আওয়ামী লীগেও ‘না’, বিএনপিতেও ‘না’

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘হ্যাঁ’ শব্দটি প্রায় উঠে গেছে। জনগণের জন্য যেসব দল রাজনীতি করে, সেটি হোক ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী দল, তারা জনগণের ভাষা বোঝে না। জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষার কোনো গুরুত্ব দেয় না।

আগে বিরোধী দল অন্তত জনগণের দাবিদাওয়া, সমস্যা–সংকট নিয়ে আন্দোলন করত। এখন সেটিও অনুপস্থিত। এই যে দেশে ভয়াবহ দাবদাহের মধ্যে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং, নিত্যপণ্যের দামের পাগলা ঘোড়া জনগণকে পিষ্ট করে চলেছে, তা নিয়েও বিরোধী দলের কোনো কথা নেই। তাদের একটাই কথা, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থেকে চলে গেলেই সব মুশকিলের আসান হবে। বিএনপির শাসনামলেও আওয়ামী লীগ নেতারা একই রকম কথাবার্তা বলতেন। কিন্তু বাস্তবে দেশ উল্টো ধারায়ই চলছে।

অতীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে বিএনপির নেতা–কর্মীরা ‘না’ বলেছেন, রাস্তায় আন্দোলন করেছেন। বিএনপির নেতৃত্বকে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা ‘না’ বলেছেন, রাস্তায় আন্দোলন করেছেন। কখনো সফল হয়েছেন, কখনো বিফল হয়েছেন। এখন নিজ দলের নেতা–কর্মীরাই নিজ দলের নেতৃত্বকে সরাসরি না বলে দিচ্ছেন। চ্যালেঞ্জ করছেন।

আওয়ামী লীগ নিজেকে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে দাবি করে। কিন্তু সেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশনা যখন তৃণমূলের নেতা–কর্মীরা অগ্রাহ্য করেন, তখন আর সেটিকে সুসংগঠিত বলা যায় না।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মন্ত্রী–এমপিদের আত্মীয়স্বজনেরা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না বলে নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ মন্ত্রী–এমপির স্বজন সেটি অগ্রাহ্য করে ৮ মের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধান অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দ্বিতীয় পর্বে নতুন করে আরও প্রায় ৩৫ জন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের স্বজন চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। চেয়ারম্যান পদে দলীয় সিদ্ধান্ত না মানায় ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের বসাতে কোনো চেষ্টাই করেনি দলটি।

প্রথম পর্বের ভোট ৮ মে। সোমবার ছিল প্রথম পর্বের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। অন্যদিকে দ্বিতীয় পর্বের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা শেষ হলো গত রোববার। এই পর্বের ভোট হবে ২১ মে।

দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে মাদারীপুর সদরে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী রয়ে গেছেন সংসদ সদস্য শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক চৌধুরী, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন এবং সোনাতলা উপজেলায় সাহাদারা মান্নানের ছোট ভাই মিনহাদুজ্জামান।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আলীর ছোট ছেলে আলী আফসার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। মোহাম্মদ আলী ও সফিকুল ইসলাম বর্তমান সংসদ সদস্য মাজহারুল ইসলামের চাচা। আর আলী আফসার মাজহারুল ইসলামের চাচাতো ভাই।

কুষ্টিয়া পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। তিনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ সদস্য আবদুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই হারুন অর রশীদও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেনি।

গত ২৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই সুযোগে দেশে অনেক জায়গায় মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা নিজের সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের চেয়ারম্যান পদে দাঁড় করিয়ে দেন। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে, যেকোনো নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ প্রার্থী হলে সরাসরি বহিষ্কার হবেন। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শাস্তি না দিয়ে বরং পরে দলে টেনে নেওয়া হয়েছে।

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে অপহরণের অভিযোগ ওঠার পর নাটোরে সিংড়া উপজেলা নির্বাচনে গত রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক লুৎফুল হাবীব। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী দেলোয়ার হোসেনকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছিল। দ্বিতীয় পর্বে চট্টগ্রামের রাউজানে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে একজন করে প্রার্থী হয়েছেন। এর অর্থ আওয়ার্মী লীগ নেতৃত্ব যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চেয়েছে, সেটি হচ্ছে না।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপিতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বিএনপি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলটির অন্তত ৩৮ জন সাবেক-বর্তমান নেতা এবং তাঁদের স্বজন চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন। অর্থাৎ তাঁরা দলীয় সিদ্ধান্তকে ‘না’ বলেছেন। ৩৮ জনের মধ্যে ১৮ জন বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের পদধারী নেতা। বাকি ২০ জনের মধ্যে ১১ জন দল থেকে বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কৃত, অব্যাহতিপ্রাপ্ত এবং বিএনপির সাবেক নেতা ও অঙ্গসংগঠনের নেতা। এ ছাড়া বিএনপির নেতাদের আত্মীয়স্বজন বা এই দলের লোক হিসেবে পরিচিত আরও ৯ জন নির্বাচনে রয়েছেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এই ধাপে দলের সাবেক-বর্তমান মিলে ৪৯ নেতা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। সোমবার ছিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। এর মধ্যে ১১ জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। অনেকে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন না করার ঘোষণা দেন।

ডেইলি স্টারের খবরে বলা হয়, ১৫ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপজেলা নির্বাচন না করার সিদ্ধান্তের পর দলটির নেতৃত্বের চেষ্টা ছিল দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে ফেরানোর। এ লক্ষ্যে দলের কেন্দ্রীয়, বিভাগীয় ও জেলার নেতাদের বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্ত এবং নেতাদের সব চেষ্টা-তদবির উপেক্ষা করে ৩৮ জন নির্বাচন করছেন। এর মধ্যে দলের থানা-উপজেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ১৮ জন বিভিন্ন পর্যায়ের পদধারী নেতা রয়েছেন।

২১ মে দ্বিতীয় ধাপে সারা দেশে ১৬০ উপজেলায় নির্বাচন হবে। প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় ধাপেও বিএনপির অন্তত ৩৫ নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

দুই দলের নেতৃত্বকে জনগণ অনেক আগেই ‘না’ বলে দিয়েছে। গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব জনগণের প্রতি আহ্বান রেখেছিল যে দেশি–বিদেশি ষড়যন্ত্র রুখতে যেন সবাই দলে দলে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে আসেন। কিন্তু দেড় কোটি জন–অধ্যুষিত ঢাকা শহরে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ১০ থেকে ১৫ শতাংশেরও কম। এর অর্থ ৮৫ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ ভোটার তাদের আহ্বান অগ্রাহ্য করেছেন।

আবার বিএনপির নেতৃত্ব ভোটবর্জনের পাশাপাশি জনগণের প্রতি অসহযোগ আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। এই অসহযোগের মধ্যে ছিল খাজনা, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের বিল পরিশোধ না করা। কিন্তু সাধারণ মানুষ দূরে থাক, বিএনপির নেতা–কর্মীরাও অসহযোগ করেননি।

এখন উপজেলা নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচন বর্জনের যে আহ্বান জানিয়েছিল, তার বিরোধিতা করে দলের অনেক নেতা–কর্মী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে তাঁরা ‘না’ বলেছেন। একইভাবে আওয়ামী লীগ যে মন্ত্রী–এমপিদের স্বজনকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁরাও সেটি অগ্রাহ্য করেছেন।

এর অর্থ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্ব জনগণের ভাষা তো বোঝেই না, এমনকি তাঁরা দলের তৃণমূলের নেতা–কর্মীদের ভাষাও বুঝতে অক্ষম।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি