ইউক্রেন যুদ্ধে যৌন সহিংসতাকে যেভাবে অস্ত্র বানিয়েছে রাশিয়া

একটি যুদ্ধে যৌন সহিংসতা সাধারণ ঘটনা। কিন্তু সেটা কেবল যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়।ছবি : রয়টার্স

নৃশংসতা রাশিয়ার যুদ্ধের একটা উপায়। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর রাশিয়া এমন সব কর্মকাণ্ডকে অস্ত্র করে তুলেছে, আন্তর্জাতিকভাবে যেটাকে অপরাধ বলে। এর মধ্যে যৌন সহিংসতাও রয়েছে। ২০২২ সালে সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরুর পর রাশিয়া যৌন সহিংসতা ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে।

এই সহিংসতা কী উপায়ে চালানো হচ্ছে, সেটা পড়া কারও জন্য কষ্টসাধ্য। কিন্তু নথিপত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, যৌনাঙ্গে আঘাত ও অঙ্গছেদ, খোঁজাকরণ, ধর্ষণের হুমকি ও পরিবারের সদস্যদের তাঁদের প্রিয়জনের নিপীড়নের দৃশ্য দেখতে বাধ্য করার মতো অপরাধ সেখানে ঘটছে।

একটি যুদ্ধে যৌন সহিংসতা সাধারণ ঘটনা। কিন্তু সেটা কেবল যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। কিন্তু রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রের সীমানার বাইরেও যৌন সহিংসতাকে প্রথা বানিয়ে ফেলেছে। তারা তাদের নৃশংস চিন্তাকে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরেও বিস্তার করেছে।

এটা একেবারে শীর্ষ থেকে শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়ন চান, সেটা জানাতে গিয়ে যৌনতাব্যঞ্জক কৌতুক করে বলেন, ‘আমার সৌন্দর্য, তোমার কর্তব্য।’

আরও পড়ুন

যে দেশে নারী, লৈঙ্গিকভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা নৈমিত্তিক ঘটনা, সে দেশে পুতিনের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না হওয়াটাই স্বাভাবিক। গৃহ সহিংসতাকে রাশিয়া অপরাধ বলে মনে করে না।

গর্ভপাতের অধিকার সীমিত করায় সেখানে নারীবাদী আন্দোলনকেও চরমপন্থা হিসেবে দেখা হয়।

এ ধরনের একটা সমাজে খুব সহজেই যুদ্ধকালের যৌন সহিংসতার ব্যাপারে সম্মতি উৎপাদন করা সম্ভব।

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিনিময়ে ধর্ষকদের ক্ষমা করে দিয়েছে রাশিয়া। দেশটির সেনাবাহিনীতে নিয়োগপ্রক্রিয়াও নিষ্ঠুর ও ধোঁয়াশায় পূর্ণ। যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া রুশ সেনারা এবং ভাগনারদের মতো ভাড়াটেরও জানেন যে চেচনিয়া, মলদোভা, জর্জিয়া, সিরিয়া ও মালিতে নৃশংসতার জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয়নি।

ইউক্রেনের ওপর জাতিসংঘের অনুসন্ধান কমিশনের সূত্রমতে, রুশ সেনাসদস্যরা ‘অস্ত্রের মুখে চরম নৃশংস’ উপায়ে যৌন সহিংসতার মতো অপরাধ করে চলেছে। যৌন সহিংসতার শিকার যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মেয়েশিশু, ছেলেশিশু, নারী ও পুরুষেরাও রয়েছেন। ৪ বছর থেকে শুর করে ৮০ বছর বয়সী নারী-পুরুষের বিরুদ্ধে এসব সহিংসতা চালানো হয়েছে। অধিকৃত অঞ্চলে বেসামরিক মেয়েশিশু ও নারীদের প্রধানত লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। আর আটককৃত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বেসামরিক পুরুষ।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ক্রেমলিনের রেকর্ড ভয়াবহ। এ ধরনের প্রস্তাব রুশদের তাদের অধিকৃত এলাকায় আরও নৃশংসতা চালাতে উৎসাহিত করবে। এ ধরনের প্রস্তাবের পরিবর্তে তাই যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া পরাজিত করার জন্য সব ধরনের সমর্থন দরকার ইউক্রেনের।

এই অপরাধীরা গর্ভবতী নারীদেরও রেহাই দেয়নি। তাঁদের অনেকে গর্ভপাতের ভয় পাচ্ছেন। আবার অনেকে ভয় পাচ্ছেন তাঁদের নবজাতক সন্তানকে রাশিয়াতে নিয়ে যাওয়া হবে কি না। রাশিয়ার সেনারা তাঁদের যৌন অপরাধ জায়েজ করতে গিয়ে অমানবিক বাগাড়ম্বর করে। তারা বলে যে ইউক্রেনীয়দের নরপশু জন্ম দেওয়ার কাজটি থামাতে হবে।

এ ধরনের যৌন সহিংসতা যৌন অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ কিংবা মোটা দাগে মানবাধিকার লঙ্ঘন। এই অপরাধকে গণহত্যা কিংবা গণহত্যার উদ্দেশ্যে সংগঠিত অপরাধ হিসেবেও বিবেচনা করা যায়।

এখন পর্যন্ত এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ করে অনেক মূল্যবান নথিপত্র তৈরি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

কিন্তু কলম্বিয়া থেকে বসনিয়া—সব জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে, লজ্জা, সামাজিক বাধা ও ভুক্তভোগীদের স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য নিরাপত্তা বিবেচনায় এই ধরনের অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া অনেক ধীর। ইউক্রেনের যৌন অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের জন্য সামগ্রিক বিচার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করে একটা নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। এ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার কিছু পথ খোলা আছে।

প্রথম পথটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। এই আদালতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম চারটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, শিশু নির্বাসন ও জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর হামলা চালানোর অভিযোগে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পরের অভিযোগটি সম্ভবত যৌন সহিংসতা নিয়ে গঠিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংঘাত চলাকালে যৌন নিপীড়নকে অস্ত্র করে তোলার জন্য শীর্ষ কমান্ডারদের জবাবদিহির আওতায় আনার অতীতের ব্যর্থতা ঘোচানোর সুযোগ রয়েছে।

দ্বিতীয় পথটি সর্বজনীন বিচারিক নীতির আওতায় অন্য দেশে বিচার। এই ধরনের বিচারপ্রক্রিয়াকে কিয়েভ খুব জোরালোভাবে সমর্থন জানাবে। কেননা, এতে করে মামলার পাহাড়সম বোঝা থেকে তারা মুক্তি পাবে। জার্মানির একজন আইনজীবী সম্প্রতি কিয়েভ অঞ্চলের যৌন সহিংসতার বিচার চেয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন। এ মামলা কোন আদালতে যাবে, তার জন্য বিচারিক বিচক্ষণতা দরকার। বিশ্বজুড়ে আইনজ্ঞরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যাতে ইউক্রেনের মামলায় যৌন অপরাধকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

সর্বশেষ পথটি হলো, এসব অপরাধের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ তুলেছে ইউক্রেন আর তাদের বিচারব্যবস্থা এখনো সচল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউক্রেনের প্রসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয়

সংঘাতের কারণে ঘটা যৌন সহিংসতাবিষয়ক বিশেষায়িত ইউনিট প্রতিষ্ঠা করে। একজন নারী আইনজীবী এই ইউনিটটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আরও অনেক নারী আইনজীবী তাঁকে সহায়তা করছেন। এই ইউনিটটি যৌন সহিংসতার শিকার ভুক্তভোগীদের তাঁদের পছন্দমতো আইনজীবী বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয়। এই একই ধরনের লিঙ্গ বৈচিত্র্যের তদন্তকারী ও আইনজীবী আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে দরকার।

আমাদের মতো ইউক্রেনীয়দের জন্য এই যুদ্ধ যতটা মূল্যবোধ রক্ষার, তার চেয়ে বেশি অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ।

আমরা ২০১৩-১৪ সালে মর্যাদার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গেছি। সেই বিপ্লব আমাদের দ্ব্যর্থহীনভাবে একটা আইনের শাসন বেছে নেওয়ার পথ দিয়েছে। রাশিয়ার কাছে আমাদের এক ইঞ্চি ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার জন্য আলাপ-আলোচনার প্রস্তাবের মানে হচ্ছে আমাদের জন্য বড় পরাজয়।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ক্রেমলিনের রেকর্ড ভয়াবহ। এ ধরনের প্রস্তাব রুশদের তাদের অধিকৃত এলাকায় আরও নৃশংসতা চালাতে উৎসাহিত করবে। এ ধরনের প্রস্তাবের পরিবর্তে তাই যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া পরাজিত করার জন্য সব ধরনের সমর্থন দরকার ইউক্রেনের।

  • কাতেরিনা বুসল ইউক্রেনীয় আইনজীবী
    দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত