিনায় হিজরত করেন। সবাই তাঁকে শান্তির দূত হিসেবে মেনে নেন। হিজরতের পর মদিনায় প্রথম নির্মাণ করা হয় মসজিদে কোবা। মসজিদে জুমুআ হলো মদিনার প্রথম জামে মসজিদ। মদিনার প্রধান মসজিদ হলো ‘মসজিদে নববি’ যা মদিনা শরিফ নামেই পরিচিত। পবিত্র মক্কার পর এটি শ্রেষ্ঠ স্থান। মসজিদে নববিতে এক রাকাত নামাজের সওয়াব ৫০ হাজার রাকাতের সমান।

প্রিয় নবীজি (সা.)-এর কবর মদিনায় অবস্থিত। একে মাকবারা শরিফ বা রওজা মোবারক বলা হয়। মদিনার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান নবীজি (সা.)-এর রওজা শরিফ। হজরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরার মধ্যে তাঁর পবিত্র কবর। তাঁরই পাশে একটু পেছনে হজরত আবুবকর (রা.) এবং আরেকটু পেছনে হজরত উমর (রা.)-এর কবর। এটি বর্তমানে মসজিদে নববির অন্তর্গত। রওজা শরিফের ওপর সবুজ গম্বুজ অবস্থিত। তার পাশেই মসজিদে নববির মিহরাবের ওপরে রয়েছে সাদা গম্বুজ।

নবীজি (সা.)-এর রওজা শরিফ জিয়ারতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওফাতের পর আমার রওজা মোবারক জিয়ারত করল, সে যেন আমাকে আমার জীবদ্দশায় দর্শন করল।’ (বায়হাকি) ‘যে আমার রওজা জিয়ারত করল, তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল।’ (ইলমুল ফিকহ, আসান ফিকাহ, পৃষ্ঠা: ২৫০) ‘যে হজ করল, কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করল না; সে আমার প্রতি জুলুম করল।’ (দারু কুতনি) আল্লামা ইউসুফ ইসলাহি (রা.) লিখেছেন, ‘হাজি সাহেবদের রওজা শরিফ জিয়ারত করা ওয়াজিব।’ (আসান ফিকাহ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৪৬-২৫১)

মসজিদে নববির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের প্রবেশপথকে বাবুস সালাম বলা হয়। মসজিদে নববির পূর্ব পাশের বহির্গমন দরজাকে বাবে জিবরাইল বলা হয়। রওজা শরিফ এবং এর থেকে পশ্চিম দিকে রাসুলে করিম (সা.)-এর মিম্বর পর্যন্ত স্থানকে রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগিচা বলা হয়। এটি দুনিয়ায় একমাত্র জান্নাতের অংশ। এ স্থানে ধূসর সাদাটে কার্পেট বিছানো থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার রওজা ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানে বেহেশতের একটি বাগিচা বিদ্যমান।’ এখানে প্রবেশ করা মানে জান্নাতে প্রবেশ করা।

রিয়াজুল জান্নাতে ছয়টি বিশেষ ঐতিহাসিক খুঁটি বা খাম্বা রয়েছে। প্রথম দিকে হুজুরে আকরাম (সা.) একটি খেজুরগাছের খাম্বার সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জুমার খুতবা দিতেন। যখন মিম্বর বানানো হলো, তখন তিনি মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। এ অবস্থায় এই খাম্বা রাসুলের বিচ্ছেদযন্ত্রণায় কান্না শুরু করে। মসজিদের সব লোক স্তম্ভিত হয়ে যান। হুজুর (সা.) মিম্বর থেকে নেমে এসে খাম্বার গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিলে সেটি শান্ত হয়। পরে সে খাম্বাকে দাফন করা হয়। এটির নাম উস্তেয়ানা হান্নানা বা ক্রন্দসী খুঁটি।

রাসুলে করিম (সা.) যে স্থানে দাঁড়িয়ে মসজিদে নববিতে নামাজের ইমামতি করতেন, সে মিহরাবকে মিহরাবুন নবী (সা.) বা নবীজি (সা.)-এর মিহরাব বলা হয়। হজরত জিবরাইল (আ.) যে স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছেন, সেখানকার মিহরাবটি মিহরাবে জিবরাইল বা হজরত জিবরাইল (আ.)-এর মিহরাব নামে পরিচিত।

ইসলামের বিজয়ের পীঠস্থান মদিনা মুনাওয়ারার ঐতিহাসিক স্থানগুলো জিয়ারতে হাজিরা পুণ্য লাভের পাশাপাশি নবীজি (সা.)-এর প্রিয় স্মৃতির দর্শনে ধন্য হবেন।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]