গত মার্চে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার ৪২ দশমিক ৬৮, যা ২০১৬ সালের ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি। যদিও এই তথ্যমতে, কর্মক্ষম নারীদের ৫০ শতাংশেরও বেশি এখনো দেশের শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত নন, তবু অংশগ্রহণের এই বৃদ্ধি আমাদের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক সংবাদ। তবে প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো এই আশার অন্তরালেও রয়েছে নিরাশার এক পরিসংখ্যান। শ্রমশক্তিতে শহরের নারীদের অংশগ্রহণের হার কমেছে। এটি আসলে কোনো নতুন খবর নয়।
শ্রমশক্তিতে শহরের নারীদের অংশগ্রহণের হার মূলত ২০১০ সাল থেকেই নিম্নমুখী। ২০১০ সালে যেখানে শহরের ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ নারী শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, সেখানে ২০২২ সালে তাঁদের অংশগ্রহণের হার ২৩ দশমিক ৬-এ এসে ঠেকেছে। পক্ষান্তরে একই সময়ে গ্রামীণ নারীদের অংশগ্রহণ ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ দশমিক ৮৯-তে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়নের পরিপ্রেক্ষিতে শহরে হ্রাসের এই ধারা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। বিশেষত, যখন আমরা একটি নগরকেন্দ্রিক ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, শহর নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে অধিক সুযোগ ও স্বাধীনতার দুয়ার খুলে দেয়। এমনকি গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে উপাখ্যান, তার একটি বড় অধ্যায়জুড়ে আছে শহরের নারীদের, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের অবদান। ফলে শ্রমবাজারে শহরের নারীদের অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়বে, এটাই প্রত্যাশিত। স্বাভাবিকভাবে তাই একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়, কেন শ্রমশক্তিতে শহরের নারীদের অন্তর্ভুক্তি কমছে?
এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনো জানা না থাকলেও এ ক্ষেত্রে প্রথমেই সামনে চলে আসে শহরে নারীদের কর্মসংস্থানের প্রধান খাত হিসেবে বিবেচিত তৈরি পোশাকশিল্পে গত দশক থেকে নারী শ্রমিকদের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়ার বিষয়টি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রিনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট’-এর অধীন পরিচালিত ‘ম্যাপড ইন বাংলাদেশ’-এর সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, তৈরি পোশাকশিল্পে নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের হার যথাক্রমে ৫৭ দশমিক ৫ এবং ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ; যেখানে ২০১২ সালের দিকেও এই খাতে কর্মরত শ্রমিকদের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশই ছিলেন নারী। নারীদের সহজ বশ্যতা ও সস্তা শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই খাতে বর্তমানে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ব্যবহার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের হাওয়া লেগেছে। ফলে পোশাক কারখানাগুলো দক্ষ শ্রমিক নিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ-সুবিধায় পুরুষেরা এগিয়ে থাকার কারণে তাই এই খাতে নারীদের অংশগ্রহণ দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে বলেই বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের অভিমত।
তৈরি পোশাকশিল্পের এই পরিবর্তন ও শ্রমশক্তিতে শহরের নারীদের অংশগ্রহণ কমার বিষয়টি মিলিয়ে দেখলে, শহরে নারীদের বিকল্প পেশার অভাব চোখে পড়ে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও জেন্ডার-সম্পর্কিত সামাজিক প্রথাগুলোর ভিত্তিতে নারীদের জন্য কিছু গ্রহণযোগ্য পেশা রয়েছে। তৈরি পোশাকশ্রমিক ছাড়া নার্স, বিউটি পারলার কর্মী, গৃহকর্মী, গৃহভিত্তিক দরজি ও গৃহভিত্তিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মতো হাতে গোনা কিছু পেশাকেই মূলত শহরের নারীরা বেছে নেন। খেয়াল করলে দেখা যাবে, যে এসব পেশার অধিকাংশই খণ্ডকালীন ও অনিয়মিত প্রকৃতির, যেখানে কাজের চাহিদা যেমন কম, কাজ হারানোর ঝুঁকিও তেমন বেশি। লিঙ্গভিত্তিক পেশাগত এই বিভাজনের ফলে তাই শহরের শ্রমবাজারে নারীরা একদিকে যেমন বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে পারেন না, তেমনি একটি নির্দিষ্ট পেশায় বিপুল সংখ্যায় নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হন।
শ্রমবাজারে লিঙ্গভিত্তিক পেশাগত বিভাজনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত নারীদের ঘরের কাজ ও সন্তান লালনসহ পুনরুৎপাদনশীল কাজের ভার। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯-এর একটি প্রতিবেদন ‘ভয়েসেস টু চয়েসেস’-এ উঠে এসেছে ‘বিয়ে’ শহরের নারীদের শ্রমবাজারে প্রবেশের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। অথচ শহরের পুরুষ এবং গ্রামের পুরুষ ও নারী উভয়ের শ্রমবাজারে প্রবেশের পক্ষেই এটি সহায়ক। পর্যাপ্ত ও সাশ্রয়ী সন্তান প্রতিপালন ব্যবস্থাপনার অভাবে শহরের ছোট পরিবারভিত্তিক সমাজে সন্তান লালন-পালনের গুরুভার প্রায় পুরোটাই ঘরের নারী সদস্যের একার ঘাড়ে বর্তায়, যা সামলে উৎপাদনমূলক কাজে জড়িত হওয়া তাদের পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়ে। ফলে তাঁরা ঝুঁকে পড়েন আগের অনুচ্ছেদে উল্লিখিত গৃহভিত্তিক, খণ্ডকালীন ও অনিয়মিত পেশাগুলোর দিকে। তৈরি পোশাকশিল্প (এবং অন্যান্য খাতে) নারীদের দক্ষতার যে ঘাটতির কথা ওপরে বর্ণিত হয়েছে, তার পেছনেও লিঙ্গভিত্তিক পেশাগত বিভাজন, পুনরুৎপাদনশীল কাজের দায়িত্ব মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তবে এর পাশাপাশি আরেকটি প্রতিবন্ধকও শহরের নারীদের দক্ষতা অর্জনে ও জীবিকা উপার্জনে গুরুত্বপূর্ণ; নারীদের চলাচলের সীমাবদ্ধতা ও নিরাপত্তার ভয়।
শহরে জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে চলাচলের সুযোগ-সুবিধা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই একটি প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ২০১৯-এ প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আরেক প্রতিবেদন ‘হোয়াট ওয়ার্কস ফর উইমেন’-এর মতে, ঢাকা শহরের জনপরিসর এবং পরিবহনব্যবস্থা অনেক বেশি পুরুষবান্ধব, যেখানে নারীরা মোটেই নিরাপদ বোধ করেন না। আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায়ও আমরা দেখতে পাই, শহরের জনপরিসরে নারীর প্রয়োজনগুলো, যেমন ব্যবহারোপযোগী শৌচাগার, মাতৃদুগ্ধ পান কেন্দ্র, নিরাপদ গণপরিবহনব্যবস্থা, নিরাপদ ফুটপাত ইত্যাদি চরমভাবে উপেক্ষিত। প্রথাগতভাবে নারীদের ওপর আরোপিত চলাচলের বিধিনিষেধের সঙ্গে সঙ্গে এসব সমস্যা যখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের’ মতো চেপে বসে, তখন ঢাকার মতো অর্থনৈতিকভাবে একটি প্রাণবন্ত নগরে থেকেও অনেক নারীর জীবন আটকে থাকে একটি নির্দিষ্ট সামাজিক গণ্ডিতে। দিন দিন শহরের জনপরিসর এবং পরিবহনব্যবস্থার যে অবনতি হচ্ছে, তাতে শ্রমবাজারে নারীদের প্রবেশপথ যে আরও সংকীর্ণ হবে, সে আশঙ্কা করাই যায়।
শ্রমশক্তিতে শহরের নারীদের অংশগ্রহণে করোনার মতো অতি সাম্প্রতিক একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) একটি প্যানেল জরিপে উঠে এসেছে, করোনার ঠিক আগে (ফেব্রুয়ারি ২০২০) যেসব কর্মজীবী নারী কোনো আয়মূলক কাজের সঙ্গে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ মে ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী কর্মহীন ছিলেন, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ৪ শতাংশ। জরিপটিতে অংশগ্রহণকারী নারীদের একটি বড় অংশ ছিলেন শহরের নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী নারী।
কেন এসব নারী শ্রমবাজারে ফিরতে পারছেন না, তার কারণগুলো অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি দেখতে পেয়েছি, জেন্ডারভিত্তিক সমাজ প্রথাগুলো দ্বারা নির্মিত যেসব অন্তরায়ের কথা আমি ওপরে উল্লেখ করেছি, সেগুলো করোনাকালে আরও প্রকট হয়ে তাঁদের ফেরার পথ প্রতিকূল করে তুলেছে। করোনার এই প্রভাব তাই শ্রমশক্তিতে শহরের নারীদের, বিশেষত নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী নারীদের অংশগ্রহণ হ্রাসে একটি প্রধান অনুঘটক হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে।
আর্থসামাজিক উন্নয়নের যাত্রায় বাংলাদেশ এখন যে সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, তার স্নায়ুকেন্দ্র দেশের শহরগুলো। ফলে শহরের অর্ধেক জনশক্তির শ্রমবাজারের বাইরে থাকা দেশের টেকসই উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে সন্দেহাতীতভাবেই একটি অশুভ লক্ষণ। কীভাবে এবং কোন পদক্ষেপের মাধ্যমে শহরের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো যায়, সে দিকনির্দেশনা আমাদের প্রয়োজন। আর তাই ঠিক কোন নিয়ামকগুলো তাদের অংশগ্রহণে সংকট ও সম্ভাবনা তৈরি করছে, সেগুলো সম্পর্কে দরকার গবেষণালব্ধ জ্ঞান, যাতে করে পুরোনো অচলায়তন ভেঙে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আমরা ভাবতে পারি নতুন করে, নতুনভাবে, নতুন চোখে।
জাহিদ নূর রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভোলপমেন্ট (বিআইজিডি)