ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফরে আসছেন। ৩৩ বছর আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সর্বশেষ বাংলাদেশে এসেছিলেন। এ সময়ের মধ্যে দুই দেশেরই অনেক কিছু পাল্টে গেছে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। ভূরাজনীতির গতিপ্রকৃতিও নানা দিকে মোড় নিয়েছে। সেদিক দিয়ে ম্যাঁখোর এ সফর নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ফ্রান্স বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রধানতম খেলোয়াড়দের একটি, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় ফ্রান্স উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ভাষা, রন্ধনপ্রণালি ও শিল্প বিশ্বে ‘সফট পাওয়ার’ তৈরি পরিবর্তনে অবদান রাখে।
ফ্রান্সের কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব বৈশ্বিক বিষয়াবলির গতিপথকে প্রভাবিত করে। মহাকাশ প্রযুক্তি, স্বয়ংচালিত মেশিনারি, কৃষি, বিলাসদ্রব্যসহ বিভিন্ন নামকরা শিল্প নিয়ে ফ্রান্স বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনীতি।
এটি বিশ্বের শীর্ষ দুটি জোট জি-৭ এবং জি-২০–এর সদস্য, যেখানে দেশটি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক নীতি তৈরি ও পরিবর্তনে অবদান রাখে। জ্বালানি জায়ান্ট টোটাল এনার্জিস, উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস এবং বিলাসবহুল ফ্যাশন হাউস লুই ভুত্তো (এলভিএমএইচ) এবং কেরিংসহ অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সূতিকাগার।
ফ্রান্স ও বাংলাদেশের সম্পর্কের সূত্র তৈরি পোশাক রপ্তানি, প্রতিরক্ষা ক্রয়, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক লেনদেন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিদ্যমান। বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্রান্সের সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মতো ব্যাপক বিস্তৃত না হলেও খুব পিছিয়ে নেই। ফ্রান্স আমাদের পোশাক রপ্তানির অন্যতম ভালো বাজার, যেখানে বার্ষিক রপ্তানি প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের, ভারত ও চীনে আমাদের মোট রপ্তানির চেয়েও বেশি। ফ্রান্সের কাছ থেকে নৌযান ও হেলিকপ্টারসহ সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে বাংলাদেশ।
আফ্রিকায় সাম্রাজ্য হাতছাড়া হওয়ার সময়ে ফ্রান্সের দরকার নতুন ব্যবসায়িক গন্তব্য। প্রশ্ন হচ্ছে, সুযোগটাকে টেকসইভাবে কাজে লাগানোর সামর্থ্য বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কতটা আছে? কারণ, নির্বাচনে অনিয়ম ও মানবাধিকার প্রশ্নে সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের চাপের মুখে রয়েছে।
বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স উভয়ই জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা মোকাবিলায় সক্রিয়ভাবে জড়িত। ফ্রান্স নবায়নযোগ্য শক্তি এবং জলবায়ু অভিযোজন–সম্পর্কিত প্রকল্পসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের কিছু প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সেনাদের অবদান রেখেছে এবং ফ্রান্স বিশ্ব শান্তিরক্ষা প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের ভূমিকাকে স্বীকৃতি ও প্রশংসা করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকার দেশে দেশে ফ্রান্সের উপনিবেশবাদী আধিপত্যের দরকারি এক পতন পর্বের শুরু হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মহল ধারণা করছে। এই পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকটের ঝুঁকিতে রয়েছে ফ্রান্স। ফলে এই ধারণা অমূলক নয় যে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য নিয়ে এ অঞ্চলে এসে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নির্বাচনের আগে কিছু কৌশলগত বাণিজ্য ও সামরিক ক্রয় চুক্তি করে নেওয়া ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সফরের উদ্দেশ্য হতে পারে। অভিযোগ আছে, ফ্রান্সের অর্থনীতি খারাপের দিকে গেলে, দেশটি অস্ত্র বিক্রির সুযোগ খুঁজতে থাকে।
ইউরোপ ও আফ্রিকায় শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক ও রাজনৈতিক সংকটের কোনো ‘ডিপ্লোম্যাটিক সেটেলমেন্ট’ বা কূটনৈতিক বন্দোবস্ত করার সামর্থ্য ফ্রান্সের নেই বললেই চলে। নিজ দেশে দাঙ্গাসহ সামাজিক অর্থনৈতিক অস্থিরতায় পড়েছেন মাখোঁ। দেশটিকে ইদানীং কিছু বিষয়ে চীন-রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝামাঝি একটা অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়।
ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা মাখোঁর সফরের লক্ষ্য হতে পারে। শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয় এলে জলবায়ু পরিবর্তন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও অস্ত্র বিক্রির বিষয় আসবে আলোচনার টেবিলে। রোহিঙ্গা সংকট, আরাকানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতার প্রশ্নে শান্তিরক্ষী মিশনের সম্ভাব্য প্রয়োজনীয়তার আলাপ গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে মাখোঁ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক্সটার্নাল অ্যাকশন (ইইএএস)–এর পক্ষে বাংলাদেশকে কৌশলগত বার্তাও দিতে পারেন।
সামরিক ক্রয়ের প্রশ্নে ফ্রান্স যুদ্ধবিমান বিক্রির চেষ্টা করতে পারে, তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত ড্রোন যুদ্ধের নতুন যুগে এসবের আবেদন কমেছে। তবে বাংলাদেশ বিমানের জন্য ১০টি বা কিছু বেশি এয়ারবাসের উড়োজাহাজ কেনার ব্যাপারে সমঝোতা হতে পারে। এমানুয়েল মাখোঁর লক্ষ্য হতে পারে ফরাসি ব্যবসা বিকাশের চেষ্টা করা এবং বাংলাদেশে যৌথ উদ্যোগ বা বিনিয়োগের ভালো সুযোগ অন্বেষণ করা। যদিও চীন ভারতের সঙ্গে টেক্কা দেওয়া ফ্রান্সের পক্ষে কঠিন।
রাশিয়াকে পাশ কাটিয়ে রূপপুরের পরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে ফ্রান্স আগ্রহ দেখাতে পারে। এর আগে ফ্রান্সের থালিস বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বানিয়েছে। থালিস ও এয়ারবাস নিখুঁত স্যাটেলাইট ইমেজ প্রসেসিং (জিআইএস) ডেটা সরবরাহ করে, সাশ্রয়ী চুক্তি করা গেলে এসব জিআইএস ডেটা বাংলাদেশের বন্যা, কৃষি ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিসরে কাজে লাগানো যেতে পারে। বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পারসোর আবহাওয়া ও কৃষিবিষয়ক প্রকল্পের জন্য খুব কম খরচে ব্যাপক পরিসরে জিআইএস ডেটা দরকার।
তবে ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশ রেলপ্রযুক্তি নিলে খারাপ হবে না। ইউরোপীয় চার দেশের থালিস ট্রেন (বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস) নেটওয়ার্ক জাপানের মতো উন্নত নিরাপদ ও রিলায়েবল বলে সুখ্যাতি আছে।
আফ্রিকায় সাম্রাজ্য হাতছাড়া হওয়ার সময়ে ফ্রান্সের দরকার নতুন ব্যবসায়িক গন্তব্য। প্রশ্ন হচ্ছে, সুযোগটাকে টেকসইভাবে কাজে লাগানোর সামর্থ্য বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কতটা আছে? কারণ, নির্বাচনে অনিয়ম ও মানবাধিকার প্রশ্নে সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের চাপের মুখে রয়েছে।
মাখোঁর সফরে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের কার্যক্রম বাড়ানো, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা, সবুজ জ্বালানি, পরিবেশ জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক গবেষণা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়ানোর আলোচনা হতে পারে।
তবে সবকিছু ছাড়িয়ে মাখোঁর সফরে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গুরুত্ব পাবে। ভেতরে-ভেতরে যুদ্ধবাজ ও ঔপনিবেশিক শোষণের অভিযোগ থাকলেও ফ্রান্স মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গুরুত্বের প্রতি জোর দেয়।
একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, ফ্রান্সে একটি সক্রিয় নাগরিক সমাজ রয়েছে যারা ফরাসি, ইউরোপীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে বেশ সরব। সম্প্রতি তারা স্কুলে ‘আবায়া’ নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। ড. ইউনূস ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মাননা লেজিওন ডি'অনার পাওয়া ব্যক্তি।
তিনি ফ্রান্সের অভিজাত সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। আলোচনায় অন্য কোনো ইস্যু থাকলেও প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস থাকবেন। কেউ কেউ এমনো বলছেন, ড. ইউনূসকে হয়রানি না করতে পশ্চিমের স্পষ্ট বার্তা মাখোঁ সরকার দিতে পারে।
ফ্রান্স জাতিসংঘের শান্তি মিশনের বড় অংশীদার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ এবং এলিট ফোর্সের বিরুদ্ধে ক্রমাগত নির্যাতন গুম ও খুনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফরাসি প্রেসিডেন্টের সফরে শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ বাড়তি কোনো সুবিধা নিয়ে সমঝোতার সুযোগ পাচ্ছে না বলে মনে হয়; বরং বহু ক্ষেত্রে সতর্কতা শুনতে হতে পারে।
প্রভাবশালী ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (এএফডি) বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পরিস্থিতি এবং ড. ইউনূসকে মামলায় হয়রানির ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে। ফলে মাখোঁ বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ জানাবে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ দেবে, নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ পাঠানোর আগ্রহও দেখাবে বলে মনে হয়।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ও গবেষক