কাকরাইল থেকে পল্টনের দিকে যেতে হাতের ডান দিকে সুউচ্চ ভবনটি আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের। আগে সেখানে একটি ছোট্ট বিল্ডিং ছিল। কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপের অংশীদারত্বে বর্তমান ভবনটি নির্মিত।
সুরাটি ব্যবসায়ী শেঠ ইব্রাহিম মুহাম্মদ ডুপ্লের উদ্যোগে ১৯০৫ সালে কলকাতায় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের বেওয়ারিশ লাশ সংগ্রহ ও দাফন করা। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় কলকাতার রাস্তায় হাজার হাজার বেওয়ারিশ লাশ পড়ে থাকার কারণে। দেশ ভাগের পর আঞ্জুমান মফিদুল ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ঢাকার বাইরেও অনেক শহরে এর অফিস আছে।
পরাধীন দেশে কেউ বেওয়ারিশ থাকতে পারেন; কিন্তু স্বাধীন দেশে সেটি থাকার কথা নয়। যদি কোনো ব্যাধি, দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে কেউ স্বজন হারান, রাষ্ট্রকেই স্বজনের দায়িত্ব পালন করার কথা।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে আছে, প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ, রাষ্ট্রের মালিক যদি জনগণ হয়, তাহলে কারোরই বেওয়ারিশ হওয়ার কথা নয়। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমরা বেওয়ারিশ মানুষ ও লাশ দেখতে পাচ্ছি।
অর্থনৈতিকভাবে দেশ অনেক উন্নত হয়েছে, ঢাকা শহরের চাকচিক্য বেড়েছে, কোটিপতির সংখ্যা কয়েক শ গুণ বেড়েছে। কিন্তু বেওয়ারিশ মানুষের সংখ্যা কমছে না। জীবিত থাকতে যেমন, তেমনি মৃত্যুর পরও অনেকে বেওয়ারিশ হয়ে যান। এই বেওয়ারিশদের হেফাজতের জন্য আছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম।
৮ জুলাই ভোরে নরসিংদীর রেলস্টেশন–সংলগ্ন কমলপুর এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে যে পাঁচজন মানুষ মারা যান, তাঁদের কারও পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকা কয়েক ব্যক্তি সকাল আটটায় পাঁচজনের লাশের টুকরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজনের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন ও দুজনের শরীর দ্বিখণ্ডিত ছিল। চারজনের হাত-পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যরা মরদেহের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেও পরিচয় শনাক্ত করতে পারেননি। এই পাঁচজনের মধ্যে তিনজনের বয়স ১৮ বছরের নিচে এবং দুজনের ১৮ বছরের ওপরে। শেষের দুজনের পরিচয়পত্র বা আইডি থাকার কথা। আর আইডি থাকলে পিবিআইয়ের নেওয়া আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলে যেত। না মেলা মানে তাঁদের পরিচয়পত্রই ছিল না। অভাবিত উন্নয়নের পথে ধাবমান এই রাষ্ট্র তাঁদের পরিচয় খুঁজে পায়নি।
ময়নাতদন্ত শেষে রেলওয়ে পুলিশ নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়িসংলগ্ন কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তাঁদের দাফন করে। প্রশ্ন উঠেছে, তাঁরা কি ট্রেনে ভ্রমণ করছিলেন? তাঁরা কি ট্রেনের দরজায় ঝুলছিলেন? তাঁরা যদি এলাকার কেউ হতেন, তাহলে আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নেওয়ার কথা। আর বাইরের কেউ হলে কোথা থেকে এসেছিলেন?
নরসিংদীর ঘটনাটি ছিল নিছক দুর্ঘটনা। পথঘাটে এ রকম বেওয়ারিশ হয়ে যাওয়া অনেক মানুষ আমরা দেখেছি। আবার আন্দোলনে গিয়েও অনেকে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যান।
জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে চলা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেসব প্রাণহানি ঘটল, তাঁদেরও অনেকের পরিচয় পাওয়া যায়নি। আবার সবাই মিছিল করতে এসে পুলিশের গুলি খেয়ে মারা গেছেন, তা–ও নয়। কেউ ফুটপাতে বসে হকারি করছিলেন, কেউ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মারা গেছেন। আবার এঁদের একাংশ ছিলেন ভবঘুরে। জীবিত থাকতে কেউ তাঁদের খোঁজ নেননি। মৃত্যুর পরও না।
প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত ১ শিশুসহ ২১ জনের লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। রাজধানীর তিনটি সরকারি হাসপাতালের মর্গ থেকে এই ২১ জনের লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে দিয়েছে পুলিশ। লাশগুলো পাওয়ার পর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাগ এলাকায় দাফনের ব্যবস্থা করা হয়।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সূত্র জানায়, গত সোমবার সংঘর্ষে নিহত এক শিশুসহ নয়জনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে তাদের দেওয়া হয়। মঙ্গলবার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) থেকে একটি লাশ পায় তারা। বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে নয়টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এরপর ওই ২১ জনের লাশ রায়েরবাগ এলাকায় দাফন করা হয়।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে লাশ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত একজন বলেন, সোমবার ছয়জনের লাশ মর্গে আনা হয়। তাঁদের কারও শরীরে গুলি, আবার কারও শরীরে ছিল মারাত্মক জখমের চিহ্ন। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফনসেবা কর্মকর্তা কামরুল আহমেদ বলেন, ‘তিন দিনে পুলিশের কাছ থেকে বেওয়ারিশ হিসেবে ২১ জনের লাশ পেয়েছি।’ (প্রথম আলো, ২৫ জুলাই, ২০২৪)
এরপর ১৪ আগস্ট শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে আরও তিনটি বেওয়ারিশ লাশের খোঁজ পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪।
পরাধীন দেশে রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা ছিল না। তাদের আখ্যায়িত করা হত নেটিভ হিসেবে। যে মানুষের কোনো স্বজন নেই, কোনো সহায়সম্বল নেই, তারাই বেওয়ারিশ হিসেবে চিহ্নিত।
এই যে ২১ লাশ পুলিশ আঞ্জুমান মুফিদুলের কাছে হস্তান্তর করল, তাঁরাও এই দেশের মানুষ। কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ কেউ তাঁদের আপন করে নেয়নি। ফলে মারা যাওয়ার পরও তাঁদের পরিচয় হলো বেওয়ারিশ। তাঁদের কেউ হয়তো মেধা ও কোটার ভাগাভাগিটাও বোঝেন না। দোলনা ও কবর পর্যন্ত শিক্ষা নয়, বঞ্চনাই তাঁদের নিত্যসঙ্গী।
কোটা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এক শিক্ষার্থীর নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে তাঁর বাবা কুমিল্লা থেকে ঢাকা এসেছিলেন। হাসপাতালের মর্গে মর্গে সন্তানের খোঁজ করেছেন। তিনি সৌভাগ্যবান যে সন্তানকে জীবিত ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু কোটা আন্দোলনে যে ৪ শতাধিক মানুষ মারা গেলেন, তাঁরা আর কখনো ফিরে আসবেন না। স্বজনেরা তাঁদের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকবেন।
কিন্তু ওই শিক্ষার্থীর বাবার মতো যাঁরা ঢাকা শহরে এসে সন্তানের খোঁজও নিতে পারবেন না, তাঁদের কেউ গুলির ক্ষত বয়ে বেড়াবেন, কেউ–বা হয়ে যাবেন বেওয়ারিশ লাশ।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি